ভূঁইয়া শফি
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সন্ত্রাস, মাদক, চোরাচালানসহ নানা অপরাধ দমন ও জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ আইন রয়েছে। ব্যতিক্রম নয় আমাদের বাংলাদেশও। বাংলাদেশ পুলিশেরও রয়েছে বিশেষ ক্ষমতা আইন। তবে বাংলাদেশ পুলিশের ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন (পিএসএ) একটি বিতর্কিত আইন। আইনটি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে আসছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো।
পুলিশের বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪ (Police Special Powers Act, 1974) এমন একটি আইন, যা পুলিশকে কিছু বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করার সুযোগ দিয়েছে। এই আইনে পুলিশ বিশেষ পরিস্থিতিতে আক্রমণ, দমন-পীড়ন এবং গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেপ্তার ও অনুসন্ধানের জন্য অধিকতর ক্ষমতা পেয়ে থাকে। সন্ত্রাস, অরাজকতা, অবৈধ অস্ত্র ব্যবহারসহ বিপজ্জনক অপরাধ দমনের লক্ষ্যে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে পুলিশের এ বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রণয়ন করা হয়, বিশেষ করে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দমন, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে। তবে আইনটি অনেক সময় মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের সম্মুখীন হয়। এ আইনে পুলিশকে গ্রেপ্তার ও তদন্তের ক্ষেত্রে অনেক বেশি ক্ষমতা এবং স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। এতে করে অনেক সময় নিরীহ মানুষও আইনি ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে এবং নিরপরাধ ব্যক্তিও শাস্তির সম্মুখীন হয়।
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দাবি, ‘পুলিশের বিশেষ ক্ষমতা আইন মানবাধিকার লঙ্ঘনের সবচেয়ে বড় দ্বার।’ একই অভিযোগ তুলেছে সরকারের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও। বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক দলগুলোর অভিযোগ—‘বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনে পুলিশের বিশেষ ক্ষমতা আইনের অপব্যবহার করা হয়েছে।’ আইনটিকে অনেকেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করেন।
এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে আইনের অপব্যবহার ও অব্যবস্থাপনার জন্য সমালোচিত হয়েছে আইনটি। বিশেষ ক্ষমতায় আইনে পুলিশ সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেপ্তার করতে পারে, যেকোনো জায়গায় অভিযান চালাতে পারে এবং আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে কিছু বিশেষ পদক্ষেপ নিতে পারে। কিন্তু অনেক সময় এই ক্ষমতা ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে ব্যবহৃত হয়। এর ফলে সাধারণ মানুষের আইনি অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়। বিশেষত প্রতিবাদী বা রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর এই আইনের অপব্যবহার বেশি হয়ে থাকে। গ্রেপ্তার, অত্যাচার, অযথা হেনস্তা এবং অবিচারের শিকার হন নিরীহ মানুষ। এ ধরনের পরিস্থিতি সমাজে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি করে এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রতি মানুষের আস্থা কমিয়ে দেয়।
বড় সমস্যা হলো, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই এ আইনের আওতায় পুলিশ যেকোনো ব্যক্তিকে যেকোনো সময় গ্রেপ্তার করতে পারে এবং তাকে আদিষ্ট কালের জন্য আটক করে রাখতে পারে। এক্ষেত্রে অধিকাংশ সময় গ্রেপ্তার বা হেনস্তা করা হয় যথাযথ প্রমাণ ছাড়াই । অনেক সময় এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্যও ব্যবহৃত হয়, যেখানে বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যদের বা সমালোচকদের নিপীড়িত করা হয়। এই পরিস্থিতি জনমনে গভীর হতাশা ও ক্ষোভ সৃষ্টি করে, যা দেশের সার্বিক গণতান্ত্রিক পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। সুতরাং, পুলিশের বিশেষ ক্ষমতা আইনের অপব্যবহার একটি গভীর ও সুদূরপ্রসারী সমস্যা, যা সমাজের প্রতিটি স্তরে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলত পারে। বিশেষ ক্ষমতার আওতায় অনেক সময় ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘এনকাউন্টার’ ঘটায় পুলিশ। বিষয়টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ সৃষ্টি করে।
এ ছাড়া এই আইনটি রাজনীতির মাঠেও রাজনৈতিক নিপীড়নের এক গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। শাসকদলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া রাজনৈতিকভাবে বিরোধীদের দমন করতে বিশেষ ক্ষমতা আইনের অপব্যবহার করা হয়েছে এবং তা অব্যাহত রয়েছে। সরকারের সমালোচকদের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী অস্ত্র হয়ে দাঁড়ায় আইনটি, যার মাধ্যমে বিরোধীদের ভয় দেখানো, আটক করা এবং তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে বাধা দেওয়া যায় খুব সহজেই। অনেক সময় আইনটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের অভিপ্রায়ে ব্যবহৃত হয়। এতে দেশে গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা ও রাজনৈতিক মুক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বাংলাদেশের একটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিগত ১৫ বছরে পতিত আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ১৪ লাখ দুই হাজার ৮২৫টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এতে সারাদেশের ৫০ লাখ ৩২ হাজার ৬৫৫ জনের বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিশেষ করে নির্বাচন প্রস্তুতিকালে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে পুলিশ বিএনপি-জামায়াত ও সমমনা দলগুলোকে দমনের লক্ষ্যে এ মামলাগুলো দায়ের করে। মামলার এজাহারে বিভিন্ন সময় বিদেশে গমনকারী প্রবাসী ও মৃত ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে। এ নিয়ে নানামুখী আলোচনা-সমালোচনা ও হাস্যরস হয়েছে গণমাধ্যম, পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশন টকশোতে। ওই সরকারের নির্দেশে বিভিন্ন সময়ে বিএনপি-জামায়াত ও সমমনা দলগুলোর বিভিন্ন কর্মসূচিতে পুলিশ বিভিন্নভাবে বাধা সৃষ্টি করেছে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কর্মসূচি থেকে নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করে পুলিশের বিশেষ ক্ষমতা আইনে মিথ্যা মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। অনেক ক্ষেত্রে বিরোধী মতাবলম্বীদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি, নাশকতাসহ বিভিন্ন মিথ্যা অভিযোগ এনে মামলার এজাহার সাজিয়েছে পুলিশ। এমন ঘটনা নিয়ে গণমাধ্যমে বিভিন্ন সময় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
৫ আগস্ট ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতে পালিয়ে যায় শেখ হাসিনা। অবসান হয় আওয়ামী লীগের শাসনামলের। শেখ হাসিনা পলায়নের পর দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। ব্যাহত হয় পুলিশি কার্যক্রম। এরপর ছাত্রজনতার অনুরোধে সাড়া দিয়ে দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব নেন নোবেলবিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ইউনূস সরকারের নেতৃত্বে আবার স্বাভাবিক হয় দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। প্রতিষ্ঠিত হয় আইনের শাসন।
শুধু রাজনৈতিক দলগুলো নয়, অধিকারবিরোধী এই আইনটি নিয়ে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মধ্যে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। তারা মনে করে, এই আইনটি মানবাধিকার রক্ষা না করে বরং তার পরিপন্থি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোও বারবার এই আইনটির সমালোচনা করেছে এবং এর সংস্কার বা বাতিলের দাবি জানিয়েছে।
দেশে আইনের সুশাসন প্রতিষ্ঠা, সুন্দর সমাজ বিনির্মাণ ও ন্যায্য আইনি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য পুলিশি ক্ষমতা বৃদ্ধি করার বিকল্প নেই। তবে মানবাধিকার রক্ষা করাও অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশের মতো রাজনৈতিক অস্থিরতার দেশে পুলিশের বিশেষ ক্ষমতা আইন বাতিল করার সুযোগ কম। এতে করে অপরাধের প্রবণতা বেড়ে যেতে পারে। তবে এ আইনের ব্যাপারে পুনর্বিবেচনা ও সংস্কার করা যেত পারে।
সমস্যা সমাধানে কয়েকটি কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। প্রথমত, পুলিশের বিশেষ ক্ষমতা আইনের অধীনে যেকোনো ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের আগে একটি স্বচ্ছ ও ন্যায়সংগত তদন্ত প্রক্রিয়া চালু করা যেতে পারে। পুলিশ কর্মকর্তাদের উচিত, কোনো সন্দেহভাজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আগে যথাযথ প্রমাণ সংগ্রহ করা, যাতে নির্দোষ কাউকে ক্ষতিগ্রস্ত না করা হয়। তদন্ত প্রক্রিয়া যেন একেবারে নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ হয়, তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
দ্বিতীয়ত, পুলিশের ওপর একটি শক্তিশালী নজরদারি ব্যবস্থা চালু করা উচিত। এজন্য সঠিক প্রশিক্ষণ ও নিয়মিত মনিটরিং ব্যবস্থা প্রয়োজন, যাতে পুলিশ আইন প্রয়োগের সময় মানবাধিকার ও নাগরিক অধিকার লঙ্ঘন না করে। স্বাধীন সংস্থার মাধ্যমে পুলিশের কার্যক্রমের নিয়মিত পর্যালোচনা করা গেলে বিশেষ ক্ষমতা আইনের অপব্যবহার কমানো সম্ভব হবে।
তৃতীয়ত, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে দমনের লক্ষ্যে এ আইনের অপব্যবহার যাতে না করা হয়, সেদিকে সতর্কতা বৃদ্ধি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে পুলিশকে অধিকতর সচেতন হতে হবে। তবে সরকারের উদারতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত হলেই কাজটি পুলিশের জন্য সহজ হবে।
চতুর্থত, মানবাধিকার সংস্থা ও সুশীল সমাজকে একত্র করে একটি কার্যকর প্রতিবাদ ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন, যাতে তারা পুলিশের অসদাচরণ ও অপব্যবহার প্রতিরোধ করতে পারে। এছাড়া পুলিশের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে সরকার ও স্বতন্ত্র সংস্থাগুলোর মধ্যে একটি শক্তিশালী সহযোগিতা প্রয়োজন।
পঞ্চমত, জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। তাদের জানা উচিত, বিশেষ ক্ষমতা আইনের আওতায় তাদের অধিকার কী এবং অবিচারের ঘটনায় কীভাবে তারা আইনগত প্রতিকার পেতে পারে। এমনকি আইনের অপব্যবহারকে প্রতিরোধ করার জন্য গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
‘আইনের উদ্দেশ্য যদি সত্যিই দেশের নিরাপত্তা রক্ষা হয়। তবে তা অবশ্যই স্বচ্ছ সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এবং মানবাধিকার রক্ষা করেই হতে হবে।’
ভূঁইয়া শফি
সাংবাদিক
journalistshofiqul@gmail.com
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সন্ত্রাস, মাদক, চোরাচালানসহ নানা অপরাধ দমন ও জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ আইন রয়েছে। ব্যতিক্রম নয় আমাদের বাংলাদেশও। বাংলাদেশ পুলিশেরও রয়েছে বিশেষ ক্ষমতা আইন। তবে বাংলাদেশ পুলিশের ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন (পিএসএ) একটি বিতর্কিত আইন। আইনটি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে আসছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো।
পুলিশের বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪ (Police Special Powers Act, 1974) এমন একটি আইন, যা পুলিশকে কিছু বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করার সুযোগ দিয়েছে। এই আইনে পুলিশ বিশেষ পরিস্থিতিতে আক্রমণ, দমন-পীড়ন এবং গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেপ্তার ও অনুসন্ধানের জন্য অধিকতর ক্ষমতা পেয়ে থাকে। সন্ত্রাস, অরাজকতা, অবৈধ অস্ত্র ব্যবহারসহ বিপজ্জনক অপরাধ দমনের লক্ষ্যে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে পুলিশের এ বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রণয়ন করা হয়, বিশেষ করে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দমন, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে। তবে আইনটি অনেক সময় মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের সম্মুখীন হয়। এ আইনে পুলিশকে গ্রেপ্তার ও তদন্তের ক্ষেত্রে অনেক বেশি ক্ষমতা এবং স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। এতে করে অনেক সময় নিরীহ মানুষও আইনি ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে এবং নিরপরাধ ব্যক্তিও শাস্তির সম্মুখীন হয়।
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দাবি, ‘পুলিশের বিশেষ ক্ষমতা আইন মানবাধিকার লঙ্ঘনের সবচেয়ে বড় দ্বার।’ একই অভিযোগ তুলেছে সরকারের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও। বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক দলগুলোর অভিযোগ—‘বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনে পুলিশের বিশেষ ক্ষমতা আইনের অপব্যবহার করা হয়েছে।’ আইনটিকে অনেকেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করেন।
এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে আইনের অপব্যবহার ও অব্যবস্থাপনার জন্য সমালোচিত হয়েছে আইনটি। বিশেষ ক্ষমতায় আইনে পুলিশ সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেপ্তার করতে পারে, যেকোনো জায়গায় অভিযান চালাতে পারে এবং আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে কিছু বিশেষ পদক্ষেপ নিতে পারে। কিন্তু অনেক সময় এই ক্ষমতা ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে ব্যবহৃত হয়। এর ফলে সাধারণ মানুষের আইনি অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়। বিশেষত প্রতিবাদী বা রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর এই আইনের অপব্যবহার বেশি হয়ে থাকে। গ্রেপ্তার, অত্যাচার, অযথা হেনস্তা এবং অবিচারের শিকার হন নিরীহ মানুষ। এ ধরনের পরিস্থিতি সমাজে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি করে এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রতি মানুষের আস্থা কমিয়ে দেয়।
বড় সমস্যা হলো, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই এ আইনের আওতায় পুলিশ যেকোনো ব্যক্তিকে যেকোনো সময় গ্রেপ্তার করতে পারে এবং তাকে আদিষ্ট কালের জন্য আটক করে রাখতে পারে। এক্ষেত্রে অধিকাংশ সময় গ্রেপ্তার বা হেনস্তা করা হয় যথাযথ প্রমাণ ছাড়াই । অনেক সময় এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্যও ব্যবহৃত হয়, যেখানে বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যদের বা সমালোচকদের নিপীড়িত করা হয়। এই পরিস্থিতি জনমনে গভীর হতাশা ও ক্ষোভ সৃষ্টি করে, যা দেশের সার্বিক গণতান্ত্রিক পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। সুতরাং, পুলিশের বিশেষ ক্ষমতা আইনের অপব্যবহার একটি গভীর ও সুদূরপ্রসারী সমস্যা, যা সমাজের প্রতিটি স্তরে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলত পারে। বিশেষ ক্ষমতার আওতায় অনেক সময় ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘এনকাউন্টার’ ঘটায় পুলিশ। বিষয়টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ সৃষ্টি করে।
এ ছাড়া এই আইনটি রাজনীতির মাঠেও রাজনৈতিক নিপীড়নের এক গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। শাসকদলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া রাজনৈতিকভাবে বিরোধীদের দমন করতে বিশেষ ক্ষমতা আইনের অপব্যবহার করা হয়েছে এবং তা অব্যাহত রয়েছে। সরকারের সমালোচকদের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী অস্ত্র হয়ে দাঁড়ায় আইনটি, যার মাধ্যমে বিরোধীদের ভয় দেখানো, আটক করা এবং তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে বাধা দেওয়া যায় খুব সহজেই। অনেক সময় আইনটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের অভিপ্রায়ে ব্যবহৃত হয়। এতে দেশে গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা ও রাজনৈতিক মুক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বাংলাদেশের একটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিগত ১৫ বছরে পতিত আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ১৪ লাখ দুই হাজার ৮২৫টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এতে সারাদেশের ৫০ লাখ ৩২ হাজার ৬৫৫ জনের বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিশেষ করে নির্বাচন প্রস্তুতিকালে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে পুলিশ বিএনপি-জামায়াত ও সমমনা দলগুলোকে দমনের লক্ষ্যে এ মামলাগুলো দায়ের করে। মামলার এজাহারে বিভিন্ন সময় বিদেশে গমনকারী প্রবাসী ও মৃত ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে। এ নিয়ে নানামুখী আলোচনা-সমালোচনা ও হাস্যরস হয়েছে গণমাধ্যম, পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশন টকশোতে। ওই সরকারের নির্দেশে বিভিন্ন সময়ে বিএনপি-জামায়াত ও সমমনা দলগুলোর বিভিন্ন কর্মসূচিতে পুলিশ বিভিন্নভাবে বাধা সৃষ্টি করেছে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কর্মসূচি থেকে নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করে পুলিশের বিশেষ ক্ষমতা আইনে মিথ্যা মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। অনেক ক্ষেত্রে বিরোধী মতাবলম্বীদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি, নাশকতাসহ বিভিন্ন মিথ্যা অভিযোগ এনে মামলার এজাহার সাজিয়েছে পুলিশ। এমন ঘটনা নিয়ে গণমাধ্যমে বিভিন্ন সময় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
৫ আগস্ট ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতে পালিয়ে যায় শেখ হাসিনা। অবসান হয় আওয়ামী লীগের শাসনামলের। শেখ হাসিনা পলায়নের পর দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। ব্যাহত হয় পুলিশি কার্যক্রম। এরপর ছাত্রজনতার অনুরোধে সাড়া দিয়ে দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব নেন নোবেলবিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ইউনূস সরকারের নেতৃত্বে আবার স্বাভাবিক হয় দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। প্রতিষ্ঠিত হয় আইনের শাসন।
শুধু রাজনৈতিক দলগুলো নয়, অধিকারবিরোধী এই আইনটি নিয়ে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মধ্যে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। তারা মনে করে, এই আইনটি মানবাধিকার রক্ষা না করে বরং তার পরিপন্থি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোও বারবার এই আইনটির সমালোচনা করেছে এবং এর সংস্কার বা বাতিলের দাবি জানিয়েছে।
দেশে আইনের সুশাসন প্রতিষ্ঠা, সুন্দর সমাজ বিনির্মাণ ও ন্যায্য আইনি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য পুলিশি ক্ষমতা বৃদ্ধি করার বিকল্প নেই। তবে মানবাধিকার রক্ষা করাও অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশের মতো রাজনৈতিক অস্থিরতার দেশে পুলিশের বিশেষ ক্ষমতা আইন বাতিল করার সুযোগ কম। এতে করে অপরাধের প্রবণতা বেড়ে যেতে পারে। তবে এ আইনের ব্যাপারে পুনর্বিবেচনা ও সংস্কার করা যেত পারে।
সমস্যা সমাধানে কয়েকটি কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। প্রথমত, পুলিশের বিশেষ ক্ষমতা আইনের অধীনে যেকোনো ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের আগে একটি স্বচ্ছ ও ন্যায়সংগত তদন্ত প্রক্রিয়া চালু করা যেতে পারে। পুলিশ কর্মকর্তাদের উচিত, কোনো সন্দেহভাজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আগে যথাযথ প্রমাণ সংগ্রহ করা, যাতে নির্দোষ কাউকে ক্ষতিগ্রস্ত না করা হয়। তদন্ত প্রক্রিয়া যেন একেবারে নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ হয়, তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
দ্বিতীয়ত, পুলিশের ওপর একটি শক্তিশালী নজরদারি ব্যবস্থা চালু করা উচিত। এজন্য সঠিক প্রশিক্ষণ ও নিয়মিত মনিটরিং ব্যবস্থা প্রয়োজন, যাতে পুলিশ আইন প্রয়োগের সময় মানবাধিকার ও নাগরিক অধিকার লঙ্ঘন না করে। স্বাধীন সংস্থার মাধ্যমে পুলিশের কার্যক্রমের নিয়মিত পর্যালোচনা করা গেলে বিশেষ ক্ষমতা আইনের অপব্যবহার কমানো সম্ভব হবে।
তৃতীয়ত, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে দমনের লক্ষ্যে এ আইনের অপব্যবহার যাতে না করা হয়, সেদিকে সতর্কতা বৃদ্ধি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে পুলিশকে অধিকতর সচেতন হতে হবে। তবে সরকারের উদারতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত হলেই কাজটি পুলিশের জন্য সহজ হবে।
চতুর্থত, মানবাধিকার সংস্থা ও সুশীল সমাজকে একত্র করে একটি কার্যকর প্রতিবাদ ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন, যাতে তারা পুলিশের অসদাচরণ ও অপব্যবহার প্রতিরোধ করতে পারে। এছাড়া পুলিশের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে সরকার ও স্বতন্ত্র সংস্থাগুলোর মধ্যে একটি শক্তিশালী সহযোগিতা প্রয়োজন।
পঞ্চমত, জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। তাদের জানা উচিত, বিশেষ ক্ষমতা আইনের আওতায় তাদের অধিকার কী এবং অবিচারের ঘটনায় কীভাবে তারা আইনগত প্রতিকার পেতে পারে। এমনকি আইনের অপব্যবহারকে প্রতিরোধ করার জন্য গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
‘আইনের উদ্দেশ্য যদি সত্যিই দেশের নিরাপত্তা রক্ষা হয়। তবে তা অবশ্যই স্বচ্ছ সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এবং মানবাধিকার রক্ষা করেই হতে হবে।’
ভূঁইয়া শফি
সাংবাদিক
journalistshofiqul@gmail.com
এই বছর অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে উদ্ভাবন ও সৃজনশীল ধ্বংসের প্রক্রিয়া (creative destruction) কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে সেই গবেষণার ওপর। নতুন প্রযুক্তি ও ধারণা পুরোনো ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন করে সমাজ যখন পরিবর্তনের জন্য উন্মুক্ত থাকে, তখনই টেক
৮ ঘণ্টা আগে‘মনের তালা খুলল কে, চাবিওয়ালা, চাবিওয়ালা!’ প্রখ্যাত শিল্পী রুনা লায়লার সেই সুরেলা প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে বেড়াচ্ছি! তবে ব্যক্তিগত জীবনে নয়, রাষ্ট্রীয় জীবনে। এই রাষ্ট্রের জীবনেও একটা বিশেষ তালা আছে, আর তার নাম আর্টিকেল ৭০! এই তালা লাগানো হয়েছিল সেই সব মাননীয়র জন্য, যাদের মধ্যে ‘ছাগলীয়’ প্রবৃত্তি রয়ে
৮ ঘণ্টা আগেভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে প্রায়ই তার পরম বন্ধু বলে বেশ গৌরবের সঙ্গে প্রচার করে থাকেন। ভিন্ন দেশের এ দুই রাজনীতিবিদের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের মূল সূত্র হলো মুসলমানদের প্রতি তাদের তীব্র ঘৃণা। বর্তমান বিশ্বে ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত শীর্ষ দুটি
৮ ঘণ্টা আগেগাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন হতাশা চরমে, তখনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন এক নতুন ‘২০ দফার শান্তি পরিকল্পনা’। সেখানে তিনি নিজেকে বসিয়েছেন একটি তথাকথিত ‘বোর্ড অব পিস’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে।
১ দিন আগে