গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের উপযোগী গণমাধ্যম যেন থাকে

এমরান এস হোসাইন
প্রকাশ : ২২ মার্চ ২০২৫, ১৪: ১৭

কামাল আহমেদ। গণমাধ্যম কমিশনের প্রধান। গণমাধ্যমকে স্বাধীন, শক্তিশালী ও বস্তুনিষ্ঠ করতে প্রয়োজনীয় সংস্কার করার লক্ষ্যে সাংবাদিক কামাল আহমেদকে প্রধান করে গত ১৮ নভেম্বর গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। কামাল আহমেদ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে কাজ করেছেন। ইন্টারন্যাশনাল ট্রুথ অ্যান্ড জাস্টিস প্রজেক্টেও তিনি পরামর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি প্রথম আলো পত্রিকার পরামর্শক সম্পাদক, বিবিসি নিউ মিডিয়া ও বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের সিনিয়র প্রযোজক, বিবিসি বাংলা সার্ভিসের সম্পাদক, বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে দক্ষিণ এশিয়া-বিষয়ক বিশ্লেষক এবং বিবিসির ঢাকা সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি জাতিসংঘ রেডিওর পরামর্শক ছিলেন। এর আগে তিনি ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের প্রধান সহ-সম্পাদক ছিলেন। দৈনিক দেশ পত্রিকায় ১৯৮৬ সালে তিনি সাংবাদিকতা পেশায় যোগ দেন। কামাল আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে স্নাতক ও ইতিহাস বিষয়ে স্নাতকোত্তর এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ১৯ ডিসেম্বর ১৯৬০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। আমার দেশ-এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি বাংলাদেশের গণমাধ্যমের সার্বিক পরিস্থিতি ও কমিশনের ভূমিকার নানা দিক নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন। কামাল আহমেদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আমার দেশ-এর বিশেষ প্রতিনিধি এমরান এস হোসাইন

বিজ্ঞাপন

আমার দেশ : আপনারা কবে রিপোর্ট জমা দেবেন?

কামাল আহমেদ : আমরা শনিবার (২২ মার্চ) রিপোর্ট জমা দেব। ওই দিন দুপুর ১২টায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করে আমরা প্রতিবেদন হস্তান্তর করব।

আমার দেশ : আপনাদের রিপোর্টে কী ধরনের সুপারিশ আপনারা করেছেন।

কামাল আহমেদ : এই মুহূর্তে সুপারিশের সংখ্যা সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারছি না। আমাদের ফাইনাল কাজ চলছে। কিছু অংশ এখনো চূড়ান্ত হয়নি। চূড়ান্ত করার পর এটা বলা যাবে।

আমার দেশ : আপনার কমিশনকে যদি মূল্যায়ন করতেন।

কামাল আহমেদ : আমাদের লক্ষ্যই ছিল অংশীজনকে সঙ্গে নিয়ে কাজটি করা। আমরা সেটা চেষ্টা করেছি। আমাদের এখানে সম্পাদক, মালিক প্রতিনিধি, সাংবাদিক, মাঠের সাংবাদিক—একেবারে মফস্বলের সাংবাদিকেরাও আছেন। এখানে নারীর প্রতিনিধিত্ব আছে। এখানে সংখ্যালঘুর প্রতিনিধিত্ব আছে। আমি বলব, সরকার যতগুলো কমিশন গঠন করেছে। তার মধ্যে এটা সব থেকে বেশি অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়েছে। এ কমিশন চেষ্টা করেছে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে সবার মতামতকে বিবেচনায় নিয়ে সামনে এগুনোর একটি পথ নির্ধারণ করা। আশা করি সরকার এটা গ্রহণ করবে এবং বাস্তবায়নে তৎপর হবে।

আমার দেশ : আপনারা কতগুলো বৈঠক করেছেন?

কামাল আহমেদ : আমরা সর্বমোট ৫৪টি বৈঠক করেছি। এই সভায় উপস্থিতি ১ হাজার ৪০০ জন।

আমার দেশ : গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলো কী কী হতে যাচ্ছে?

কামাল আহমেদ : আমরা গণমাধ্যমে সুষ্ঠু ও সুস্থ প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরির ওপর জোর দিয়েছি। এই পরিবেশ বলতে আমরা যা বোঝাতে চাচ্ছি তা হচ্ছে, গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান যেন মানুষের কথা বলে, জনস্বার্থকে প্রাধান্য দেয়। এটা কীভাবে নিশ্চিত করা যায়, তার কিছু সম্ভাব্য পথ আমরা বলব। তবে এই সম্ভাব্য পথ কিন্তু আমাদের আবিষ্কার নয়। বিভিন্ন দেশে যে উত্তম চর্চা আমরা দেখছি, ভালোভাবে কাজ করছে, সফল হয়েছে। এ রকম চর্চা থেকে আমরা শিক্ষা নিয়েই কিছু কিছু পরিবর্তনের কথা বলব। আশা করি, এর মাধ্যমে গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের জন্য উপযুক্ত ভূমিকা রাখতে সক্ষম এমন গণমাধ্যম বাংলাদেশে আবারও কাজ করতে পারবে।

আমার দেশ : আপনাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ কোনটি?

কামাল আহমেদ : আমাদের কাছে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, গণমাধ্যমে মালিকানার প্রশ্ন। কারণ গণমাধ্যমে কালোটাকা ঢুকেছে। ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক স্বার্থ প্রাধান্য পাচ্ছে। জনগণের স্বার্থ প্রাধান্য পায় না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা এটা দেখতে পাচ্ছি। সুতরাং মালিকানার প্রশ্নটায় কীভাবে স্বচ্ছতা আনা যায়—মালিকদের জবাবদিহির প্রশ্নও আসে। কীভাবে গণমাধ্যমকে কালোটাকা মুক্ত করা যায়, সেগুলোর বিষয়ে আমাদের পরামর্শ থাকবে।

আমার দেশ : সাংবাদিকরা অনেক ক্ষেত্রেই নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। সাংবাদিকদের নিরাপত্তায় সুরক্ষার ব্যাপারে কী সুপারিশ করেছেন? অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য কোনো সুপারিশ আছে কি?

কামাল আহমেদ : নিরাপত্তাহীনতার যে প্রশ্ন, এটা অনেক দিক থেকেই বিবেচনার বিষয়। একটা হচ্ছে আর্থিক নিরাপত্তা, সাংবাদিকের রুটি-রুজি, তার মাথার ঠাঁই—সেটার একটা বিষয় আছে। দেখা যাচ্ছে, গণমাধ্যমে সুষ্ঠু পরিবেশ না থাকায় এবং দেশে বেকারত্বের পরিমাণ বেশি হওয়ায় সাংবাদিকদের কোনো ধরনের যোগ্যতা নির্ধারণের প্রশ্ন নেই। যাকে খুশি তাকে নিয়োগ দেওয়া যায়, যত খুশি তত কম বেতন দেওয়া যায়। কোনো ধরনের গ্যারান্টি ছাড়াই সাংবাদিক নিয়োগ দেওয়া যায়, যে কারণে আমাদের গণমাধ্যমে এক ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সাংবাদিকদের বেতন ও চাকরির নিরাপত্তাহীনতা দেখা দিয়েছে। আবার অন্য নিরাপত্তাহীনতাও রয়েছে। রাজনৈতিক দলাদলির কারণে টার্গেট হন সাংবাদিকরা। ব্যক্তিস্বার্থ, দ্বন্দ্ব, এলাকায় প্রভাব বিস্তার—নানা কিছুতে সাংবাদিকরা লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন। সেক্ষেত্রে শারীরিকভাবে আক্রান্ত হওয়ার একটা ঝুঁকি থাকে। আবার আইনেরও অপপ্রয়োগের ব্যাপার থাকে। প্রশাসন ও ক্ষমতাবান ব্যক্তিরা আইনের অপব্যবহার করে সাংবাদিকদের ‘শিক্ষা’ দেওয়ার চেষ্টা করে। কিছু হলেই মানহানির মামলা দিয়ে জেলে পুরে দেওয়া হয়। আমরা দেখেছি ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট ও সাইবার নিরাপত্তা আইনের নানা ধরনের অপপ্রয়োগ হয়েছে। সাংবাদিকরা ভোগান্তির শিকার হয়েছেন। সব দিক বিবেচনা করে কীভাবে আমরা নিজেদের পেশাগত কাজের জন্য সুরক্ষা পেতে পারি সেটি, অন্য কিছু নয়। আমি রাজনীতি করতে গিয়ে মার খেলাম, কিংবা মামলার শিকার হলাম, সেটি নয়। আমি পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যাতে কোনো ধরনের বাধা না আসে, সেরকম একটি ব্যবস্থার কথা আমাদের ভাবতে হবে। আমরা সেরকম একটি সুপারিশ করব।

আমার দেশ : প্রত্যেক পেশায় প্রবেশের ক্ষেত্র ন্যূনতম যোগ্যতার একটা বিষয় থাকে। কিন্তু সাংবাদিকতা পেশার ক্ষেত্রে কোনো যোগ্যতার বিষয় নেই। এক্ষেত্রে আমরা ন্যূনতম যোগ্যতার বিষয়টি চিন্তা করেছেন কি না?

কামাল আহমেদ : সারাদেশ থেকেই এ বিষয়টি এসেছে। এ দাবিটি উপেক্ষা করার বিষয় নয়। বিশেষ করে এখন যে বাস্তবতা—হাজার হাজার অনলাইন পোর্টাল, যারা নিজেদের নিউজ পোর্টাল হিসেবে দাবি করে, তারাও তৎপর হয়েছে। টেলিভিশনগুলোয় দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল পাওয়া যায় না। তারাও তাদের মতো করে অনেককে নিয়োগ করছে, যেখানে নিয়োগে কোনো যোগ্যতা দেখা হয় না। সংবাদপত্রের ক্ষেত্রেও তাই। নিয়োগের পর কাজ শিখিয়ে নেওয়া হয় এবং অতীতেও এটা ছিল। এ ধারাটা এখনো আছে। এ দুয়ের মধ্যে একটা ভারসাম্য আনার প্রশ্ন নিশ্চয়ই আছে। এজন্য শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়টি বিবেচনা করে একটা সুপারিশ করতে হবে।

আমার দেশ : প্রেস কাউন্সিলকে কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার ব্যাপারে সাংবাদিক মহলে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা আছে। এ ব্যাপারে রিপোর্টে সুপারিশ আছে কি?

কামাল আহমেদ : বিগত দিনে প্রেস কাউন্সিল তার বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। মানুষও এই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে খুব একটা সচেতন নয়। তারা প্রেস কাউন্সিলে আস্থা রাখতে পারে না। ফলে মানুষ ভোগান্তির শিকার হলে প্রেস কাউন্সিলে প্রতিকার মিলবে না মনে করে কোর্টের দ্বারস্থ হয়। প্রেস কাউন্সিল যেহেতু কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করতে পারেনি, সে কারণে এটা সম্পর্কে আমাদের নতুন ভাবনা-চিন্তা করতে হচ্ছে। আরেকটি বিষয়, প্রেস কাউন্সিল কেবল সংবাদপত্র ও বার্তা সংস্থাগুলোর জন্য গঠিত হয়েছিল, কিন্তু এখন তো টেলিভিশন একটা বিরাট শিল্প হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। অনলাইনও এখন অনেক গুরুত্ব বহন করছে। তাদেরও এক ধরনের তদারকির মধ্যে আমাদের আনতে হবে, জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। সরকার এর আগে একটি সম্প্রচার কমিশন গঠনের কথা বলেছিল, যে কমিশন টেলিভিশন ও অনলাইনের দিকটা দেখবে। আমাদের এখন ভাবতে হবে, এই দুটোর সমন্বয় করে কিছু করা সম্ভব কি না? কাজেই আমরা এক্ষেত্রে একটা কিছু সুপারিশ অবশ্যই দেব।

আমার দেশ : পিআইবি, গণমাধ্যম ইনস্টিটিউট, চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউটের ব্যাপারে আলাদা কিছু বলেছেন কি?

কামাল আহমেদ : পিআইবি ও গণমাধ্যম ইনস্টিটিউটের কাজ অনেক। তারা অনেক কিছু করে। তবে সেটা কাজের জন্য হয় কি না, সেটা প্রশ্ন। তারা কখনোই চাহিদাটা যাচাই করে দেখেনি। আমাদের সংবাদপত্র বা টেলিভিশনে কোন ধরনের স্কিলের ঘাটতি রয়েছে, সেটা জানলেই না হয় সে ধরনের প্রশিক্ষণ দিতে পারবে। এরা কেবল ফাউন্ডেশন প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। এই প্রশিক্ষণের পরিধি বাড়ানো দরকার। এই মুহূর্তে গণমাধ্যমে যে রূপান্তর চলছে, সেই রূপান্তরের সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য দক্ষ জনশক্তি দরকার। সুতরাং প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রয়োজন অনুসারে সাজিয়ে নিতে হবে। তাদের কোর্স কারিকুলামকে নতুন করে সাজাতে হবে। এগুলো আমরা বিবেচনায় নিয়েছি। সেই বিবেচনা থেকে আমাদের এ বিষয়ে অবশ্যই সুপারিশ থাকবে।

আমার দেশ : গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের রিপোর্টের মূল ফোকাস কী? কোন বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে কমিশন?

কামাল আহমেদ : দেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের উপযোগী গণমাধ্যম যেন থাকে, সে রকম পরিবেশ তৈরি, সে রকম গণমাধ্যম গড়ে তোলার বাস্তবতা তৈরি হচ্ছে মূল কাজ। এখানে আমাদের লক্ষ্য ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। স্বাধীন, বস্তুনিষ্ঠ ও শক্তিশালী গণমাধ্যম হতে হবে। একটি স্বৈরাচারী ব্যবস্থায় স্বাধীন ও বস্তুনিষ্ঠ গণমাধ্যম কাজ করতে পারে না। এটার জন্য দরকার হয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। সে কারণে একটা প্রাণবন্ত ও দায়িত্বশীল গণমাধ্যম প্রয়োজন। সে লক্ষ্যে আমার সংস্কারের সুপারিশগুলো থাকবে।

আমার দেশ : চার মাস ধরে আপনারা কাজ করেছেন—বাংলাদেশের গণমাধ্যমের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে কী চিত্র পেয়েছেন?

কামাল আহমেদ : আমি বলব, এটা খুবই নৈরাজ্যকর। এখানে কোনো সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা নেই। যারা বাজারকে নানাভাবে প্রভাবিত করতে পারে, প্রভাব খাটিয়ে তারা আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে। আগেই বলেছি, এখানে গণমাধ্যমকর্মীদের নিরাপত্তাহীনতা ও অনিশ্চয়তা রয়েছে। গণমাধ্যমের মালিকদের কোনো জবাবদিহি নেই। এই যে সরকার পরিবর্তন হলো, কোনো মালিক কিন্তু পরিবর্তন হয়নি। হাতে গোনা একটা দুটোর ক্ষেত্রে পরিবর্তনের খবর পাওয়া গেছে। মালিকরা তাদের জায়গায় ঠিকই আছেন, কিন্তু তারা দ্রুত নিউজ রুমগুলোর নেতৃত্বে পরিবর্তনের চেষ্টা করেছেন। উদ্দেশ্য হচ্ছে, নতুন রাজনৈতিক শক্তি, যাদের উত্থান হওয়ার সম্ভাবনা আছে, কিংবা আগে বিরোধী দলে যারা ছিলেন শক্তিশালী, তাদের সঙ্গে কীভাবে একটা লিয়াজোঁ করে নিজেরা নিজেদের স্বার্থটাকে অক্ষুণ্ণ রাখতে পারেন। এটা তো কোনো সুষ্ঠু স্বাভাবিক চর্চা নয়। যে যখন ক্ষমতায় থাকবে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আপনার প্রতিষ্ঠান চালাবেন। সেখানে বহু মতের প্রতিফলন ঘটবে না, বৈচিত্র্য থাকবে না, বিতর্ক থাকবে না, নিরপেক্ষতা থাকবে না। এটা তো গণমাধ্যমের কাছে প্রত্যাশিত নয়।

আমার দেশ : গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে আমরা কোথায় আছি, কিংবা আমাদের অবস্থান কী?

কামাল আহমেদ : এটা আমার বলার প্রয়োজন নেই। আপনি আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর যে রেটিং সেটা দেখুন। মুক্ত গণমাধ্যমের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়—১৮০টি দেশের মধ্যে ১৬৫তম। এরপরও কি বিষয়টি বলার অপেক্ষা রাখে?

আমার দেশ : বিটিভি ও রেডিওর স্বায়ত্তশাসন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কথা হচ্ছে, তেমনি বাসস নিয়ে কথা হচ্ছে। আপনাদের সুপারিশে এ সম্পর্কে কী বলছেন?

কামাল আহমেদ : বিটিভি ও রেডিওর স্বায়ত্তশাসন নিয়ে আগেও আলোচনা হয়েছে। ১৯৯১ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত একটা ‘রাজনৈতিক ঐকমত্য’ আছে। সবাই বলেছে, তারা রেডিও ও টেলিভিশনের স্বায়ত্তশাসন দেবে। কিন্তু এই ৩৪-৩৫ বছরে কিন্তু রেডিও ও টেলিভিশন সেই স্বায়ত্তশাসনটা পায়নি। কাজেই এখন জাতীয় ঐকমত্য বাস্তবায়নের রাস্তা তো আমাদের নতুন করে খুঁজতে হবে। আর সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের তথ্য কর্মকর্তারা যেটা করেন, বাসসের সাংবাদিকরাও তাই করেন। এর বাইরে কিছু নেই। যখন কোনো সরকার পরিবর্তন হয়, আমরা এখানে দেখি সেই সরকারের অনুগত বা কাছের সাংবাদিকদের চাকরির জায়গা হয়ে যায় বাসস। এটাই একমাত্র প্রতিষ্ঠান যেটায় সাংবাদিকের চেয়ে অসাংবাদিক বেশি। এটা তো এভাবে চলতে পারে না। এই প্রতিষ্ঠানের প্রাসঙ্গিকতা তারা ধরে রাখতে পারেনি। কাজেই তাদের আবার প্রাসঙ্গিক হতে হবে। এখন তারা কীভাবে এই প্রাসঙ্গিক হতে পারে, সে পথ আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। দেখা যাক, আমরা এই তিন প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে কী করতে পারি।

আমার দেশ : সরকারি বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে আমরা এক ধরনের বৈষম্য দেখতে পাই। এখানে স্বজনপ্রীতি আছে, রাজনৈতিক বিষয় আছে, দুর্নীতি-অনিয়ম আছে। এক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনের সুষম বণ্টনের বিষয়ে কোনো সুপারিশ আপনাদের থাকছে কি না?

কামাল আহমেদ : এ বিষয়ে আমরা সুস্পষ্ট সুপারিশ করব। বিজ্ঞাপনের প্রতিযোগিতার জন্য সংবাদপত্রের প্রচারসংখ্যা ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হয়। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা শহরে এই মুহূর্তে ঘোষিত প্রচারসংখ্যার হিসাবে ১ কোটি ৩০ লাখের বেশি দৈনিক পত্রিকা বিক্রি হয়। এটা হলে তো ঢাকার প্রতিটি দুধের শিশুকেও একটা কাগজ কিনতে হবে। বাড়িয়ে দেখানো হয় বিজ্ঞাপন পাওয়ার জন্য। প্রচারসংখ্যার একটি নির্দিষ্ট স্কেল পার হলেই বিজ্ঞাপনের রেটটা বেড়ে যায়। রেট বাড়লে তার পয়সা বাড়ে। এই প্রতিযোগিতাটা হচ্ছে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। এখানে দুর্নীতি আছে। সরকারি কর্মকর্তারা এই দুর্নীতির একটি বড় অংশ। তবে এর সঙ্গে গণমাধ্যমের আরো অনেকেই জড়িত—কর্তৃপক্ষ জড়িত, আবার ইউনিয়নগুলোও জড়িত।

আমার দেশ : বাংলাদেশে প্রকৃত প্রচারসংখ্যা কত? এই তথ্য আপনারা সংগ্রহ করেছেন কি না?

কামাল আহমেদ : প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা যা বলব, তা তথ্যভিত্তিক হবে। প্রত্যেকটা বিষয় সাক্ষ্যভিত্তিক হবে। প্রমাণ নেই, এমন কোনো কথা বা তথ্য আমাদের প্রতিবেদনে থাকবে না।

আমার দেশ : অংশীজনের সঙ্গে আলোচনায় তারা মিডিয়ার স্বাধীনতার ব্যাপারে কী বলেছেন?

কামাল আহমেদ : অংশীজনের স্বাধীন সংবাদমাধ্যম দেখতে চান; কিন্তু সেই স্বাধীন সংবাদমাধ্যম বলতে আবার এমন নয়, যেখানে কোনো দায়িত্বশীলতা থাকবে না, দায়িত্বহীন হবে। হলুদ সাংবাদিকতা তারা দেখতে চান না। তারা রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি দেখতে চান না। তারা ব্যবসায়িক স্বার্থে পক্ষপাত দেখতে চান না। সেজন্য আমরা যত পরামর্শ সভা করেছি, জনমত জরিপ করেছি, সব খানেই এই অভিমত এসেছে। সেগুলো বিবেচনায় নিয়েই আমাদের প্রতিবেদন তৈরি করতে হবে এবং সুপারিশমালা দেওয়া হবে।

আমার দেশ : গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে নিবর্তনমূলক আইনগুলোর ব্যাপারে আপনারা কী বলেছেন রিপোর্টে? এমন কতগুলো আইন আপনারা পেয়েছেন?

কামাল আহমেদ : গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে নিবর্তনমূলক অনেকগুলো আইন রয়েছে। এই আইনগুলো স্বাধীন সাংবাদিকতাকে ক্ষুণ্ণ করে, সাংবাদিকদের বিপক্ষে কাজ করে, কাজের কাজের জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। শুধু আইন নয়, কিছু নীতিমালাও রয়েছে, যেগুলো স্বাধীন সাংবাদিকতাকে বাধাগ্রস্ত করে। এসব আইন ও বিধির ক্ষেত্রে আমাদের সুস্পষ্ট সুপারিশ থাকবে।

আমার দেশ : বিগত আমলে আমাদের অনেক সাংবাদিক ও সম্পাদক জেল-জুলুম ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। এ ব্যাপারে রিপোর্টে কিছু আছে কি?

কামাল আহমেদ : বিগত সময়ে যারা নিবর্তনমূলক মামলায় হয়রানির শিকার হয়েছেন, তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত বলে আমরা প্রতিবেদনে বলেছি। যে প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদেরও ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত।

আমার দেশ : ডিএফপির সার্কুলেশন, মিডিয়া তালিকা ও বিজ্ঞাপন নিয়ে অসন্তোষ আছে। এ ব্যাপারে কী পদক্ষেপের কথা বলেছেন?

কামাল আহমেদ : প্রচারসংখ্যা, মিডিয়া তালিকা ও বিজ্ঞাপনের বিষয়ে আমাদের সুপারিশ থাকবে। আমরা চাই এটা যেন স্বচ্ছ হয়, জবাবদিহির আওতায় আসে। এটা যেন যাচাইযোগ্য হয়, যে প্রচারসংখ্যার কথা বলা হয়, তা সঠিক কি না, সেটা যাচাইয়ের ব্যবস্থা থাকতে হবে। এটাকে যেকোনোভাবে হোক যাচাইযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য করতে হবে।

আমার দেশ : সংবাদপত্র, বেসরকারি টিভি ও অনলাইন পোর্টালের ব্যাপারে আলাদা আলাদা সুপারিশ করেছেন কি? বিস্তারিত যদি একটু বলেন।

কামাল আহমেদ : কারো বিষয়ে আমাদের বিশেষ সুপারিশের বিষয় নেই। আমরা চাই স্বচ্ছতা, ন্যায্যতা ও সুষম প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র। এখানে যাতে কেউ একতরফাভাবে সুযোগ নিতে না পারে।

আমার দেশ : কমিশনের করা মিডিয়া জরিপে প্রাপ্ত ফলাফল গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এ জরিপ পর্যালোচনা করে বাংলাদেশের গণমাধ্যম সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?

কামাল আহমেদ : আমরা মনে করি একটি অত্যন্ত মূল্যবান জরিপ হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে জাতীয় পর্যায়ে কখনো কোনো সরকার মিডিয়া নিয়ে কোনো ধরনের জরিপ করেনি। গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা, এর প্রতি আস্থা, গণমাধ্যম কার ওপর নির্ভর করে—এর কোনো কিছুই কখনো যাচাই হয়নি। সেদিক থেকে এটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা অংশীজনের কাছ থেকেও এ রকম প্রত্যাশার কথা শুনেছি। অংশীজনেরা এই জরিপের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলেন। আমাদের কমিশন সেই প্রয়োজনীয়তা মেটাতে সক্ষম হয়েছে। সব মিলে বলব, এটা একটি মূল্যবান কাজ হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এটা পেশাদারত্বের জায়গা থেকে করেছে। এখানে কমিশন বা সরকারের কোনো এজেন্সির কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ ছিল না।

আমার দেশ : আপনি যেমনটি বলেছেন, শনিবার প্রধান উপদেষ্টার কাছে আমাদের চার মাসের কাজের ফসল তুলে দেবেন। কিন্তু এরপর এটা কতটা বাস্তবায়িত হলো, কতটা হলো না, সেটা কি দেখার সুযোগ আপনাদের আছে?

কামাল আহমেদ : প্রতিবেদন দেওয়ার পর কমিশন তো আর থাকবে না। কাজেই কমিশনের আনুষ্ঠানিক তদারকির কোনো সুযোগ নেই। সরকার হয়তো নতুন কোনো কমিশন বা কর্তৃপক্ষ করবে, যারা এটা দেখভাল করবে। তা ছাড়া সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নে যে ঐকমত্য কমিশন করা হয়েছে, তাদের ঘাড়েও এটা পড়তে পারে, যেটা হবে সবই সরকারের সিদ্ধান্ত। আমরা যেটা বলতে চাই, আমরা যেটা আশা করি, তা হলো এটা বাস্তবায়িত হবে। এই সরকার করবে, এরপর নির্বাচিত সরকারও করবে; কারণ আমরা এমন কোনো সুপারিশ করছি না, যেটা নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্কের অবকাশ আছে। আমরা এমন কিছু বলছি না, যেটা নিয়ে যেটা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একে অপরের সঙ্গে ঠেলাঠেলি করবে। আমরা যেগুলো বলেছি, সেগুলো রাজনৈতিক দলগুলোও বলেছে। তারা আমাদের কাছে লিখিতভাবে বলেনি, কিন্তু তাদের প্রকাশিত ঘোষণার মধ্যেও আছে যে, তারা সাংবাদিকদের সুরক্ষা দেবে, তারা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য কী কী করবে।

আমার দেশ : আপনার তরফ থেকে কোনো অনুভূতি প্রকাশ করতে চান কি?

কামাল আহমেদ : এখানে অনুভূতির কিছু নেই। আমরা কাজটি করেছি। আশা করি, এই কাজটি অর্থবহ হবে। এই কাজটিকে সরকার বাস্তবায়ন করবে। অংশীজনরা এটাকে গ্রহণ করবে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত