জামাল কাঞ্জ
ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার সংঘাত কিংবা তাইওয়ানের ওপর চীনের দাবি নিয়ে যে উত্তেজনাÑএ দুটো ঘটনার সঙ্গে ইরানের পরমাণু স্থাপনায় আমেরিকার হামলার কোনোই মিল নেই। কারণ ইরান ও আমেরিকা তাদের জাতীয় কোনো ইস্যু নিয়ে যুদ্ধে জড়ায়নি। বরং ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং আমেরিকা তার ইহুদি লবি গ্রুপ আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি (আইপ্যাক) ইসরাইলের যুদ্ধকে কৌশলে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে। আমেরিকা কার্যত ইসরাইলের যুদ্ধের সাব-কন্ট্রাক্ট নিয়ে ইরানে আক্রমণ করেছে। আর এর মাধ্যমে ট্রাম্প নিজেকে ইসরাইলের স্বার্থ হাসিলের একজন আদর্শ সাব-কন্ট্রাক্টরে পরিণত করেছেন।
নেতানিয়াহু কয়েক দশক ধরেই আমেরিকান রাজনীতিকে ম্যানিপুলেট করে তার নিজের স্বার্থ হাসিল করেছেন খুব চমৎকারভাবে। ২০০২ সালে তিনি মার্কিন কংগ্রেসকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, ‘আমি আপনাদের গ্যারান্টি’ দিয়ে বলতে পারি, আপনারা সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করলে, ইরানের নতুন প্রজন্মও তাদের দেশের ধর্মীয় নেতাদের ক্ষমতা থেকে ছুড়ে ফেলবে। কিন্তু ইরাকে সরকার পরিবর্তনের পর দেশটিকে চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, অন্যদিকে ইরানে সরকারের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান শুরুর কোনো লক্ষণই দেখা যায়নি।
এর ২৩ বছর পর ২০২৫ সালে এসে নেতানিয়াহু ‘মধ্যপ্রাচ্যের চেহারা বদলে দিতে’ তার উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য আবার আমেরিকাকে যুদ্ধে জড়াতে সফল হন। এভাবে প্রতিবারই আমেরিকা ইসরাইলের হয়ে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। আর এর ফলে পুরো অঞ্চলেই দেখা দেয় আতঙ্ক, ছড়িয়ে পড়ে বিশৃঙ্খলা। আর এটার জের ধরে জোরদার করা হয় ইসরাইলের নিরাপত্তা। অন্যদিকে, মধ্যপ্রাচ্যের ব্যর্থ রাষ্ট্রগুলো বারবারই ইসরাইলের আঞ্চলিক আধিপত্য ও শ্রেষ্ঠত্বকে চ্যালেঞ্জ জানাতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়।
এবারের ইরান-ইসরাইল যুদ্ধে আকস্মিক অস্ত্রবিরতির পর পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে আসছে। এটা এখন স্পষ্ট হয়ে আসছে, ইরানে ইসরাইলের হামলার মূল উদ্দেশ্য মধ্যপ্রাচ্যে পরমাণু শক্তির অধিকারী হতে চাওয়া প্রতিদ্বন্দ্বী ইরানকে থামানো নয়। বরং ইসরাইলের হামলার মূল উদ্দেশ্য ছিল পুরো মধ্যপ্রাচ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, ইরানে সরকারের পরিবর্তন ঘটানো এবং মধ্যপ্রাচ্যকে চিরদিনের জন্য বিভক্ত করে নিজের সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব নিশ্চিত করা। এই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ইসরাইলের নীতির কোনো বাই-প্রোডাক্ট বা উপজাত নয়, বরং এটাই হচ্ছে ইসরাইলের মূলনীতি। নৈরাজ্য সৃষ্টি করে নিজের স্বার্থ হাসিল করাই হচ্ছে ইসরাইলের কৌশল। এটাই হচ্ছে ইহুদি বর্ণবাদী দেশটির কাজের একটি মডেল।
মধ্যপ্রাচ্যকে অস্থিতিশীল করে রাখার পরিকল্পিত ইহুদি চক্রান্তের বিষয়টি প্রথম উঠে আসে ১৯৮২ সালে হিব্রু ভাষায় প্রকাশিত ওয়াইনোন পরিকল্পনায়। ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধ সম্পর্কে বিশ্বের দৃষ্টিকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতেই এই কৌশল নেওয়া হয়। বর্তমানে গাজার গণহত্যা, অধিকৃত পশ্চিমতীরের দখলদারিত্ব, ইহুদি বসতি সম্প্রসারণ ও দেশটির বর্ণবাদী শাসনকে আড়াল করতেও ব্যবহার করা হচ্ছে এই কৌশলই।
ওয়াইনোন পরিকল্পনা অনুযায়ী, মধ্যপ্রাচ্যে অব্যাহতভাবে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে রাখা হলে তার মাধ্যমে ‘ইসরাইলের অস্তিত্ব হুমকির মুখে’ দেশটির এই বয়ানের ভিত্তিকে শক্তিশালী করবে। আমেরিকান নীতিনির্ধারকরাও ইসরাইলের এই বয়ানকে লুফে নিচ্ছে। তারা মধ্যপ্রাচ্যে তাদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র ও এই অঞ্চলে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা এই দেশটির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রতিবছর আমেরিকান করদাতাদের শত শত কোটি ডলারের সামরিক ও আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে তেল আবিবকে। এই অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যে ‘বিরামহীন যুদ্ধে’ নিয়োজিত রয়েছে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অজুহাতে।
ইসরাইলের প্রতিবেশী ব্যর্থ রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বিরোধ-বিভাজন, গৃহযুদ্ধ, অর্থনীতি ভেঙে পড়া অথবা গোষ্ঠীগত সহিংসতায় জর্জরিত থাকার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো তাদের খবরের শিরোনামকে ইসরাইলের নৃশংসতা থেকে আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে যায়। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ইসরাইল নিজেকে দায়মুক্ত করে এবং ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার করুণ চিত্রগুলো চাপা পড়ে যায়। ইসরাইল যে তার রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবেই ফিলিস্তিনিদের হত্যা ও উচ্ছেদ করছে তা আর বিশেষ গুরুত্ব পায় না আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে। বরং ফিলিস্তিনিদের সম্পর্কে তখন বলা হয়, তারা ‘দুর্ভাগ্যজনক’ পরিস্থিতির শিকার।
কাজেই, লেবানন, সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, সুদানে দীর্ঘদিনের গৃহযুদ্ধ ও এবং বর্তমানে ইরানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টার মূল লক্ষ্যই হলো এই অঞ্চলের দেশগুলো যাতে ঐক্যবদ্ধ থেকে ইসরাইলের আঞ্চলিক আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাতে না পারে। এটা ইসরাইলের রাষ্ট্রীয় কৌশল। একটি ছত্রভঙ্গ মধ্যপ্রাচ্যকে নিজের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা ইসরাইলের জন্য খুবই সহজ এবং একই সঙ্গে বিশ্বও এ ধরনের একটি অঞ্চলকে গুরুত্ব না দিয়ে বরং অবজ্ঞার চোখেই দেখবে।
উদাহরণ হিসেবে এখানে গাজার বর্তমান অবস্থার কথা বলা যায়। বিশ্ব গাজার গণহত্যাকে এই অঞ্চলের দীর্ঘদিনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি ও সংঘাতেরই আরেকটি পর্ব হিসেবে দেখছে। তারা খুব স্বাভাবিকভাবেই ইসরাইলি বর্বরতাকে চলতে দিচ্ছে। বিশেষ করে ট্রাম্প প্রশাসন গাজার ফিলিস্তিনিদের খাদ্য থেকে বঞ্চিত রাখা এবং গণহত্যাকে খুবই স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেছে।
আমেরিকার অর্থায়নে তৈরি গাজার তথাকথিত ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রগুলো একেকটি কিলিং জোনে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিনই এসব ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে শতাধিক ফিলিস্তিনিকে গুলি করে হত্যা করছে ইসরাইল সেনারা। ত্রাণ নিতে আসা ফিলিস্তিনিরা ত্রাণের পরিবর্তে স্বজনদের লাশ কাঁধে নিয়ে তাঁবুতে ফিরছেন। আর এসব দৃশ্য, এসব হত্যাকাণ্ড ইসরাইলি যুদ্ধের ডামাডোলে হারিয়ে যাচ্ছে। এই গণহত্যাকে বিশ্ব মোটেও গুরুত্ব দিচ্ছে না। নেতানিয়াহু গাজায় তার এই গণহত্যাকে অব্যাহত রাখতে নতুন কোনো অজুহাত তৈরি করতে পারেন। আর এর মাধ্যমে তিনি আরেকটি ‘সাফল্য’ অর্জন করতে পারেন ইসরাইলের যুদ্ধে আমেরিকাকে জড়ানোর মাধ্যমে।
কিন্তু ইসরাইলের যুদ্ধে আমেরিকাকে জড়ানোর নেতানিয়াহুর এই কৌশলের বিরুদ্ধে মার্কিন জনগণের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মার্কিনি ইসরাইলের যুদ্ধে আমেরিকার জড়িয়ে পড়ার তীব্র বিরোধিতা করছেন। আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি (আইপ্যাক)-নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী এলিট ও জনমতের মধ্যে মতপার্থক্য দিন দিনই বাড়ছে। ইহুদিদের নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও তাদের নীতিনির্ধারকদের পক্ষপাতমূলক সিদ্ধান্তের কারণে এদের ওপর আস্থা ও বিশ্বাস হারাচ্ছেন সাধারণ মার্কিনিরা।
ইরানে আমেরিকার সাম্প্রতিক হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইরানি নেতারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়িয়ে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন। তার একটি আভাসও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ইতোমধ্যেই। রাশিয়া ও চীনের সমর্থনে ইরানের উদ্যোগে নতুন একটি জোট গড়ে ওঠার পথ তৈরি হচ্ছে। আগামী দশকগুলোয় এটা আরো জোরদার হয় উঠতে পারে।
আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে ইরানের পরমাণু কর্মসূচিতে ইসরাইলের হামলার নিন্দা জানাতে অনেক দেশই বিরত ছিল। আমেরিকাসহ এসব দেশ বরং একই সুরে ‘ইরানকে পরমাণু বোমা’র অধিকারী হওয়ার পথ ছাড়তে হবে বলে আওয়াজ তোলে। অথচ আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) ইরানের পরমাণু কর্মসূচির পরিদর্শন অব্যাহত রেখেছে বছরের পর বছর ধরে। কিন্তু ইসরাইলের পরমাণু অস্ত্র নিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব ও আইএইএ টুঁ শব্দটিও করে না। এটা আইএইএর বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এ ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে ইরান তার পরমাণু স্থাপনায় আইএইএকে পরিদর্শনের অনুমতি আর নাও দিতে পারে।
ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি শুরু করলে দেশটিতে আবার হামলা করা হবে বলে হুমকি দিয়েছেন ট্রাম্প। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমেরিকা আর কতদিন এভাবে ইসরাইলের যুদ্ধের সাব-কন্ট্রাক্ট নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় হামলা চালাবে? বিশ্লেষকরা মনে করেন, সামগ্রিক এই পরিস্থিতিতে ট্রাম্প ইসরাইলের রক্ষাকর্তা হয়ে বরং ইরানকে পরমাণু বোমা তৈরির দিকে ঠেলে দেওয়ার কারিগর হিসেবেই বিবেচিত হতে পারেন।
লেখক : ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত মার্কিন সাংবাদিক ও লেখক
মিডল ইস্ট মনিটর থেকে অনুবাদ : মোতালেব জামালী
ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার সংঘাত কিংবা তাইওয়ানের ওপর চীনের দাবি নিয়ে যে উত্তেজনাÑএ দুটো ঘটনার সঙ্গে ইরানের পরমাণু স্থাপনায় আমেরিকার হামলার কোনোই মিল নেই। কারণ ইরান ও আমেরিকা তাদের জাতীয় কোনো ইস্যু নিয়ে যুদ্ধে জড়ায়নি। বরং ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং আমেরিকা তার ইহুদি লবি গ্রুপ আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি (আইপ্যাক) ইসরাইলের যুদ্ধকে কৌশলে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে। আমেরিকা কার্যত ইসরাইলের যুদ্ধের সাব-কন্ট্রাক্ট নিয়ে ইরানে আক্রমণ করেছে। আর এর মাধ্যমে ট্রাম্প নিজেকে ইসরাইলের স্বার্থ হাসিলের একজন আদর্শ সাব-কন্ট্রাক্টরে পরিণত করেছেন।
নেতানিয়াহু কয়েক দশক ধরেই আমেরিকান রাজনীতিকে ম্যানিপুলেট করে তার নিজের স্বার্থ হাসিল করেছেন খুব চমৎকারভাবে। ২০০২ সালে তিনি মার্কিন কংগ্রেসকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, ‘আমি আপনাদের গ্যারান্টি’ দিয়ে বলতে পারি, আপনারা সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করলে, ইরানের নতুন প্রজন্মও তাদের দেশের ধর্মীয় নেতাদের ক্ষমতা থেকে ছুড়ে ফেলবে। কিন্তু ইরাকে সরকার পরিবর্তনের পর দেশটিকে চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, অন্যদিকে ইরানে সরকারের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান শুরুর কোনো লক্ষণই দেখা যায়নি।
এর ২৩ বছর পর ২০২৫ সালে এসে নেতানিয়াহু ‘মধ্যপ্রাচ্যের চেহারা বদলে দিতে’ তার উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য আবার আমেরিকাকে যুদ্ধে জড়াতে সফল হন। এভাবে প্রতিবারই আমেরিকা ইসরাইলের হয়ে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। আর এর ফলে পুরো অঞ্চলেই দেখা দেয় আতঙ্ক, ছড়িয়ে পড়ে বিশৃঙ্খলা। আর এটার জের ধরে জোরদার করা হয় ইসরাইলের নিরাপত্তা। অন্যদিকে, মধ্যপ্রাচ্যের ব্যর্থ রাষ্ট্রগুলো বারবারই ইসরাইলের আঞ্চলিক আধিপত্য ও শ্রেষ্ঠত্বকে চ্যালেঞ্জ জানাতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়।
এবারের ইরান-ইসরাইল যুদ্ধে আকস্মিক অস্ত্রবিরতির পর পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে আসছে। এটা এখন স্পষ্ট হয়ে আসছে, ইরানে ইসরাইলের হামলার মূল উদ্দেশ্য মধ্যপ্রাচ্যে পরমাণু শক্তির অধিকারী হতে চাওয়া প্রতিদ্বন্দ্বী ইরানকে থামানো নয়। বরং ইসরাইলের হামলার মূল উদ্দেশ্য ছিল পুরো মধ্যপ্রাচ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, ইরানে সরকারের পরিবর্তন ঘটানো এবং মধ্যপ্রাচ্যকে চিরদিনের জন্য বিভক্ত করে নিজের সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব নিশ্চিত করা। এই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ইসরাইলের নীতির কোনো বাই-প্রোডাক্ট বা উপজাত নয়, বরং এটাই হচ্ছে ইসরাইলের মূলনীতি। নৈরাজ্য সৃষ্টি করে নিজের স্বার্থ হাসিল করাই হচ্ছে ইসরাইলের কৌশল। এটাই হচ্ছে ইহুদি বর্ণবাদী দেশটির কাজের একটি মডেল।
মধ্যপ্রাচ্যকে অস্থিতিশীল করে রাখার পরিকল্পিত ইহুদি চক্রান্তের বিষয়টি প্রথম উঠে আসে ১৯৮২ সালে হিব্রু ভাষায় প্রকাশিত ওয়াইনোন পরিকল্পনায়। ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধ সম্পর্কে বিশ্বের দৃষ্টিকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতেই এই কৌশল নেওয়া হয়। বর্তমানে গাজার গণহত্যা, অধিকৃত পশ্চিমতীরের দখলদারিত্ব, ইহুদি বসতি সম্প্রসারণ ও দেশটির বর্ণবাদী শাসনকে আড়াল করতেও ব্যবহার করা হচ্ছে এই কৌশলই।
ওয়াইনোন পরিকল্পনা অনুযায়ী, মধ্যপ্রাচ্যে অব্যাহতভাবে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে রাখা হলে তার মাধ্যমে ‘ইসরাইলের অস্তিত্ব হুমকির মুখে’ দেশটির এই বয়ানের ভিত্তিকে শক্তিশালী করবে। আমেরিকান নীতিনির্ধারকরাও ইসরাইলের এই বয়ানকে লুফে নিচ্ছে। তারা মধ্যপ্রাচ্যে তাদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র ও এই অঞ্চলে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা এই দেশটির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রতিবছর আমেরিকান করদাতাদের শত শত কোটি ডলারের সামরিক ও আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে তেল আবিবকে। এই অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যে ‘বিরামহীন যুদ্ধে’ নিয়োজিত রয়েছে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অজুহাতে।
ইসরাইলের প্রতিবেশী ব্যর্থ রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বিরোধ-বিভাজন, গৃহযুদ্ধ, অর্থনীতি ভেঙে পড়া অথবা গোষ্ঠীগত সহিংসতায় জর্জরিত থাকার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো তাদের খবরের শিরোনামকে ইসরাইলের নৃশংসতা থেকে আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে যায়। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ইসরাইল নিজেকে দায়মুক্ত করে এবং ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার করুণ চিত্রগুলো চাপা পড়ে যায়। ইসরাইল যে তার রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবেই ফিলিস্তিনিদের হত্যা ও উচ্ছেদ করছে তা আর বিশেষ গুরুত্ব পায় না আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে। বরং ফিলিস্তিনিদের সম্পর্কে তখন বলা হয়, তারা ‘দুর্ভাগ্যজনক’ পরিস্থিতির শিকার।
কাজেই, লেবানন, সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, সুদানে দীর্ঘদিনের গৃহযুদ্ধ ও এবং বর্তমানে ইরানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টার মূল লক্ষ্যই হলো এই অঞ্চলের দেশগুলো যাতে ঐক্যবদ্ধ থেকে ইসরাইলের আঞ্চলিক আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাতে না পারে। এটা ইসরাইলের রাষ্ট্রীয় কৌশল। একটি ছত্রভঙ্গ মধ্যপ্রাচ্যকে নিজের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা ইসরাইলের জন্য খুবই সহজ এবং একই সঙ্গে বিশ্বও এ ধরনের একটি অঞ্চলকে গুরুত্ব না দিয়ে বরং অবজ্ঞার চোখেই দেখবে।
উদাহরণ হিসেবে এখানে গাজার বর্তমান অবস্থার কথা বলা যায়। বিশ্ব গাজার গণহত্যাকে এই অঞ্চলের দীর্ঘদিনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি ও সংঘাতেরই আরেকটি পর্ব হিসেবে দেখছে। তারা খুব স্বাভাবিকভাবেই ইসরাইলি বর্বরতাকে চলতে দিচ্ছে। বিশেষ করে ট্রাম্প প্রশাসন গাজার ফিলিস্তিনিদের খাদ্য থেকে বঞ্চিত রাখা এবং গণহত্যাকে খুবই স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেছে।
আমেরিকার অর্থায়নে তৈরি গাজার তথাকথিত ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রগুলো একেকটি কিলিং জোনে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিনই এসব ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে শতাধিক ফিলিস্তিনিকে গুলি করে হত্যা করছে ইসরাইল সেনারা। ত্রাণ নিতে আসা ফিলিস্তিনিরা ত্রাণের পরিবর্তে স্বজনদের লাশ কাঁধে নিয়ে তাঁবুতে ফিরছেন। আর এসব দৃশ্য, এসব হত্যাকাণ্ড ইসরাইলি যুদ্ধের ডামাডোলে হারিয়ে যাচ্ছে। এই গণহত্যাকে বিশ্ব মোটেও গুরুত্ব দিচ্ছে না। নেতানিয়াহু গাজায় তার এই গণহত্যাকে অব্যাহত রাখতে নতুন কোনো অজুহাত তৈরি করতে পারেন। আর এর মাধ্যমে তিনি আরেকটি ‘সাফল্য’ অর্জন করতে পারেন ইসরাইলের যুদ্ধে আমেরিকাকে জড়ানোর মাধ্যমে।
কিন্তু ইসরাইলের যুদ্ধে আমেরিকাকে জড়ানোর নেতানিয়াহুর এই কৌশলের বিরুদ্ধে মার্কিন জনগণের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মার্কিনি ইসরাইলের যুদ্ধে আমেরিকার জড়িয়ে পড়ার তীব্র বিরোধিতা করছেন। আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি (আইপ্যাক)-নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী এলিট ও জনমতের মধ্যে মতপার্থক্য দিন দিনই বাড়ছে। ইহুদিদের নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও তাদের নীতিনির্ধারকদের পক্ষপাতমূলক সিদ্ধান্তের কারণে এদের ওপর আস্থা ও বিশ্বাস হারাচ্ছেন সাধারণ মার্কিনিরা।
ইরানে আমেরিকার সাম্প্রতিক হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইরানি নেতারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়িয়ে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন। তার একটি আভাসও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ইতোমধ্যেই। রাশিয়া ও চীনের সমর্থনে ইরানের উদ্যোগে নতুন একটি জোট গড়ে ওঠার পথ তৈরি হচ্ছে। আগামী দশকগুলোয় এটা আরো জোরদার হয় উঠতে পারে।
আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে ইরানের পরমাণু কর্মসূচিতে ইসরাইলের হামলার নিন্দা জানাতে অনেক দেশই বিরত ছিল। আমেরিকাসহ এসব দেশ বরং একই সুরে ‘ইরানকে পরমাণু বোমা’র অধিকারী হওয়ার পথ ছাড়তে হবে বলে আওয়াজ তোলে। অথচ আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) ইরানের পরমাণু কর্মসূচির পরিদর্শন অব্যাহত রেখেছে বছরের পর বছর ধরে। কিন্তু ইসরাইলের পরমাণু অস্ত্র নিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব ও আইএইএ টুঁ শব্দটিও করে না। এটা আইএইএর বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এ ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে ইরান তার পরমাণু স্থাপনায় আইএইএকে পরিদর্শনের অনুমতি আর নাও দিতে পারে।
ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি শুরু করলে দেশটিতে আবার হামলা করা হবে বলে হুমকি দিয়েছেন ট্রাম্প। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমেরিকা আর কতদিন এভাবে ইসরাইলের যুদ্ধের সাব-কন্ট্রাক্ট নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় হামলা চালাবে? বিশ্লেষকরা মনে করেন, সামগ্রিক এই পরিস্থিতিতে ট্রাম্প ইসরাইলের রক্ষাকর্তা হয়ে বরং ইরানকে পরমাণু বোমা তৈরির দিকে ঠেলে দেওয়ার কারিগর হিসেবেই বিবেচিত হতে পারেন।
লেখক : ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত মার্কিন সাংবাদিক ও লেখক
মিডল ইস্ট মনিটর থেকে অনুবাদ : মোতালেব জামালী
এই বছর অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে উদ্ভাবন ও সৃজনশীল ধ্বংসের প্রক্রিয়া (creative destruction) কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে সেই গবেষণার ওপর। নতুন প্রযুক্তি ও ধারণা পুরোনো ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন করে সমাজ যখন পরিবর্তনের জন্য উন্মুক্ত থাকে, তখনই টেক
১৮ ঘণ্টা আগে‘মনের তালা খুলল কে, চাবিওয়ালা, চাবিওয়ালা!’ প্রখ্যাত শিল্পী রুনা লায়লার সেই সুরেলা প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে বেড়াচ্ছি! তবে ব্যক্তিগত জীবনে নয়, রাষ্ট্রীয় জীবনে। এই রাষ্ট্রের জীবনেও একটা বিশেষ তালা আছে, আর তার নাম আর্টিকেল ৭০! এই তালা লাগানো হয়েছিল সেই সব মাননীয়র জন্য, যাদের মধ্যে ‘ছাগলীয়’ প্রবৃত্তি রয়ে
১৮ ঘণ্টা আগেভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে প্রায়ই তার পরম বন্ধু বলে বেশ গৌরবের সঙ্গে প্রচার করে থাকেন। ভিন্ন দেশের এ দুই রাজনীতিবিদের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের মূল সূত্র হলো মুসলমানদের প্রতি তাদের তীব্র ঘৃণা। বর্তমান বিশ্বে ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত শীর্ষ দুটি
১৮ ঘণ্টা আগেগাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন হতাশা চরমে, তখনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন এক নতুন ‘২০ দফার শান্তি পরিকল্পনা’। সেখানে তিনি নিজেকে বসিয়েছেন একটি তথাকথিত ‘বোর্ড অব পিস’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে।
২ দিন আগে