রোহিঙ্গা সংকট: দরকার শরণার্থী নীতিমালা

ড. ইশরাত জাকিয়া সুলতানা
প্রকাশ : ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ১৮: ৫১

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে প্রধান উপদেষ্টা রোহিঙ্গা সমস্যার বিষয়টি তুলেছিলেন। তার বক্তব্য বিশ্বনেতৃত্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এর ফল হিসেবে রোহিঙ্গাদের জন্য তহবিল প্রাপ্তির আশ্বাস পাওয়া গেছে। রোহিঙ্গাদের সমস্যা নিয়ে প্রস্তাবিত সম্মেলন আয়োজনে জাতিসংঘ সম্মত হয়েছে। আরও আশার ব্যাপার হলো এই প্রথম রোহিঙ্গা-সংক্রান্ত বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে গত নভেম্বরে উপদেষ্টা পদমর্যাদার উচ্চ পর্যায়ের এক প্রতিনিধিকে সরকারিভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এটি ছিল একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এর পরও রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।

আন্তর্জাতিক তহবিল সংগ্রহ রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে কোনো সুখবর নয়। কারণ এটি বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়কে দীর্ঘস্থায়ী রূপদানে ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কর্মসংস্থানে সহায়ক। দাতা সংস্থা যত অর্থ দেবে, তত কর্মসূচি হাতে নেওয়া হবে। যত কর্মসূচি, তত তা বাস্তবায়নের জন্য জনবল নিয়োগ হবে। নতুন অফিস ও সাইনবোর্ডে সয়লাব কক্সবাজার আরও বেশি করে রিফিউজি-ট্যুরিজমের জন্যে জমজমাট হয়ে উঠবে। প্রশ্ন আসতে পারে, দাতাদের আর্থিক সহায়তা না হলে এত বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য ব্যয় মেটানো কি বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব? না, সম্ভব নয়। অর্থাৎ, বাংলাদেশ উভয় সংকটে।

বিজ্ঞাপন

২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভাপতি ইয়াংয়ের সঙ্গে আসন্ন সম্মেলন নিয়ে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা-বিষয়ক উচ্চ প্রতিনিধির বৈঠক থেকে ধারণা করা যায়, রেহিঙ্গা সংকট নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজনের জন্য বাংলাদেশ কাজ করছে। কিন্তু এ সম্মেলন আয়োজনে বাংলাদেশ কি প্রজ্ঞার সঙ্গে প্রস্তুতি নিচ্ছে, নাকি বিগত সরকারের অযোগ্য নীতিনির্ধারকদের দ্বারা সে প্রস্তুতি প্রভাবিত হচ্ছে? রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে সবচেয়ে আদর্শ সম্মেলন কেন্দ্র ঢাকা কিংবা কক্সবাজার। এরপর হতে পারে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, অথবা থাইল্যান্ড। এসব স্থানের বদলে যে দেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী ব্যবস্থাপনার কোনো অভিজ্ঞতা নেই, তাদের যখন সম্মেলনস্থল হওয়ার জন্য প্রস্তাব করা হয়, তখন বিষয়টি প্রশ্নের জন্ম দেয়। শরণার্থী সমস্যা সমাধানের উপায় কোনো সম্মেলন থেকে পাওয়ার নজির এখনও পৃথিবীতে নেই। তাই বলে আমরা হতাশও হতে চাই না। সম্মেলন কার্যকর হবে কি না, তার অধিকাংশ নির্ভর করছে বাংলাদেশ কতটুকু দেশের স্বার্থ মাথায় রেখে বাস্তবসম্মত প্রস্তুতি নিয়েছে।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা যে ক্ষীণতম, তা আমাদের নীতিনির্ধারকরা হয় বোঝেন না, বা বুঝলেও সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে চান না। আর এটিই হতে পারে সম্মেলনের উদ্দেশ্য অর্জন করতে না পারার কারণ। বাস্তবতা হচ্ছে, এখন পর্যন্ত জাতিসংঘ মিয়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গা-সংক্রান্ত বিষয়ে একটিবারের জন্যও আলোচনায় বসতে পারেনি। অথচ কয়েক বছর আগে উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সীমানা নির্ধারণ করে কাঁটাতার স্থাপন করায় জাতিসংঘের একাধিক সংস্থা বেশ সরব হয়ে উঠেছিল। দোর্দণ্ড প্রতাপের মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশও রোহিঙ্গা বিষয়ে কোনো কার্যকর আলোচনায় বসতে পারেনি। বরং ২০১৭ ও ২০১৮ সালে মোট যে তিনটি চুক্তিনামের বন্দোবস্ত করা হয়েছিল, সেগুলোয় মিয়ানমার (সঙ্গে চীনও বটে) বাংলাদেশকে বাধ্য করেছিল ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি উল্লেখ না করতে এবং তা বাংলাদেশের মেরুদণ্ডহীন সরকার করেওছিল। ‘গণহত্যা’ শব্দটি পর্যন্ত সেসব কাগুজে বন্দোবস্তে অনুল্লেখ ছিল। পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে বলা হয়েছিল, চুক্তিরূপী বন্দোবস্ত স্বাক্ষরের দুই মাসের মধ্যে প্রত্যাবাসন শুরু হবে। সাত বছরেও তা হয়নি। কারণ টেকসই প্রত্যাবাসনের শর্ত পূরণের জন্য মিয়ানমারকে দিয়ে বাংলাদেশের যা যা করানো প্রয়োজন ছিল, বাংলাদেশ তার কিছুই করতে পারেনি।

পট পরিবর্তন হলেও নীতিনির্ধারকরা আজও ‘প্রত্যাবাসন’ ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেন না। তাদের ধারণা, কোনোভাবে সীমান্তের ওপারে রোহিঙ্গাদের পাঠিয়ে দিতে পারলেই সমস্যার সমাধান সম্ভব। এরকম অলীক ভাবনার জগতে বাস বলেই তারা দূরদৃষ্টিহীন কূটনীতির মাধ্যমে সরকারতোষণ নীতি ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কৌশলগত ব্যর্থতা প্রমাণ করেছেন বারবার। মনোযোগ দিতে পারেননি প্রত্যাবাসনের পাশাপাশি আর কী করা যেতে পারে, সেদিকে। গুরুত্ব বুঝতে পারেননি মিয়ানমার-বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নয়নের প্রতি এবং দুদেশের ব্যবসায়িক সম্পর্ক জোরদারের প্রতি।

মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাত তথা গৃহযুদ্ধে টালমাটাল পরিস্থিতি, সে দেশের বহুসংখ্যক নৃগোষ্ঠীর ভিন্ন অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে ভিন্ন দাবি, ভূ-রাজনীতির জটিলতম সমীকরণ, মিয়ানমারের পতনোন্মুখ সামরিক শাসকের বিদায়ের ঘণ্টা বাজা ও আরাকান আর্মির বিজয়সংকেত ও বাংলাদেশের প্রতিবেশী বদল নিয়ে এরই মধ্যে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। শুধু যা নিয়ে আলোচনা হয়নি, তা হলো, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের শরণার্থী ব্যবস্থাপনার নীতিমালা কেন এখনও প্রণয়ন করা হয় না? কেন আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে? যে মিয়ানমারের জটিল, একমুখী ও উগ্র জাতীয়তাবাদী নীতিকে আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা টলাতে পারে না, প্রচণ্ডভাবে মুসলিমবিদ্বেষী মনোভাব যাদের জাতীয় চেতনার অংশ—কাকে নিয়ে কোন কৌশলে তাদের সঙ্গে দরকষাকষি করা যেতে পারে? মিয়ানমারে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের মিশন প্রতিষ্ঠা করা হলেও আজও কেন মিয়ানমার এত কাছের প্রতিবেশী হয়েও সবচেয়ে দূরের? তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো যৌথ গবেষণা কেন হয় না? এশিয়ার অন্য দেশের সঙ্গে যেমন সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যগত চেতনার বিনিময় হয়, তেমন কিছু বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মাঝে কেন হয় না? এ কাজগুলোর মাধ্যমে দুদেশের মাঝে একটা ‘অর্থপূর্ণ সম্পর্ক’ তৈরি করা কার দায়িত্ব ছিল? অবশ্য দায়িত্ব যাদের ছিল, তাদের অনেকেই আজ খোলস পাল্টে দিব্যি প্রচারমাধ্যমে কিংবা সভা-সেমিনারে বিজ্ঞোচিত মন্তব্য করছেন।

সবচেয়ে পরিতাপের বিষয়, রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আমরা আজ অবধি জাতীয় কোনো ঐকমত্য সৃষ্টি করতে পারিনি। একদিকে রাজনীতিবিদরা যেমন নির্বাচন ছাড়া আর কিছু নিয়ে ভাবতে নারাজ, অপরদিকে রোহিঙ্গা ‘বিশেষজ্ঞ’রা বিভাজিত হয়ে আছেন ভিন্ন মতে। কেউ মিনি-মার্শাল প্ল্যানের বুদ্ধি দিচ্ছেন তো কেউ রোহিঙ্গাদের অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত করে মিয়ানমারের সঙ্গে যুদ্ধ করার পরামর্শ দিচ্ছেন। এ রকম একটি গুরুতর জাতীয় ইস্যুতে মতৈক্য সৃষ্টির লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিদের ২০২৪ সালের নভেম্বরে প্রথমবারের মতো একত্র করেছিল নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু সেখানেও যে নেতারা খুব একটা ঐকমত্যে পৌঁছেছেন, তা বলার সুযোগ নেই। আবার বাংলাদেশের প্রায় পৌনে ৩০০ কিলোমিটার সীমান্তের সবটুকু যাদের দখলে, সেই আরাকান আর্মিকে ‘নন-স্টেট অ্যাক্টর’ হিসেবে তকমা দিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। যখন আরও মোক্ষম সময় ছিল, তখন স্বৈরাচারী সরকার আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগের উদ্যোগ নেয়নি। আজ যখন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলছেন, তারা রাষ্ট্রবিরোধী শক্তি, তাদের সঙ্গে কথা বলা যায় না, তখন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলছেন, আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে। একই সরকারে কী অদ্ভূত বৈপরীত্য!

রাষ্ট্রহীন রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়ে একখানা নোবেল বা মাদার অব হিউম্যানিটি খেতাব লাভের ধান্দাই কেবল করা হয়েছে, রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে সংকটের শুরু থেকে চেষ্টা করা হয়নি মোটেও। সেইসঙ্গে বিসর্জন দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের স্বার্থকে। আজ রোহিঙ্গা জনসংখ্যা উখিয়া-টেকনাফের জনসংখ্যাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। আশ্রয়দাতা-আশ্রিত উভয়ের মাঝে দা-কুমড়ো সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে। মিথ্যা জন্মসনদ দিয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি পরিচয়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। পরিবেশ-আইনশৃঙ্খলা বিপর্যয়ের কথা বলাই বাহুল্য। তবু আমরা বোকার মতো আশা করি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হবে।

বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে চিন্তাকে শরণার্থী-সংকট সমাধানের প্রথাগত প্রেসক্রিপশনের বাইরে নেওয়ার কথা কেউ বলছেন না। নিজের দেশ ও শরণার্থী – উভয়েই যে সংকটে ডুবে আছে, তা থেকে পরিত্রাণের জন্যে SEWP ফর্মুলা অনুসরণ করা যেতে পারে। রোহিঙ্গাদের Status অর্থাৎ ‘শরণার্থী’ পরিচয় দেওয়া, Education অর্থাৎ শিক্ষার সুযোগ দেওয়া, Work অর্থাৎ কাজের সুযোগ দেওয়া এবং সর্বোপরি Policy অর্থাৎ জাতীয় শরণার্থী নীতি প্রণয়ন করার বিষয়টি প্ল্যান-বি হিসেবে রাখার সময় এসেছে। আমাদের নীতিনির্ধারকরা প্রো-রোহিঙ্গা না হলেও যদি প্রো-বাংলাদেশ হতে পারেন, তাহলেও রোহিঙ্গা সংকট ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ বাস্তবানুগ পদক্ষেপ নিতে পারবে।

লেখক: শিক্ষক, নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত