আস্থাহীন উদ্যোক্তা স্থবির কর্মসংস্থান

আমার দেশ অনলাইন
প্রকাশ : ২৪ অক্টোবর ২০২৫, ০৯: ৩২
ফাইল ছবি

আস্থা সংকটে উদ্যোক্তারা, গতি নেই অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারেÑএই বাস্তবতা এখন দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। কয়েক বছর আগেও যখন দেশীয় ও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা নতুন কারখানা স্থাপন, ব্যবসা সম্প্রসারণ কিংবা প্রযুক্তি খাতে বড় উদ্যোগ নেওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন, তখন অর্থনীতির মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু এখন পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। ব্যবসায়ীরা নতুন বিনিয়োগ থেকে সরে আসছেন, পুরোনো বিনিয়োগ ধরে রাখতেই হিমশিম খাচ্ছেন। আদালত-মামলার জট, প্রশাসনিক হয়রানি, নীতির অস্থিরতা, জ্বালানি সংকট এবং নিরাপত্তাহীনতাÑসবকিছু মিলে ব্যবসায়ীরা আস্থাহীনতার এক দুষ্টচক্রে আটকা পড়েছেন। এই অবস্থা থেকে বের হতে না পারলে দেশের প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান, রপ্তানিÑসবকিছু থেমে যাবে, অর্থনীতি ধীরে ধীরে স্থবিরতার দিকে চলে যাবে।

উদ্যোক্তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ভয়ের জায়গা হলো মামলা ও হয়রানি। ব্যবসা করতে গিয়ে নানা কারণে ঝুঁকি তৈরি হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু ঝুঁকি সামলানোর পরিবর্তে উদ্যোক্তাদের ঘাড়ে একের পর এক মামলা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কখনো ব্যাংকঋণ পরিশোধে সামান্য বিলম্ব, কখনো চেক ডিজঅনার, কখনো কর-সংক্রান্ত বিরোধÑসবকিছুতেই মামলা ঠুকে দেওয়া হচ্ছে। একজন উদ্যোক্তা দিনের পর দিন আদালতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন অথচ তার সময় ব্যয় হওয়া উচিত উৎপাদন, বাজার সম্প্রসারণ কিংবা প্রযুক্তি উন্নয়নে। ব্যবসায়ী সমাজে এখন প্রবাদ হয়ে গেছেÑব্যবসার পাশাপাশি মামলা সামলানো আমাদের দৈনন্দিন কাজ। এই সংস্কৃতি উদ্যোক্তাদের আস্থা ভেঙে দিচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

বিনিয়োগ স্থবির হয়ে পড়ার সরাসরি প্রভাব পড়ছে কর্মসংস্থানে। বাংলাদেশে প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক তরুণ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে। শিক্ষিত তরুণরা যেমন চাকরি খুঁজছে, তেমনি কম দক্ষ তরুণরা শিল্প-কারখানায়, নির্মাণ খাতে বা সেবা খাতে কাজের সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। কিন্তু নতুন শিল্প গড়ে না উঠলে, বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলো সম্প্রসারণ না করলে এই বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠীর জন্য কাজের সুযোগ তৈরি হয় না। ইতোমধ্যে দেখা যাচ্ছে, অনেক প্রতিষ্ঠান নতুন কর্মী নেওয়া বন্ধ করেছে, কেউ কেউ কর্মী ছাঁটাই শুরু করেছে। এতে বেকারত্ব বাড়ছে, সমাজে হতাশা তৈরি হচ্ছে, তরুণ প্রজন্ম বিদেশে চলে যাওয়ার চেষ্টা করছে।

নীতির অস্থিরতা উদ্যোক্তাদের আস্থাহীনতার আরেকটি বড় কারণ। বিনিয়োগকারীরা চান দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা। তারা জানতে চান, আগামী পাঁচ থেকে দশ বছর নীতি কেমন হবে। কিন্তু বাংলাদেশে প্রায়ই দেখা যায় হঠাৎ করে করহার বদলে যায়, শুল্কনীতিতে উলট-পালট হয়, কখনো ভর্তুকি ঘোষণা করা হয় আবার অল্প সময়ের মধ্যেই তা প্রত্যাহার করা হয়। এর ফলে উদ্যোক্তারা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। তারা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে সাহস পান না। অথচ বিনিয়োগ এমন একটি ক্ষেত্র, যেখানে কয়েকশ কোটি টাকা খরচ করার আগে উদ্যোক্তাকে নিশ্চিত হতে হয়, ভবিষ্যতে নীতিগত পরিবেশ তার পক্ষে থাকবে কি না। ভারত কিংবা ভিয়েতনামের অভিজ্ঞতা এখানে গুরুত্বপূর্ণ। ভারত দুই দশক ধরে এক ধরনের স্থিতিশীল নীতির ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। ভিয়েতনাম এক দশকেরও বেশি সময় ধরে শিল্পায়ন ও রপ্তানিমুখী প্রবৃদ্ধির পথে নীতি অপরিবর্তিত রেখেছে। এর ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সেখানে নিরাপদবোধ করেছেন এবং আজ ভিয়েতনাম বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলে শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে। বাংলাদেশও চাইলে পারত, কিন্তু নীতির অস্থিরতা আমাদের বারবার পিছিয়ে দিচ্ছে।

জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের অনিশ্চয়তা উদ্যোক্তাদের আস্থা সংকটকে আরো তীব্র করেছে। এর ফলে বাংলাদেশের বাজার হারানোর ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। উদ্যোক্তাদের আস্থা সংকট শুধু অর্থনৈতিক সূচকে সীমাবদ্ধ নয়, এটি সমাজের ভেতরেও গভীর প্রভাব ফেলছে। বেকারত্ব বাড়লে সমাজে হতাশা, ক্ষোভ ও অসন্তোষ তৈরি হয়। পুরো সমাজকেই অস্থির করে তোলে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, রংপুর

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত