পিলখানা হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশবিরোধী ষড়যন্ত্র

এম গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়া
প্রকাশ : ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৩: ১০

এক. ২৫ ফেব্রুয়ারি বিডিআর বিদ্রোহ ও পিলখানা ট্র্যাজেডির ১৬তম বার্ষিকী। ২০০৯ সালের এই দিন ঢাকার পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের নাটক মঞ্চস্থ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার অতন্ত্র প্রহরী দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করে বাংলাদেশকে একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করার চক্রান্ত শুরু হয়েছিল। ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানা ট্র্যাজেডি ইতিহাসের ঘৃণীত অধ্যায়। সেদিন বাংলা হারিয়েছিল জাতির সূর্যসন্তানদের। বিডিআর বিদ্রোহের নেপথ্য-রহস্য জাতিকে বিগ ফ্যাসিবাদী শাসনকে জানতে দেয়নি। বর্তমান সরকারের ওপর প্রত্যাশা করতেই পারি, তারা বিডিআর বিদ্রোহের প্রকৃত রহস্য জাতিকে জানাবে। এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্‌ঘাটনে ঘটিত কমিশন নিরপেক্ষ ও নির্মোহভাবে কাজ করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে জাতিকে এর রহস্য জানাবে। সেই সঙ্গে সেনা হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য নায়কদেরও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করবে।

ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্রে বাংলাদেশের দীর্ঘ প্রায় ২০০ বছরের ঐতিহাসিক বিডিআরের চেতনাকে ধ্বংস করেছে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ২৩ মার্চ যে বাহিনী প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছিল, সেই বাহিনীকে করেছে কলঙ্কিত। শুধু বাংলাদেশ নয়, সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসে এত সেনা কর্মকর্তাকে নারকীয় হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানায়।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশের ওপর আধিপত্যবাদী শক্তির দখলদারিত্ব চিরস্থায়ী করতে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশই ছিল পিলখানা হত্যাকাণ্ড। এটি কোনো বিদ্রোহ ছিল না, ছিল পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বকে বিপন্ন করে দেশকে চোরাবালির সন্ধিক্ষণে দাঁড় করানো হয়েছিল।

২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বিডিআর বিদ্রোহের যে নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল, তা যে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বে ওপর চরম আঘাত, তা দিবালোকের মতো স্পষ্ট। ওইদিন বিডিআর সদর দপ্তরে সেনা কর্মকর্তাদের হত্যার মাধ্যমে যে বিপুল ক্ষতি হয়েছে, তা পূরণে বিশেষজ্ঞ মহল মনে করে ২০-২৫ বছর লেগে যাবে বাংলাদেশের। বাংলাদেশবিরোধী ষড়যন্ত্রকারীরা সে কাজটি সুচারুভাবে সম্পাদন করতে পেরেছিল তাদের অভ্যন্তরীণ দালালদের সহযোগতায় আর আমাদের জাতীয় ঐক্য না থাকার সুযোগে। এই হত্যাকাণ্ড তো বাংলাদেশের কারো লাভ হয়নি, তাহলে লাভ হয়েছে কাদের? তাদেরই যারা বাংলাদেশকে দেখতে চায় একটি অকার্যকর, দুর্বল, ভঙ্গুর ও ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চায় তাদেরই। সেনা কর্মকর্তাদের ওপর পরিচালিত এই গণহত্যায় নিঃসন্দেহে দুর্বল হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার অতন্ত্রপ্রহরী সেনাবাহিনী ও সীমান্ত রক্ষার জনগণের আস্থার স্থল বিডিআর। বিডিআরের বীরত্ব ও সাহসিকতা সর্বজনবিদিত।

২৫ ফেব্রুয়ারি বিডিআর বিদ্রোহের আগের দিন হঠাৎ করেই বাংলাদেশের সীমান্তে ভারতীয় বিএসএফ ভারী অস্ত্রশস্ত্রসহ নিরাপত্তা জোরদার করে তোলে। আমদানি-রপ্তানিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এ ঘটনা থেকে প্রশ্ন উদ্বেগ হওয়াটা স্বাভাবিক, তাহলে কি ভারত জানত পরদিন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কোনো ঘটনা ঘটছে? স্বাধীনতার পর থেকেই ভারতের অব্যাহত আগ্রাসনের কারণে বাংলাদেশ কখনো মাথা সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি।

স্বাধীনতার পরপরই বাংলাদেশকে একটি অকার্যকর ও ব্যর্থরাষ্ট্রে পরিণত করার যে চক্রান্ত, ধাপে ধাপে সে ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতায় ২০০৯ সালে ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় নির্মম হত্যাকাণ্ড, সেই ষড়যন্ত্রেরই অংশ। এই ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের ধারাবাহিকতায়ই বিডিআর বিদ্রোহের নাটক মঞ্চস্থ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বিডিআর দুটোকেই দুর্বল করে দিতে সক্ষম হয়েছে। সেনাবাহিনীর বিভিন্ন স্তরের এতগুলো কর্মকর্তাকে একসঙ্গে হত্যা কোনো কাকতালীয় ঘটনা কিংবা দুর্ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করার কোনো সুযোগ নেই। ৬৩ জন সামরিক কর্মকর্তাকে হত্যার মাধ্যমে সেনাবাহিনীর মেধা ও সক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। অন্যদিকে যে বিডিআর স্বাধীন বাংলাদেশে ৩৭ বছর ধরে অতন্ত্র প্রহরীরূপে সীমান্তে বিদেশি আগ্রাসন সফলভাবে প্রতিহত করেছে, সেই প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্ব মুছে গেছে। ঐতিহ্যবাহী বিডিআর এখন বিজেপি নাম ধারণ করেছে।

আর সীমান্তে প্রতিনিয়ত জোরদার হয়েছে ভারতীয় বিএসএফের আগ্রাসন। এখনো সীমান্তে প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের নাগরিককে নির্বিচারে হত্যা করছে ভারতীয় বিএসএফ। হত্যার পর ফেলানীকে লাল কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রেখে উল্লাস করেছে বিএসএফ। পিলখানার ঘটনা যে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে দুর্বল করে দেওয়ার জন্যই ঘটানো হয়েছিল, তা আজ দিবালোকের মতোই স্পষ্ট। এটি ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে ঠান্ডা মাথায় ষড়যন্ত্র। একধরনের প্রতিশোধও বটে।

বিডিআর ট্র্যাজেডির ১৬ বছর হলেও এখন পর্যন্ত এর প্রকৃত রহস্য জাতি জানতে পারেনি। দুটি তদন্ত কমিটি গঠন হলেও একটি তদন্ত কমিটির আংশিক প্রকাশ হলেও পুরোটা আজও জাতি জানে না। সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটির রিপোর্ট জাতি জানে না। দুঃখ ১৬ বছরে জাতীয়ভাবে ২৫ ফেব্রুয়ারিকে শোক দিবস হিসেবে পালন করতে পারিনি আমরা। রাজনৈতিক দলগুলো এখনো এ বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। প্রকারান্তরে ২৫ ফেব্রুয়ারি নিয়ে অনেক রাজনৈতিক দলের ভূমিকা দেখলে মনে হয় ভারত অখুশি হতে পারে বলেই তারা বিষয়টি এড়িয়ে চলেন।

২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানা ট্র্যাজেডির গতানুগতিক বিচারে কি প্রকৃত রহস্য উদ্‌ঘাটন হবে। জাতির স্বার্থেই এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করা উচিত। চিহ্নিত করে যদি অপরাধীদের বিচার করা সম্ভব না হয়, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আজকের নেতৃত্বে ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকবে। জাতির এই কলঙ্কজনক অধ্যায়কে মুছে ফেলতে প্রকৃত রহস্য উদ্‌ঘাটন করতে হবে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এতগুলো চৌকস কর্মকর্তাকে এক দিনে হত্যা করা জাতির স্বাধীন অস্তিত্বের জন্য কত বড় আঘাত, তা আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। ২৫ ফেব্রুয়ারি শুধু একটি হত্যাকাণ্ড নয়, এটি হলো বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের ওপর চরম আঘাত।

আমরা সেই সন্তানদের প্রতি লজ্জিত এবং দুঃখিত, যারা পিলখানার নারকীয় হত্যাকাণ্ডে তাদের বাবা-মা হারিয়েছেন, যারা স্বামী হারিয়েছেন। স্বজনহারা ওই পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা আমাদের জানা নেই। যেদিন এই হত্যাকাণ্ডের সঠিক বিচার হবে, সেদিন হয়তো স্বজনহারারা কিছুটা স্বস্তি পাবেন। জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে গঠিত সরকারের তদন্ত কমিশন জনগণের সেই আশা পূরণ করতে সক্ষম হবে বলে প্রত্যাশা করছি।

পিলখানা হত্যাকাণ্ডের বিচার নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সদিচ্ছা এবং প্রশাসনিক দক্ষতা ও সদিচ্ছা যেন প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোয় ঘাপটি মেরে থাকা স্বৈরাচারের দোসররা পুরো প্রক্রিয়াকে ধামাচাপা দিতে কিংবা ব্যাহত করতে সদা সক্রিয় রয়েছে। তা না হলে এমন একটি জাতীয় ট্র্যাজেডির সঙ্গে জড়িত এতগুলো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা কীভাবে দেশ ত্যাগ করার সুযোগ পেল! অনেক দেরিতে হলেও আ ল ম ফজলুর রহমানের মতো সাহসী সেনানায়ককে প্রধান করে নতুন তদন্ত কমিশন গঠনের দুদিনের মধ্যেই সাবেক বিজিবি মহাপরিচালককে বিদেশে যাওয়া বারিত করার মধ্য দিয়ে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনার তদন্ত নতুন মোড় নিয়েছে বলে দেশবাসী মনে করে।

পিলখানায় একটি পরিকল্পিত গণহত্যার ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে সেখানে ডাল-ভাত কর্মসূচি নিয়ে অসন্তোষ ও বিদ্রোহের প্রচারণা চালিয়ে প্রকৃত অপরাধী এবং মূল কুশীলবদের তদন্ত ও বিচারের বাইরে রাখা হয়েছিল। ভারতের পুতুল সরকারের পক্ষে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বিপ্লবের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত সরকারের এ বিষয়ে দায়সারা, গা-ছাড়া ভাব মেনে নেওয়া যায় না।

হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি ও পাচারের হোতাদের বিদেশে যাওয়ার সুযোগ দিয়ে পাচার করা অর্থ ফেরত আনা কতটা সফল হবে, তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়। শেখ হাসিনাসহ বিডিআর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত প্রভাবশালী কুশীলবদের যারা পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছে, তাদের বিষয়েও তদন্ত হওয়া দরকার বলে জনগণ মনে করে। অসম সাহসী সেনানায়ক আ ল ম ফজলুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত সাত সদস্যের তদন্ত কমিশন পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মূলহোতাদের বিচারসহ দেশি-বিদেশি চক্রান্তের মুখোশ উন্মোচন করতে সক্ষম হবে বলে আমরা আশাবাদী।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের নতুন সম্ভাবনাকে ব্যর্থ করে দেওয়ার ব্যাপক ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করতে হলে প্রথমেই পিলখানা হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন ও সুবিচার নিশ্চিত করতে হবে। পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতায় নবগঠিত তদন্ত কমিশন পিলখানা হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও বিচারে নতুন গতি আনতে সক্ষম হবে। দেশবাসী এবং শহীদ পরিবারের সদস্যরা এই হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচারের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দেশের নিরাপত্তার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

আমরা যদি ক্ষমতায় টিকে থাকতে কিংবা ক্ষমতায় যেতে আধিপত্যবাদী ও আগ্রাসী শক্তির কাছে নিজেদের বিবেক-বিবেচনা বন্ধক দিই, যদি আমরা পরাভূত হই সেই অপশক্তি ও অপশক্তির দালালদের কাছে, আপস করে ফেলী, তাহলে আমি নিশ্চিত ২৫ ফেব্রুয়ারির চেয়ে ভয়াবহ ঘটনার পুনরাবৃত্তি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। অপশক্তির লালনকারীরা ধারকে ও বাহকরা আরো উৎসাহিত হয়ে তাদের স্বার্থ চরিতার্থে আরো ভয়ংকর ঘটনা ঘটাবে, এ কথা দ্বিধাহীনভাবে বলা যায়। আর যারা আপস করবেন, তাদের স্থান হবে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। আপস করে হয়তো ক্ষমতায় টিকে থাকা যাবে কিংবা কিছু সময়ের জন্য ক্ষমতায় টিকে থাকা যাবে কিন্তু ইতিহাসে মীরজাফর হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে থাকতে হবে।

লেখক : রাজনীতিক ও কলামিস্ট, মহাসচিব, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ ও চেয়ারপারসন, ভয়েস অব কনসাস সিটিজেন-ভিসিসি

E-mail : gmbhuiyan@gmail.com

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত