শব্দসন্ত্রাস বন্ধে প্রয়োজন সচেতনতা

ড. মোহাম্মদ আলী ওয়াক্কাস
প্রকাশ : ১৯ মার্চ ২০২৫, ১০: ২৪

শব্দসন্ত্রাস বর্তমানে সহ্যের সীমা অতিক্রম করেছে। হেন জায়গা নেই যেখানে এর তীব্রতা এবং ভয়াবহতা অনুপস্থিত। প্রতিনিয়ত এর ধরন এবং চরিত্রে নানা রূপ যোগ হয়ে নাগরিক জীবনকে বিষিয়ে তুলছে শব্দসন্ত্রাস।

হরেক পদের শব্দসন্ত্রাসের মধ্যে গাড়ির হর্ন, ডিজে পার্টি, উৎসব-পার্বণ, জনসভা, নির্মাণকাজ, বিভিন্ন ওয়ার্কশপ, ওয়াজ-মাহফিলে বাহারি সাউন্ড সিস্টেমের ব্যবহার ও পূজা-পার্বণের মাত্রাতিরিক্ত শব্দবোমা কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে। কলকারখানা, প্রিন্টিং প্রেস, পাওয়ার প্লান্টে ভারী মেশিনের ব্যবহারও বিকট শব্দের সৃষ্টি করছে।

বিজ্ঞাপন

এসব কি নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় রাখা যায় না? শীত মৌসুমে আমাদের দেশে ওয়াজ মাহফিলের হিড়িক পড়ে যায়। এসব আমাদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার। ইসলাম শান্তি এবং সৌহার্দ্যের ধর্ম। আখিরাতের মুক্তি এবং দুনিয়ার কল্যাণের অভিপ্রায়ে ওয়াজ মাহফিল আয়োজন অনেক আগে থেকেই হয়ে আসছে। তাই বলে কি যেখানে ৫০০ মানুষের ধারণক্ষমতার প্যান্ডেল, সেখানে তিন কিলোমিটার দূর পর্যন্ত মাইক লাগাতে হয় কেন? মানুষকে কি জোর করে বয়ান শুনতে বাধ্য করতে হবে? অথচ ইসলামে মানুষকে যেকোনোভাবে কষ্ট দেওয়া নিষেধ করা হয়েছে। তাহলে আমরা ধর্মের নামে এমনটা কি শুধু আবেগতাড়িত হয়ে করছি?

এ দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান। এখানে ইসলামিক তমদ্দুন চর্চা থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কেননা মুসলমান তো তারাই, যাদের হাতে অন্য ভাই-প্রতিবেশী নিরাপদ। যাদের ওপর পারতপক্ষে অন্যায়-জুলুম-অবিচার করার কথা নয়। পবিত্র কোরআনে সুরা আহজাবে বলা আছে, যারা বিনা অপরাধে মুমিন পুরুষ ও নারীদের কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ এবং প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে। সুরা লোকমানে আল্লাহ বলেন, তোমার কণ্ঠস্বর নিচু করো। নিশ্চয়ই কণ্ঠস্বরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট হলো গাধার শব্দ। সুরা নাহাল, আয়াত-৩৫-এ সৃষ্টিকর্তার নির্দেশনা হলো, আপনি আপনার প্রতিপালককে ডাকুন হিকমতের সঙ্গে এবং সুন্দর বুলি দিয়ে।

হাদিসে এসেছে, মুসলিম সেই ব্যক্তি, যার জিহ্বা ও হাত থেকে অন্য মুসলিম নিরাপদ। সাউন্ড সিস্টেমের অপব্যবহার সমাজ সম্প্রদায়কে কি ভুল বার্তা দিচ্ছে? কেননা ওয়াজ মাহফিলের চারপাশে হাসপাতাল, গর্ভবতী, বৃদ্ধ, শিশুসহ শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণাগ্রস্ত নানা মানুষের বাস থাকতে পারে। তাদের জিম্মি করে এসব কেন করছি? ধর্মীয় বক্তারা কি এসব ভেবে দেখেছেন?

বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় ইসলামি বক্তা মাওলানা মিজানুর রহমান আজহারীর অনুধাবন সত্যিই স্বস্তিদায়ক। ওনার মত হলো, তাফসির মাহফিলের মাইকগুলো যথাসম্ভব প্যান্ডেলের ভেতরে রাখা উচিত। শ্রোতাদের সুবিধার্থে উন্নত সাউন্ড সিস্টেম নিশ্চিত করতে বলেছেন। বর্তমান ধারার ওয়াজ মাহফিলের ব্যাপারে তিনি বলেন, এভাবে চলতে থাকলে চিরায়ত ঐতিহ্যের মাহফিলগুলো আধুনিক সমাজে তার আবেদন হারাবে। আমাদের কোনো আচরণে বিরক্ত হয়ে কেউ যদি ইসলামের ব্যাপারে বিরূপ মনোভাব পোষণ করে, তার দায়ভার ইসলামের নয়।

আরেক জনপ্রিয় ইসলামি বক্তা মাওলানা আহমাদুল্লাহর মন্তব্য হলো থার্টি ফার্স্ট নাইটের নামে শব্দদূষণ করা মারাত্মক অপরাধ এবং একইভাবে ওয়াজ মাহফিলের নামেও অপ্রয়োজনীয় শব্দসন্ত্রাস থামাতে হবে। কেননা মুসলমান হিসেবে অন্যের কষ্টের কারণ হওয়া কোনোভাবেই কাম্য নয়। আবেগ নয়, হিকমতের আলোকে ভাবা প্রয়োজন।

শব্দসন্ত্রাস কারা করছে? একবারও কি ভেবেছি আমরা? এ দেশে গাড়ির মালিক কারা? ডিজে পার্টি, থার্টি ফার্স্ট কাদের সংস্কৃতি? খেটে খাওয়া মানুষ কি এসব করে? উপরতলার মানুষ অকারণে মাত্রাতিরিক্ত শব্দের উপস্থিতি ঘটিয়ে সমাজ ও সভ্যতার গায়ে খামচি মারছে। এত ক্ষমতা তারা পেল কীভাবে? ভিআইপি প্রটোকল, ব্যস্ত সড়কে নেতা-নেত্রীকে নিয়ে মোটর শোভাযাত্রায় বিকট শব্দ, যানজটে লাগামহীনভাবে হর্নের তীব্রতা কি সুস্থ সমাজের লক্ষণ? অথচ কিতাবি শিক্ষিতরাই এসব করছেন।

সাংস্কৃতিক বন্ধ্যাত্ব এবং বাহাদুরির মধ্যে এরা বীভৎস সুখ খুঁজে পান। অথচ এসবে কত মানুষের ক্ষতি হচ্ছে, তা কি ভেবে দেখেছি? থার্টি ফার্স্টের উন্মাদনায় ইকোলজি অ্যান্ড দ্য এনভায়রনমেন্ট জার্নালের গবেষণায় উঠে এসেছে আতশবাজিতে আক্রান্ত হয়ে লাখ লাখ পশুপাখি মারা যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব নয়েজ কন্ট্রোলে বলা আছে, শব্দের প্রভাবে উচ্চ রক্তচাপ, আলসার, হৃদরোগ, মাথাব্যথা বা স্নায়ুর সমস্যা হতে পারে। এমনকি অতিরিক্ত শব্দের কারণে শিশুর জন্মত্রুটি, শ্বাসকষ্ট এবং হজমেও সমস্যা হতে পারে।

শব্দমান মেনে চলা সভ্যসমাজের কর্তব্য। সবার সুষম এবং কাঙ্ক্ষিত প্রাপ্তি, মর্যাদা এবং অধিকার নিশ্চিতের মধ্যেই অনাবিল তৃপ্তি। শব্দের মান অনুসরণের মধ্যেই স্বস্তি। যেখানটা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা হলো আবাসিক এলাকায় শব্দমান পঞ্চান্ন ডেসিবল এবং শিল্প এলাকায় সত্তর ডেসিবলের নিচে থাকার কথা। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা ২০০৬-এ শব্দের মান এবং শাস্তির কথা বলা আছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পাঠাগার, হাসপাতালসহ এ ধরনের এলাকাগুলো নীরব এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অথচ ঢাকা নগরীতে হাসপাতালের সামনে গড় আওয়াজ ৮১ দশমিক ৭। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বের শব্দদূষণে ঢাকা শীর্ষে। তিন বছরের ছোট বাচ্চার কাছে এক শ ডেসিবেল হর্ন তার আজীবনের জন্য বধির হওয়ার কারণ হতে পারে।

সামাজিক বাস্তবতায় এ বিষয়ে গণসচেতনতা সৃষ্টি এবং আবেগী মানসিকতার পরিবর্তন সময়ের যৌক্তিক আকাঙ্ক্ষা। আধুনিক জামানায় টার্গেট শ্রোতাকে কেন্দ্র করে সাউন্ড সিস্টেম আবর্তিত হওয়া উচিত। যত্রতত্র হর্নের ব্যবহার, ডিজে পার্টি, নির্মাণকাজÑ এসবের শব্দমান মেনে চলতে হবে। আমাদের সবার মধ্যে শুভবুদ্ধির উন্মেষ ঘটাতে হবে। ভাবতে হবে সমাজের সবার কথা। কেননা, সবার সমান অধিকার এবং শঙ্কাহীন জীবনের মধ্যেই সমাজ সংস্কৃতির প্রকৃত সৌন্দর্য।

লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত