রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে লাভজনক করার উপায়

নিজাম উদ্দিন
প্রকাশ : ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০: ২৫
আপডেট : ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২: ১৪

বাংলাদেশ একটি দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি, যেখানে অবকাঠামো উন্নয়ন, শিল্পায়ন ও রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগের ভূমিকা অপরিসীম। কিন্তু বাস্তবতা হলো, দেশের অনেক রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান অদক্ষ ব্যবস্থাপনার কারণে লোকসানে চলছে। একই সঙ্গে সম্পদের অপচয় হচ্ছে এবং চলছে দুর্নীতি আর লুটপাট। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঠিক তদারকি ও ব্যবস্থাপনার জন্য চীনে রয়েছে ‘State-owned Assets Supervision and Administration Commission (SASAC)’ নামক ব্যবস্থা। চীনের মতো বাংলাদেশেও একটি কেন্দ্রীয় সংস্থা গঠন করা হলে রাষ্ট্রীয় সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। এটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর তদারকি, সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার এবং আধুনিক ব্যবসায়িক কাঠামো প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে।

২০০৩ সালে চীনে গঠিত হয় SASAC । এর উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর অদক্ষতা, দুর্নীতি ও ক্ষতির মোকাবিলা করে সুশাসন ও প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা বাড়ানো। SASAC গঠনের পর ৯৬টি বড় রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানকে চীন কেন্দ্রীয়ভাবে তদারকির আওতায় আনে। বাজারভিত্তিক অর্থনীতি গঠনের অংশ হিসেবে এটি রাষ্ট্রীয় সম্পদের সঠিক ব্যবস্থাপনা ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় চীনের প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থান শক্তিশালী করে। ফলে এসব প্রতিষ্ঠান চীনের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো অধিকতর দক্ষ ও লাভজনক হয়ে ওঠে।

বিজ্ঞাপন

বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৪৯টি বড় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থা রয়েছে, যা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত। এর মধ্যে রয়েছে—বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে পেট্রোবাংলা, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (BPDB), বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (BPC), শিল্প ও উৎপাদন খাতে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (BCIC), বাংলাদেশ স্টিল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (BSEC), পরিবহন ও অবকাঠামো খাতে বাংলাদেশ রেলওয়ে, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (BRTC), বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (BSC)। ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতে রয়েছে সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক ও রূপালী ব্যাংক। এসব প্রতিষ্ঠান জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও বাস্তবতা হলো—অনেক প্রতিষ্ঠান দক্ষতা ও আধুনিকায়নের অভাবে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বেশিরভাগ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান নিয়মিত লোকসানের মুখে পড়ছে এবং সরকারি অনুদানের ওপর নির্ভরশীল।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান সমস্যা হলো প্রশাসনিক সমন্বয়হীনতা। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের তদারকির কারণে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া ধীরগতির হয় এবং প্রশাসনিক জটিলতা তৈরি হয়। উদাহরণস্বরূপ, কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান বেসরকারি অংশীদারিত্বে গেলে তার নীতিগত অনুমোদন পেতে শিল্প মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদন প্রয়োজন হয়, যা সময়সাপেক্ষ এবং জটিল। এছাড়া রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোয় অদক্ষতা ও দুর্নীতি একটি বড় সমস্যা।

বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর বেশিরভাগই অদক্ষ ব্যবস্থাপনার কারণে লাভজনক হতে পারছে না। এসব প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও স্বজনপ্রীতির কারণে সম্পদের অপচয় হচ্ছে। পাশাপাশি প্রতিযোগিতার অভাবে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বাজারে টিকে থাকতে পারছে না, যেখানে বেসরকারি কোম্পানিগুলো আধুনিক প্রযুক্তি ও ব্যবসায়িক মডেলের মাধ্যমে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে।

এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন চীনের SASAC-এর আদলে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা।

এটি হলে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় কমানো, কার্যকারিতা বৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার উপযোগী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা সম্ভব হবে। এই সংস্থা গঠনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক কর্মক্ষমতা মূল্যায়ন ব্যবস্থা চালু করা যাবে, অদক্ষ প্রতিষ্ঠানগুলোর পুনর্গঠন করা হবে এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হবে। এছাড়া এটি রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোকে বাজারভিত্তিক মডেলে পরিচালিত করতে সহায়তা করবে, যাতে তারা শুধু সরকারি অনুদানের ওপর নির্ভর না করে বরং স্বয়ংসম্পূর্ণ ও লাভজনক হতে পারে।

SASAC গঠনের মাধ্যমে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুবিধা পাওয়া যাবে এবং প্রশাসনিক জটিলতা কমবে। তদুপরি এটি বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। যখন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো আধুনিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে শক্তিশালী হবে, তখন আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশের শিল্প খাতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবে।

SASAC-এর কাঠামো এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে এটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও দক্ষতা নিশ্চিত করতে পারে। এটি প্রধানমন্ত্রীর অধীনে পরিচালিত হতে পারে, যেখানে অর্থ মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা কমিশন এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধিরা থাকবেন। বিভিন্ন খাতে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থাগুলোর উন্নয়নের জন্য পৃথক বিভাগ থাকবে, যেমন বিদ্যুৎ, শিল্প, পরিবহন, ব্যাংকিং ও বিনিয়োগ নীতি তদারকির জন্য বিশেষায়িত শাখা।

SASAC বাস্তবায়নে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যেমন রাজনৈতিক প্রভাব, প্রশাসনিক বাধা ও কিছু প্রতিষ্ঠানের প্রতিবাদ। এছাড়া দক্ষ জনবল ও প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতাও একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হতে পারে। তবে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের পরামর্শ গ্রহণ করে নীতিনির্ধারণ করা, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের জন্য ধাপে ধাপে আধুনিক ব্যবসায়িক মডেল বাস্তবায়ন করা এবং সুশাসন ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে নিরীক্ষা ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা বৃদ্ধি করা অপরিহার্য। আর এজন্য এখন দরকার চীনের আদলে SASAC গঠন করা।

লেখক: ইঞ্জিনিয়ার; সিনিয়র ম্যানেজার, চায়না ন্যাশনাল কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লি. (সিএনসিইসি)

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত