নদীর বুকে বিষের স্রোত

মো. শহিদুল ইসলাম
প্রকাশ : ২৪ অক্টোবর ২০২৫, ১৬: ৪২
আপডেট : ২৪ অক্টোবর ২০২৫, ১৮: ৩৬

রাজশাহীর যে শহর একসময় পদ্মা, বারনই, নবগঙ্গা, বারহী, বড়াল, শিবনদী আর অসংখ্য খাল-বিলের জলধারায় জীবন্ত ছিল, আজ সেখানে কেবল শুকিয়ে যাওয়া নদীর তলদেশ আর বিষাক্ত বর্জ্যের স্তুপ। নদী ছিল এই শহরের প্রাণ, কৃষি ও জীববৈচিত্র্যের মূল উৎস। এখন সেই নদীগুলো মৃত্যুর প্রান্তে। নগরের ড্রেন ও বর্জ্যনালার অন্তত বারোটি পয়েন্ট হয়ে প্রধান দুটি পয়েন্ট দিয়ে প্রতিদিন সরাসরি তরল বর্জ্য মিশছে নদী ও বিলে।

এই বর্জ্যের সঙ্গে মিশছে হাসপাতাল, ট্যানারি, ওয়ার্কশপ, বাজার ও গৃহস্থালির প্লাস্টিক ও রাসায়নিক পদার্থ। নবগঙ্গা, বারহী ও বারনই নদীর পানিতে আজ কোনো প্রাণ নেই; কালো, দুর্গন্ধযুক্ত পানি কেবল দূষণের প্রমাণ বহন করছে। নদীর বুকজুড়ে জমে আছে ভারী ধাতু ও প্লাস্টিকের স্তর। নদীতে আর মাছ নেই, ব্যাঙের ডাক নেই, শামুক-ঝিনুকের অস্তিতও বিলীন। বরং বাতাসে ভেসে বেড়ায় এক ধরনের বিষাক্ত গন্ধ, যা নদীপাড়ের মানুষের জীবনকে করে তুলছে অস্বাস্থ্যকর ও কষ্টকর।

বিজ্ঞাপন

রাজশাহীর চারপাশের ভুগরোইল বিল, নওদাপাড়া মৌজা বিল, ঠিকইর মৌজার বিল, বিলনচর, বিলদুর্গাপুর, বিলঝিনুক, বিলকীর্তিপুর, বিলমহিষবাথানসহ অসংখ্য বিলের হাজার হাজার বিঘার জমিতে একসময় কৃষি ও জীববৈচিত্র্যে আশ্রয়স্থল ছিল। এখন সেগুলো বর্জ্যভর্তি জলাশয়ে পরিণত হয়েছে। বৃষ্টির পানি জমে থাকলেও তার সঙ্গে মিশে যায় শহরের ড্রেনের দূষিত তরল। ফলে ধান হয় না, মাছ বাঁচে না। কৃষকরা বাধ্য হয়ে জমি বিক্রিও করে দিচ্ছে। নদী ও বিলের এই মৃত্যু কেবল প্রকৃতির নয়, মানুষেরও।

এই অব্যবস্থাপনা এখন এক মানবসৃষ্ট পরিবেশ জনদুর্যোগে পরিণত হয়েছে। নদীপাড়ের হাজারো মৎস্যজীবী, মাঝি, ঘাটশ্রমিক তাদের জীবিকা হারাচ্ছে। দূষিত পানির প্রভাবে ত্বক রোগ, ডায়রিয়া ও শ্বাসকষ্টজনিত রোগ বেড়ে গেছে। নদীর তলদেশে জমে থাকা প্লাস্টিক ও রাসায়নিক পদার্থ এখন স্থানীয় পরিবেশকে মারাত্বকভাবে দূষিত করছে।

রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনে কোনো কার্যকর তরল বর্জ্য শোধনাগার ((Effluent Treatment Plant) নেই। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নীতিমালা থাকলেও বাস্তবায়নে ঘাটতি স্পষ্ট। পরিবেশ অধিদপ্তর মাঝে মাঝে অভিযান চালালেও তা সাময়িক। অপরদিকে পরিবেশ আদালত থাকলেও জনগণের সরাসরি মামলা করার সুযোগ নেই, ফলে ন্যায়বিচার অধরাই থেকে যায়। আইনি কাঠামো ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার কারণে নদী রক্ষার লড়াই বারবার স্তিমিত হয়ে পড়ছে।

তবুও আশার আলো আছে নাগরিক উদ্যোগে। রাজশাহী সবুজ সংহতি নদী ও জলাশয় রক্ষায় মাঠে নেমেছে। সংগঠনের আহ্বায়ক ও নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দীকীর নেতৃত্বে সরেজমিনে তারা চিহ্নিত করেছেন শহরের সেই বারোটি পয়েন্ট, যেখান থেকে সরাসরি তরল বর্জ্য নদীতে পড়ে। সংগঠনের দাবি, অবিলম্বে আধুনিক শোধনাগার স্থাপন করতে হবে, নগরকে প্লাস্টিকমুক্ত করতে হবে, নবগঙ্গা, বারহী ও বারনই নদীর প্রবাহ পুনরুদ্ধার করতে হবে এবং নদী-বিলের ঐতিহাসিক মানচিত্র সংরক্ষণ করতে হবে। পাশাপাশি নাগরিক পর্যায়ে নদীভিত্তিক পরিবেশ শিক্ষা ও জনসচেতনতা কার্যক্রম চালু করাও জরুরি।

শুকনো নদীর কান্না কেবল পানির শোক নয়, এটি জীবনের শোক। নদী হারালে হারিয়ে যায় মাটি, ফসল, সংস্কৃতি, এমনকি আমাদের অস্তিত্বও। রাজশাহী শহর এবং এর আশপাশের জনপদকে টিকিয়ে রাখতে হলে প্রথমেই ফিরিয়ে আনতে হবে নদীর প্রবাহ, থামাতে হবে দূষণের স্রোত। নদী বাঁচলে তবেই রাজশাহী বাঁচবে, বাঁচবে আশপাশের জনপদ ও প্রাণবৈচিত্র্য, এটাই সময়ের সবচেয়ে বড় সত্য।

লেখক: নৃবিজ্ঞানী ও পরিবেশ আইন গবেষক, বারসিক

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত