বাংলাদেশে জৈব কৃষির সম্ভাবনা

এস এম মুকুল
প্রকাশ : ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০: ০৯
ছবি: সংগৃহীত

ভেজালের ভিড়ে নিরাপদ খাদ্যের সন্ধানে সচেতনতা বাড়ছে নাগরিক সমাজে। এর প্রতিফলন হিসেবে প্রচুর অর্গানিক ফুড শপ গড়ে উঠছে। সুপারশপগুলোয় প্রাধান্য পাচ্ছে অর্গানিক পণ্য। আর এসব পণ্য জৈব কৃষির নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। বর্তমান বিশ্বে অর্গানিক কৃষিতে আগ্রহ বেড়েছে কৃষকদের। তবে বাংলাদেশে এর মাত্রা খুবই কম।

বিজ্ঞাপন

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অধিক উৎপাদনের আশায় দেশে উচ্চ ফলনশীল হাইব্রিড, জিএম শাকসবজিসহ অন্যান্য ফসল ও ফলমূল উৎপাদনে ঝুঁকছে কৃষক। এসব পদ্ধতিতে দফায় দফায় প্রয়োগ করা হয় বিষাক্ত কীটনাশক। আবার বাজারজাত করার আগে পাকানোর জন্য কার্বাইড ও পচন রোধে অতিমাত্রায় রাসায়নিক প্রয়োগ করা হচ্ছে। ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে শাকসবজি ও ফলমূলে মেশানো হচ্ছে নানা বিষাক্ত পদার্থ, যা ওইসব খাদ্যের সঙ্গে মানবদেহে প্রবেশ করছে। এসব খাদ্য খেয়ে কমে যাচ্ছে জীবনী শক্তি ও আয়ুষ্কাল। সঙ্গে শরীরে বাসা বাঁধছে নানা রোগব্যাধি।

এমন বাস্তবতায় জৈব কৃষি বা অর্গানিক চাষাবাদের কোনো বিকল্প দেখছেন না গবেষকরা। বিগত দুই দশকে জৈব কৃষির গতিশীল প্রসারের পরও বিশ্বের মাত্র এক শতাংশ কৃষিজমি জৈব কৃষিবিদ্যার আওতাধীন। সমালোচকদের মতে, জৈব কৃষিপদ্ধতিতে সমপরিমাণ শস্য উৎপাদনের জন্য প্রচলিত ব্যবস্থার চেয়ে অধিক কৃষিজমি প্রয়োজন।

সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক ও জৈব উপায়ে উৎপাদিত পণ্যকে অর্গানিক পণ্য বলে অভিহিত করা হয়। এ ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক খাবার, ভেষজ ও প্রাকৃতিক ওষুধ ব্যবহারের মাধ্যমে রোগবালাই দমন করা হয়। বিপণন পদ্ধতিতেও অনুসরণ করা হয় জৈবপ্রযুক্তি। বিশ্বব্যাপী অর্গানিক পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকৃত পোলট্রি, ডেইরি, মৎস্য এবং কৃষিজ পণ্যের ভোক্তা চাহিদা বাড়ছে। মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর উপাদানমুক্ত ও অধিক পুষ্টিসমৃদ্ধ অর্গানিক খাদ্যপণ্যের চাহিদা মেটানোয় এর উৎপাদন পদ্ধতিরও সম্প্রসারণ হচ্ছে।

ষাটের দশকে সবুজ বিপ্লবের নামে দেশে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকনির্ভর কৃষিব্যবস্থার সূচনা হয়। কিন্তু এই কৃষিকাজে অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার ও বিষ ব্যবহার করে মাটির উপকার অণুজীবগুলোকে ধ্বংস করা হয়। কৃষিজমির উর্বরতা শক্তি কমেছে। এসব বিষ জলাশয়গুলোয় জমে ধ্বংস করেছে সুস্বাদু দেশি মাছ, জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ। এই ক্ষতি আমাদের নিরাপদ খাদ্যের জন্য হুমকি। এ কারণে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদের জন্য কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা দরকার।

জৈব কৃষি এমন একটি আদর্শ পদ্ধতি, যা প্রকৃতির সঙ্গে সমন্বিত ও টেকসই। জৈব কৃষিতে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈবসার ব্যবহার করা হয়। এ ধরনের জৈবসারের উৎস হচ্ছে খামারজাত সার, কম্পোস্ট সার, আবর্জনা সার, কেঁচো সার, উদ্ভিদ ও জৈব উৎস থেকে পাওয়া অন্যান্য বর্জ্য পদার্থ, হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা, শুকনো রক্ত, হাড়ের গুঁড়া, সবুজ সার, অ্যাজোলা ও ছাই। জৈব কৃষি পদ্ধতিতে মাটি সব সময় উর্বর থাকে। জৈব কৃষিতে কিছু কিছু পাতা, কাণ্ড, ডাল, মূল বা বাকলের রস কীটনাশক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অনেক ধরনের গাছগাছড়া আছে—যেগুলো পশুপাখির নানা চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।

বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও অর্গানিক পণ্য উৎপাদনকারী সংস্থাগুলো বলছে, জৈব চাষের জন্য বাংলাদেশের জমি সবচেয়ে উপযুক্ত। তাদের মতে, বাংলাদেশের মাটির ভলিউম এবং সূর্যালোকের প্রাচুর্যের কারণেই খাদ্য উৎপাদনের পাশাপাশি সমানুপাতিক হারে বায়োমাস তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারে। ওয়ার্ল্ড ওয়াইড অপরচুনিটিস অন অর্গানিক ফার্মসের (ডব্লিউডব্লিউওওএফ-বাংলাদেশ) ওই উপস্থাপনায় বলা হয়, বাংলাদেশের আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ হওয়ায় এখানে প্রাকৃতিক কৃষি চাষাবাদের সম্ভাবনা অনেক বেশি। এখানে তাপমাত্রা কখনো মাইনাসের নিচে নামে না। ফলে সারা বছর প্রকৃতিতে জৈব উপাদানের প্রাচুর্য বজায় থাকে। এর ফলে গাছপালা পুষ্ট হয়, প্রকৃতিও সতেজ ও সবুজ থাকে।

এ আবহাওয়া কাজে লাগিয়ে ও প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করে প্রাকৃতিক চাষাবাদে অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারে বাংলাদেশ, যা সারা বিশ্বের জন্য মডেল হতে পারে। দক্ষিণ কোরিয়ার পালডাংয়ের জানজিতে অনুষ্ঠিত ১৭তম বিশ্ব অর্গানিক সম্মেলনের (ডব্লিউডব্লিউওওএফ-বাংলাদেশ) পক্ষ থেকে বাংলাদেশের জমির এ সম্ভাবনাময় দিকটি তুলে ধরা হয়। অর্গানিক পণ্য উৎপাদনের উপযুক্ত জমি হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চল, নদী ও উপকূলীয় চরাঞ্চল এবং বসতভিটার আঙিনা ও চারপাশ এবং নগর এলাকার বাড়িঘরের ছাদগুলো নির্বাচন করা যেতে পারে।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক গবেষণাপত্রে দেখা গেছে, দেশের জমির অন্তত ১০ শতাংশ অর্গানিক পণ্য উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত। বিশেষজ্ঞদের মতে, অর্গানিক পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে অর্গানিক সুগন্ধি চাল, শাকসবজি, ফল, মাশরুম, চা, অর্গানিক পাট, অর্গানিক মাছ ও অর্গানিক মাংস উৎপাদনের ক্ষেত্রেই বেশি নজর দিতে হবে। এ জন্য প্রথমেই প্রয়োজনীয় নীতিমালা ও আইনকানুন তৈরির জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

রাসায়নিক সারের পরিবর্তে উচ্চ পুষ্টিমানসম্পন্ন প্রযুক্তিতে উৎপাদিত জৈব সার সবজি ও ধানগাছে প্রয়োজনীয় ইউরিয়া, পটাশ ও ফসফেট সারের জোগান দেয়। আধা-কম্পোস্ট গোবর, মুরগির বিষ্ঠা, ধানের কুঁড়া, মাছ-মুরগির পাখনা ও পরিপাকতন্ত্র তথা পরিত্যক্ত অংশ একসঙ্গে করে জৈব কম্পোস্ট সার তৈরি করা হয়। জৈব সার প্রয়োগ করলে আর অতিরিক্ত ইউরিয়া, পটাশ ও টিএসপি সার প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না। এছাড়া মাটির উর্বরতা ও স্বাস্থ্য দীর্ঘস্থায়ী হয়। উৎপাদিত ফসল হয় স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ।

অর্গানিক ফার্মিং জমির জীব ও উদ্ভিদবৈচিত্র্য বাড়ায়, জমির উর্বরতা বৃদ্ধি করে। পাশাপাশি জমির প্রবল বৃষ্টিপাতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবিলা করার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণে জানা গেছে, যে জমিতে সর্বশেষ রাসায়নিক সার ব্যবহার করে চাষাবাদ করা হয়েছে, সেই জমি ন্যূনতম তিন বছর পতিত অবস্থায় ফেলে রাখলে বা আবার রাসায়নিক সার প্রয়োগ ছাড়া চাষ করলেই অর্গানিক খাদ্য উৎপাদন করা সম্ভব। কারণ চাষাবাদে ব্যবহৃত বহুল প্রচলিত রাসায়নিক সারের অবশিষ্টাংশ তিন বছরে ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।

অর্গানিক কৃষি পদ্ধতিতে সাফল্য পেয়েছে আফ্রিকার দেশ উগান্ডা। বর্তমানে দেশটির কৃষকরা ৭০-৮০ কোটি ডলারের অর্গানিক কৃষিপণ্য রপ্তানি করছেন। দক্ষিণ কোরিয়ার পালডাংয়ের জানজি এলাকাটি জৈব কৃষি চাষের জন্য বিখ্যাত। জানজির কৃষকদের সফলতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কৃষির টেকসই উন্নয়নে অর্গানিককে গুরুত্ব দিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে দেশটির সরকার।

‘দি ওয়ার্ল্ড অব অর্গানিক অ্যাগ্রিকালচার স্ট্যাটিসটিকস অ্যান্ড এমার্জিং ট্রেন্ড ২০১৮’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান অর্গানিক অ্যাগ্রিকালচার এফআইবিএল। এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান হতাশার। প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে আরো বলা হয়েছে, ২০১৩ সালের পর থেকে বাংলাদেশে অর্গানিক চাষাবাদের জমি বাড়ছে না। ২০১৬ সালে ১০১টি অর্গানিক চাষাবাদের প্রকল্প চালু ছিল বাংলাদেশে; যাতে ৯ হাজার ৩০৩ জন উদ্যোক্তা সম্পৃক্ত আছেন।

তবে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকার অর্গানিক চাষাবাদ বাড়াতে ‘ন্যাশনাল অর্গানিক অ্যাগ্রিকালচার পলিসি-২০১৬’ বাস্তবায়ন ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘ন্যাশনাল অর্গানিক স্ট্যান্ডার্ড বোর্ড’ গঠনের পরিকল্পনা নিয়েছে। বাংলাদেশে মাত্র ৬ হাজার ৮৬০ হেক্টর জমিতে অর্গানিক পণ্যের চাষাবাদ হচ্ছে, যা আবাদি জমির মাত্র দশমিক ১ শতাংশ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অর্গানিক চাষাবাদে এ অঞ্চলে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে চীন ও ভারত। তবে, সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে শ্রীলঙ্কা।

অর্গানিক কৃষিপ্রযুক্তিতে বাংলাদেশের অগ্রগতি একবারে কম নয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রত্যাশা—ভবিষ্যতে বিজ্ঞানভিত্তিক অর্গানিক পণ্যই বাংলাদেশের মানুষের খাদ্য চাহিদা মিটিয়ে সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত এবং বিদেশে রপ্তানি করে কোটি কোটি ডলার আয় করবে। এতে কৃষক পণ্যের অধিক মূল্য পাবেন এবং পরিবেশ ও প্রতিবেশও থাকবে দূষণমুক্ত।

বাংলাদেশ অর্গানিক প্রোডাক্ট ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যাসোসিয়েশনের (বিওপিএমএ) মাধ্যমে দেশের এক লাখ একর জমিকে অর্গানিক কৃষির আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে। পুরো দেশকে অর্গানিক কৃষির আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্যে কাজ করছে সংস্থাটি।

লেখক : কৃষি-অর্থনীতি বিশ্লেষক

ইমেইল : writetomukul36@gmail.com

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত