বাংলাদেশের নিরাপত্তা ঝুঁকি!

এলাহী নেওয়াজ খান
প্রকাশ : ০৮ এপ্রিল ২০২৫, ১১: ৫১

তিন দিক দিয়ে ভারত দ্বারা পরিবেষ্টিত, পূর্ব দিকে গৃহযুদ্ধে রক্তাক্ত মিয়ানমার, দক্ষিণে বিশাল বঙ্গোপসাগরের উত্তাল তরঙ্গরাশি এবং মাঝখানে ৫৪ হাজার বর্গমাইলের ছোট্ট বাংলাদেশ। কোনো প্রাকৃতিক সম্পদ নেই, আছে ১৮ কোটি মানুষের বিশাল জনশক্তি।

একদা চীনের মহান নেতা মাও সেতুং বলেছিলেন, ‘জনসংখ্যা কোনো সংকট নয়, বরং সম্পদ।’ তাই তো বিদেশে কর্মরত এই জনশক্তি এখন আমাদের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। এর পাশাপাশি দেশটির ভৌগোলিক অবস্থান এমন এক ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব বহন করছে, যা বহু শত বছর ধরে উপেক্ষিতই ছিল। এই গুরুত্ব একদিকে যেমন আমাদের মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে, তেমনি পরাশক্তিগুলোর শ্যেন দৃষ্টি আমাদের কৌশলী হতেও শেখাচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

চট্টগ্রাম, চালনা ও পায়রার মতো তিনটা বিরাট বন্দর সুবিধার পাশাপাশি পূর্ব এশিয়ার বিশাল অর্থনৈতিক অঞ্চলের সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার সংযোগস্থাপনকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান এখন বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টিতে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একইভাবে চীনের ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে প্রসিদ্ধ মুক্তর মালা নেটওয়ার্কের (string of pearls strategy) সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার বিষয়সহ ভারতের শিলিগুড়ি ‘চিকেন নেক’ সংকট বাংলাদেশের ভূমিকাকে আরো অপরিসীম করে তুলেছে।

আবার অন্যদিকে মিয়ানমারের ভেতরে স্বাধীন আরাকান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে চলমান রক্তাক্ত যুদ্ধ এবং বাংলাদেশ ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কিছু এলাকা নিয়ে একটি খ্রিষ্টান রাষ্ট্র গঠনের পশ্চিমা পরিকল্পনার গুঞ্জন বাংলাদেশের ভূমিকাকে আবার জটিলও করে তুলেছে। ঠিক এ রকম একটি প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সামরিক শক্তির ব্যাপক উত্থান ও সম্প্রসারণের বিষয়টি এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। এসব ছাড়াও বিশ্বক্ষমতার মানচিত্রের পরিবর্বতনশীলতার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও সামরিক সক্ষমতার বিষয়টি অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যদিও এটা সত্য, আমাদের সামরিক শক্তির বিকাশ কখনোই সুনির্দিষ্ট ডকট্রিনের ভিত্তিতে ঘটেনি, রাজনৈতিক পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে বারবার হোঁচট খেয়েছে। শুধু তা-ই নয়, অনেক বেদনাদায়ক ঘটনায়ও বহুবার পিছিয়ে গেছে অগ্রযাত্রা। স্বাধীনতার পর গত ৫৪ বছরে যুদ্ধ ছাড়া অভ্যন্তরীণ সংঘাতে যত অফিসার নিহত হয়েছেন, তার নজির পৃথিবীর ইতিহাসে কোথাও নেই।

তা ছাড়া গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতায় বিঘ্ন ঘটানো জেনারেল এরশাদ ও জেনারেল মইন ইউয়ের সামরিক হস্তক্ষেপ এবং অতঃপর আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী শাসনকে মদত প্রদানকারী কয়েকজন সেনাপতির নগ্ন ভূমিকা পালন সামরিক বাহিনীকে জনবিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল মারাত্মকভাবে। তবে দিনশেষে জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতা বিপ্লবকালে প্রতিষ্ঠান হিসেবে সামরিক বাহিনীর গণমুখী ভূমিকায় আবার জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে। মূলত একটি জাতীয় সামরিক বাহিনী দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রতীক। আর সেজন্যই তারা জনগণের কাছে বীর হয়ে ওঠে।

এ রকম বীরত্বগাথা আমরা দেখেছি বহুবার। আবার এটাও দেখেছি, কীভাবে কিছু অফিসার ইতিহাসের জঘন্যতম ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েমে সহায়তা করেছেন। এতকিছু সত্ত্বেও আমাদের মত ছোট ছোট দেশে সংকটকালে সামরিক বাহিনীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সেটা দুভাবে ঘটে—একটা নেতিবাচক, অন্যটা ইতিবাচক; একটি চরম নিপীড়নমূলক, অপরটি মুক্তিকামী মানুষের সারথি।

যেমন একটা পেশাদার আর্মি সরকারের নিপীড়নমূলক শাসনের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করতে পারে। সে ক্ষেত্রে সরকারবিরোধী সব আন্দোলনকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করতে সামরিক বাহিনী কোনো কুণ্ঠা বোধ করে না। পৃথিবীর নানা দেশে এ ধরনের ঘটনার অসংখ্য দৃষ্টান্ত আছে। আমরা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর পাকিস্তান আর্মির নৃশংসতা দেখেছি। আবার একই আর্মির বাঙালি অফিসারদের পক্ষ ত্যাগ করে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেওয়ার ঘটনা ইতিহাস হয়ে আছে। মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করে দিশাহারা জাতিকে যেভাবে অনুপ্রাণিত করেছিলেন, তাও ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তাই বলা হয়ে থাকে, জাতীয় সেনাবাহিনী সরকারের পক্ষ ত্যাগ না করা পর্যন্তু কোনো বিপ্লব সফল হয় না। সে সময় জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে পাক সেনাবাহিনীর পক্ষ ত্যাগ আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। অবশেষে ৯ মাস রক্তাক্ত যুদ্ধের পর আমরা স্বাধীনতা লাভ করি।

এই যে সরকারি পক্ষ ত্যাগ করে বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার ঘটনা, তা ইতিহাসজুড়ে ভূরি ভূরি আছে। যেমন ফরাসি বিপ্লবকালে ‘ফরাসি গার্ড’ রাজার পক্ষ ত্যাগ করে বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগদান করলে বিপ্লবের আশু সাফল্য ঘটে। এটা ছিল রাজকীয় বাহিনীর ‘এলিট ইনফেন্ট্রি রেজিমেন্ট’। এই বাহিনী ‘বাস্তিল দুর্গে’ আক্রমণ চালালে দ্রুত দুর্গের পতন ঘটে। অন্যদিকে রাজকীয় আর্মি প্রথম দিকে রাজার প্রতি অনুগত থাকলেও শেষমেশ সংঘাতে জড়াতে অনীহা প্রকাশ করে, যা ফরাসি রাজতন্ত্রের পতন অনিবার্য করে তুলেছিল।

আবার রুশ বিপ্লবের কথাই ধরা যাক। সেই বিপ্লবের সময় সেনাবাহিনীর একটি বড় অংশ রাজতন্ত্রের পক্ষ ত্যাগ করে বলশেভিকদের সঙ্গে যোগ দেয়। এর ফলে রুশ বিপ্লব দ্রুত সফলতা লাভ করে। একই ঘটনা আমেটিকার বিপ্লব বা স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ঘটেছিল। তখন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর নিম্নপদের কিছু অফিসার ও সৈনিক স্বাধীনতাকামী যোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। এতে ব্রিটিশ আর্মির মনোবল ভেঙে পড়ে এবং আমেরিকার স্বাধীনতা ত্বরান্বিত হয়।

এরকম আরো অনেক ঘটনার কথা ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ আছে। তবে সর্বশেষ এই একবিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশে জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের সময় ফ্যাসিস্ট হসিনা সরকারের আদেশে বিপ্লবীদের ওপর গুলি চালাতে অস্বীকৃতি জানিয়ে এবং সরকার পরিবর্তনে অনুঘটকের কাজ করে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীও ইতিহাস হয়ে গেছে, ঠিক যেভাবে ফরাসি রাজকীয় বাহিনী অনীহা প্রকাশ করে ফরাসি বিপ্লব সফল করেছিল।

আজ এই পটভূমিতে আমাদের উপলব্ধি করার সময় এসেছে যে, একটি স্বাধীন দেশের সামরিক বাহিনী অন্য দেশের অধীনস্থ হয়ে থাকতে পারে না। এ ধরনের পরিস্থিতিতে কোনো দেশের পক্ষে স্বাধীনভাবে পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। সম্প্রতি সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেছেন, শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ছাড়া পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। বিগত আওয়ামী ফ্যাসিবাদী শাসনামলে সেটাই ঘটেছিল। আওয়ামী লীগ সরকার শুধু ক্ষমতায় টিকে থাকার স্বার্থে বাংলাদেশকে ভারতের একটি অধীনস্থ রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল।

অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চীন সফরকে কেন্দ্র করে ভারতের প্রতিক্রিয়া দেখে তাই মনে হচ্ছে। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, ভারতের সঙ্গে সলাপরামর্শ না করে এ ধরনের কোনো সফর আওয়ামী শাসনামলে হয়তো কল্পনাই করা যেত না। নিশ্চয় সে সময় শেখ হাসিনার চীন সফর ছিল ভারতের অনুমতিক্রমে, যা ভারতের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে কোনো বিঘ্ন ঘটাবে না বলে নিশ্চয়তা ছিল। এতে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি কতটা ভারতনির্ভর ছিল তা প্রতিফলিত হয়েছে, যা ‘ভ্যাসল রাষ্ট্রের’ (vassal state) অর্থাৎ অধীনস্থ রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ঘটে। ইতিহাসে এ ধরনের অধীনস্থ রাষ্ট্রের দৃষ্টান্ত অনেক আছে। একদা নরওয়ে আমেরিকার ‘ভ্যাসল স্টেট’ ছিল।

দেশটির পররাষ্ট্রনীতি আমেরিকা নিয়ন্ত্রণ করত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে ভারত তৎকালীন স্বাধীন বাংলা সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে যে সাত দফা চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল, তাতে ভারতীয় সমরবিদের তত্ত্বাবধানে এমন একটি আধা সামরিক বাহিনী গড়ে তোলার কথা ছিল, যা অস্ত্রশস্ত্রে ও সংখ্যায় নিয়মিত বাহিনীর চেয়ে বড় হবে। পরে ওই চুক্তির আলোকে রক্ষী বাহিনী গঠিত হয়। ওই চুক্তির আরেকটি ধারায় বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ভারতের পররাষ্ট্রনীতির অনুরূপ হতে হবে। তার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, বাংলাদেশের কোনো শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনী থাকবে না, থাকবে না কোনো স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি। তাই দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার এত বছর পরও ভারতের সঙ্গে তার পুরোনো আঁতাত থেকে কখনো বেরিয়ে আসতে পারেনি।

পরিশেষে এটা বলা যায়, অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। যেমন অস্থিতিশীল মিয়ানমার, পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিরতা, দেশের অভ্যন্তরে পরিকল্পিত অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা, বিগ ব্রাদারের অব্যাহত মনস্তাত্ত্বিক চাপ, সীমান্তে ক্রমাগত উত্তেজনা বৃদ্ধি প্রভৃতি নানা ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকি সৃষ্টি হতে পারে। এসব মোকাবিলায় রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের যৌথ মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন জরুরি হয়ে পড়েছে। তা না হলে অচিরেই বাংলাদেশকে বড় ধরনের বিপদে পড়তে হবে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত