জেলা প্রশাসন কি জবাবদিহির ঊর্ধ্বে?

অলিউল্লাহ নোমান
প্রকাশ : ০৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১৪: ০২

জেলা প্রশাসন হচ্ছে প্রতিটি জেলার সার্বিক তত্ত্বাবধানের একটি ইউনিট। জনগণের টাকায় জেলা প্রশাসনের বেতন-ভাতা হয়। তাদের নিয়োগ দেওয়া হয় রাষ্ট্রের কর্মচারী হিসেবে। রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। মালিকের সেবা করাই কর্মচারীদের মূল দায়িত্ব। কিন্তু বাংলাদেশে জেলা প্রশাসন কি মালিকের সেবা করে? নাকি মালিক শোষণ এবং হয়রানি করাই জেলা প্রশাসনের কাজ? জেলা প্রশাসকরা কি কখনও মনে করেন জনগণের সেবা করাই হচ্ছে তাদের দায়িত্ব! আচার-আচরণ দেখলে মনে হয় জেলা প্রশাসক হলেন জমিদার অথবা ব্রিটিশ রাজের লাট বাহাদুর। অধীনস্থ জেলার মানুষ হচ্ছেন তার প্রজা।

বিজ্ঞাপন

ব্রিটিশ আমলে জেলা প্রশাসন ছিল কালেক্টরের দায়িত্বে। খাজনা সংগ্রহ করে ব্রিটিশ রাজের কাছে পৌঁছানোই ছিল তাদের মূল দায়িত্ব। ব্রিটিশ আমল শেষ হয়েছে ১৯৪৭ সালে। পাকিস্তান আমল গেছে ১৯৭১ সালে। স্বাধীন বাংলাদেশেও জেলা প্রশাসন জনগণকে হয়রানির ব্রিটিশ আমলের ঐতিহ্য অত্যন্ত সফলার সঙ্গে ধরে রাখতে পেরেছে। রাষ্ট্রের মালিক কর্মচারীদের দ্বারা হয়রানির ব্রিটিশ পদ্ধতি বহাল রাখতে সক্ষম হওয়ায় জেলা প্রশাসন ধন্যবাদপ্রাপ্য।

গত ৫ আগস্ট বিপ্লবের পর মানুষের মনে আশা জেগেছিল ব্রিটিশ ঐতিহ্য রহিত হবে। রাষ্ট্রের মালিকের সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে যথাযথ ভূমিকা পালন করবে জেলা প্রশাসন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, শেখ হাসিনার পলায়নের মাধ্যমে রাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তি পরিবর্তন ছাড়া প্রশাসনের চরিত্র ছিটেফোঁটাও বদলায়নি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। পৌরসভাগুলোর দায়িত্ব জনপ্রতিনিধির পরিবর্তে এখন জেলা প্রশাসনের হাতে। এতে মানুষের হয়রানি বাড়ছে পদে পদে। পৌরসভাগুলোর নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে আগে মানুষ সহজে যেতে পারতেন। হাটে-ঘাটে দাঁড়িয়ে জনপ্রতিনিধিকে মানুষ তার অভিযোগের কথা বলতে পারতেন। এখন লাট বাহাদুর জেলা প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও দেখা করার সুযোগ মিলে না।

ওপরের কথাগুলো বলার কারণ রয়েছে। দীর্ঘ ১২ বছর পর আমার নিজ জেলা হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসনে গিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি। আমার অভিজ্ঞতা থেকে একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে।

হবিগঞ্জ প্রেস ক্লাবের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে অনুষ্ঠান। সহকর্মী সাংবাদিকরা দাওয়াত করেছিলেন। তাতে সারা দিয়ে নিজের জেলা শহরে যাই। অনেক স্মৃতি এই জেলা শহরের সঙ্গে জড়িত। ছাত্রজীবনে সরকারি বৃন্দাবন কলেজে পড়ার সময়ের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই শহরে। যেহেতু নিজ জেলা শহরে গিয়েছি। মনে করলাম একটি জরুরি বিষয়ে জেলা প্রশাসকের দৃষ্টি আকর্ষণ করি।

বিষয়টি হচ্ছে, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক চার লেন করা হবে। অনেক মানুষের পূর্বপুরুষদের জায়গা অধিগ্রহণ করা হবে চার লেন সম্প্রসারণের আওতায়। এর মধ্যে পাকা দালানও রয়েছে। এক পরিবারের দোতলা দালানের অংশবিশেষ এই অধিগ্রহণের আওতায় পড়েছে। জেলা প্রশাসনের দেওয়া সিরিয়াল অনুযায়ী এই বিল্ডিং নম্বর হচ্ছে ১০/১। জেলা প্রশাসন সিদ্ধান্ত নিয়েছে চারতলা ফাউন্ডেশনের এই দালান যতটুকু ভাঙা হবে, শুধু ততটুকুর ক্ষতিপূরণ দেবে। অথচ এই মৌজা বা আশপাশে আরও অনেকের দালানকোঠা অধিগ্রহণের আওতায় পড়েছে। অংশবিশেষ অধিগ্রহণের আওতায় পড়লেও প্রত্যেকেরই পুরো দালানের ক্ষতিপূরণের সিদ্ধান্ত দিয়েছে জেলা প্রশাসন। এমনটাই সরকারি সিদ্ধান্ত। কারণ দালানের অংশবিশেষ ভাঙা হলে পুরো নকশা বিনষ্ট হয়ে যায়। এই দালানের আর গুরুত্ব থাকে না তখন। ক্ষতিগ্রস্ত হন মালিক। একেবারেই ব্যতিক্রম ঘটনা এক পরিবারের সঙ্গে ঘটিয়েছে জেলা প্রশাসন। অংশবিশেষের ক্ষতিপূরণের বিষয়ে শুনে আমি নিজেও খোঁজ নিয়েছি। দেখলাম অন্য সবাই পুরো বিল্ডিং বা দালানের ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন। একটি পরিবারই এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম।

কেন এক পরিবার ব্যতিক্রম, এ বিষয়ে খোঁজ নিতেই মূলত জেলা প্রশাসকের দপ্তরে যাওয়া। আমার জীবনে হয়তো এটা তৃতীয়বারের মতো নিজের জেলা প্রশাসনের দপ্তরে গিয়েছি সেদিন। উদ্দেশ্য, বিষয়টি জেলা প্রশাসকের দৃষ্টি আকর্ষণ করব। তার কাছে জানতে চাইব ওই পরিবারের অপরাধটা কী? অন্য সবাই পুরো দালানের ক্ষতিপূরণ পেলেও একজন পাবেন না কেন?

দুপুরে শহরে পৌঁছেই প্রথমে যাই জেলা প্রশাসকের দপ্তরে। গিয়ে শুনলাম তিনি বাইরে একটি মিটিংয়ে গেছেন। দেরি না করে চলে এলাম। বিকালে হবিগঞ্জ প্রেস ক্লাবের অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠান শুরু হতে দেরি হচ্ছিল। পাশেই জেলা প্রশাসকের দপ্তর। মনে করলাম, যেহেতু অনুষ্ঠান দেরি হচ্ছে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে আবার ঢু দিয়ে আসি। প্রথমে স্থানীয় একজন সাংবাদিকের কাছ থেকে জেলা প্রশাসক বাহাদুরের ফোন নম্বর নিলাম। ভাবলাম খোঁজ নিয়ে যাই। দেখি আছেন নাকি অফিসে। একাধিকবার ফোন করলেও রিসিভ করার প্রয়োজন মনে করেননি তিনি। হতেই পারে ব্যস্ততার কারণে রিসিভ করতে সক্ষম হননি। ব্যর্থ হয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে একটা মেসেজ দিলাম। দেখা করার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করলাম মেসেজে। তাতেও কোনো উত্তর নেই। হবিগঞ্জের একটি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক, প্রবীণ সাংবাদিক হারুনুর রশিদ ভাই তখন বললেন, কাছেই তো। আসেন দেখে আসি আছেন কি না। আমিও যাই আপনার সঙ্গে। হারুন ভাই সঙ্গ দিলেন। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে পৌঁছে জানতে পারলাম একটি জুম-মিটিংয়ে আছেন। হারুন ভাই অফিস স্টাফের মাধ্যমে আমার পরিচয়সহ খবর পাঠালেন। কোনো উত্তর পাওয়া গেল না। মনে করলাম ঠিক আছে, চলে যাই। বারান্দায় বের হয়ে করিডরে দাঁড়িয়ে আরেকজনের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। এমন সময় হারুন ভাই বললেন, জেলা প্রশাসক বের হচ্ছেন। তিনি করিডর দিয়ে সামনে এগিয়ে সালাম দিলেন। সালামের জবাব দিয়েছেন কি না শুনতে পাইনি। তিনি হাঁটার ওপরেই আছেন। হাঁটার মধ্যেই হারুন ভাই আমাকে দেখিয়ে বললেন, উনি ঢাকা থেকে এসেছেন। আমার দেশ-এর সিনিয়র সাংবাদিক। পাত্তা না দিয়ে হাঁটতে থাকলেন। একটু আই কন্টাক্টেরও প্রয়োজন মনে করেননি তিনি। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে হারুন ভাই আবারও বললেন, স্যার ওনার বাড়ি হবিগঞ্জে। একটা বিষয়ে আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছিলেন। ডিসি সাহেব হাঁটতে হাঁটতে কী বললেন বোঝা গেল না। তিনি দ্রুতই নিচে নেমে গাড়িতে উঠে গেলেন।

পরে খোঁজ নিলাম তার সম্পর্কে। হবিগঞ্জের প্রতিটি মানুষ তার এমন আচরণে ত্যক্তবিরক্ত। জেলা প্রশাসক নিজেকে জমিদার হিসেবেই উপস্থাপন করছেন মানুষের সামনে। মুরব্বিদের মুখে শুনেছি, জমিদারের বাড়িতে প্রজারা গেলে চেয়ার না দিলেও মাটিতে বসতে বলতেন। জেলা প্রশাসকের মাটিতে বসিয়েও মানুষের কথা শোনার মানসিকতা নেই।

জেলা প্রশাসক বাহাদুরের কার্যালয় থেকে ফিরে হবিগঞ্জ প্রেস ক্লাবের অনুষ্ঠানে বসে অন্য সাংবাদিকদের সঙ্গে বিষয়টি শেয়ার করি। কেউ বিস্মিত হলেন না। সবাই বললেন, তার আচার-আচরণ এমন-ই। এই জেলা প্রশাসক নিজেকে জমিদারের চেয়েও বড় কিছু মনে করেন। তারা আরও বললেন, ৫ আগস্টের বিপ্লবের পর সরকারের পরিবর্তন এসেছে ঠিকই। তবে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি কমেনি। এ শহরে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বেড়ে গেছে। সাধারণ মানুষ শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ায় খুশি হওয়া ছাড়া আর কোনো ফায়দা পাননি।

এরপর আরও খোঁজ নিলাম। জানতে পারলাম, যাদের বিল্ডিং অংশবিশেষ অধিগ্রহণের আওতায় পড়েছে, তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়েছে জেলা প্রশাসন। মোটামুটি একটা বড় পার্সেন্টেজ নিয়ে পুরো বিল্ডিংয়ের ক্ষতিপূরণের রাষ্ট্রীয় নিয়ম পালন করেছেন। রাষ্ট্রীয় নিয়ম পালন করার জন্যই তার চাকরি। কিন্তু ঘুস না দিলে এই জেলা প্রশাসনে রাষ্ট্রীয় নিয়মটাও মানা হয় না। যে পরিবারের পক্ষ থেকে গিয়েছিলাম, তারা ন্যায্য পাওনার জন্য ঘুস দিয়ে নিতে রাজি নন। তাদের কথা হলো, নিয়মে যা আছে, তা পেতে ঘুস দিতে হবে কেন? গ্রামের মানুষ মনে করেন, আমি বড় সাংবাদিক। আমার কথা শুনলে হয়তো জেলা প্রশাসন রাষ্ট্রীয় নিয়ম পালন করবে। লজ্জা ঢাকতে সেদিনের এমন আচরণের কথা আর বলিনি। এখানে উল্লেখ্য, ঘুস লেনদেনের কোনো ডকুমেন্টস থাকে না। তাই এসব দুর্নীতিবাজ জেলা প্রশাসন জনগণকে জিম্মি করেও পার পেয়ে যান। আমার জেলায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক রাজস্ব হচ্ছে অধিগ্রহণের বিষয়ে দেখাশোনার দায়িত্বে। তিনি একটি বিশেষ ধর্মের নারী। এই বিশেষ ধর্মের লোকরা বাংলাদেশে টাকা কামাই করলেও বিনিয়োগ করেন ভারতে। সুতরাং তাদের ধরেও সম্পত্তির সন্ধান পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। তাহলে কি মানুষকে হয়রানি থেকে বাঁচার কোনো পথ নেই?

ন্যায্য পাওনার জন্য মানুষকে ধরনা দিতে হবে কেন? জেলা প্রশাসনই বা কেন এমন আচরণ করবেন সাধারণ মানুষের সঙ্গে? এসব লাট বাহাদুর জেলা প্রশাসকদের আচরণ আর কত বছর পর পরিবর্তন ঘটবে? সাধারণ মানুষের কি মুক্তি মিলবে না জেলা প্রশাসনের হয়রানি, ঘুস-দুর্নীতি থেকে? জেলা প্রশাসনের এমন ঘুস-দুর্নীতি রোধ ও রাষ্ট্রীয় নিয়ম পালনের জন্য তদারকির কোনো ব্যবস্থা আছে কি? ভুক্তভোগী নালিশ করবেন কোথায়? জেলা প্রশাসনের জবাবদিহি কার কাছে করতে হয়? নাকি তারা জবাবদিহির ঊর্ধ্বে?

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, আমার দেশ

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত