ইঞ্জিনিয়ার নিজাম উদ্দিন
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে শিল্প ও কৃষির অপরিসীম সম্ভাবনা রয়েছে, যা আমাদের ভৌগোলিক অবস্থান, প্রাকৃতিক সম্পদ এবং জনসংখ্যার গুণগত ব্যবহারের মাধ্যমে কাজে লাগানো সম্ভব। আমাদের উর্বর মাটি ও কৃষি উৎপাদন সক্ষমতা আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে বহুগুণ বাড়ানো সম্ভব, যেখানে স্মার্ট এগ্রিকালচার, এগ্রো-প্রসেসিং এবং বায়ো-টেক গবেষণা নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। দেশের ২০ কোটি মানুষের বিশাল বাজার, দ্রুত বিকাশমান মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং তরুণ উদ্যোক্তা সংস্কৃতি স্থানীয় শিল্প ও রপ্তানি খাতে ব্যাপক সুযোগ তৈরি করছে। শিল্প খাতে, বিশেষ করে পেট্রোকেমিক্যাল, স্পেশালিটি কেমিক্যাল, ফার্মাসিউটিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে বাংলাদেশ আমদানি-নির্ভরতা কমিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।
আমাদের সমুদ্রসম্পদ ও বঙ্গোপসাগরের বিশাল জলভাগ একটি নতুন সম্ভাবনাময় খাত, যেখানে মেরিন ফিশিং, অফশোর গ্যাস অনুসন্ধান ও আন্তর্জাতিক বন্দর সুবিধা দেশের অর্থনীতিকে আরো গতিশীল করতে পারে। ডিজিটাল ইকোনমি, সফটওয়্যার, ফিনটেক এবং এআইভিত্তিক শিল্প আমাদের তরুণদের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। পাশাপাশি, কানেকটিভিটি বৃদ্ধি, রেল ও সড়ক অবকাঠামোর উন্নয়ন এবং পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ বিনিয়োগ আকর্ষণের নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে। আমাদের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী যদি সঠিক প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জন করতে পারে, তাহলে বাংলাদেশ দ্রুত একটি শক্তিশালী, প্রযুক্তিনির্ভর এবং আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতিতে পরিণত হতে পারে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যা ক্ষুধা ও দারিদ্র্য দূর করে দেশকে উন্নত ও সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাবে। আমাদের দেশ প্রাকৃতিক সম্পদ ও ভৌগোলিক বৈচিত্র্যে ভরপুর যা সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে কাজে লাগানো গেলে অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসতে পারে। আল্লাহ আমাদের উর্বর মাটি, বিশাল জলসম্পদ এবং বঙ্গোপসাগরের নবগঠিত ভূমি দিয়ে এক অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছেন। কিন্তু আমরা এখনো এর পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করতে পারিনি।
প্রতি বছর বঙ্গোপসাগরে প্রায় ২০-৩০ বর্গ কিলোমিটার নতুন ভূমি জাগছে যা পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার অভাবে অনাবাদি অবস্থায় পড়ে থাকে। এসব জমিকে কৃষি, বনায়ন এবং শিল্পোন্নয়নের আওতায় আনতে পারলে খাদ্য উৎপাদন, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং শিল্প খাতে নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি হবে। এই ভূমিকে চাষযোগ্য করে কৃষি সম্প্রসারণ করা গেলে দেশের খাদ্য উৎপাদন বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে যা অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি করবে।
এছাড়া বনায়নের মাধ্যমে কাঠ ও আসবাবপত্র শিল্পকে বিকশিত করা সম্ভব। বাংলাদেশ প্রতি বছর শত শত কোটি টাকার পেপার পাল্প আমদানি করে। অথচ আমরা যদি এসব ভূমিতে বাঁশ ও কাগজ উৎপাদনের উপযোগী গাছ রোপণ করি, তবে আমাদের শিল্প খাতে কাঁচামালের অভাব দূর এবং রপ্তানি করাও সম্ভব হবে। এই কাঠ থেকে আবার তৈরি হয় গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক উপাদান কার্বক্সি মিথাইল সেলুলোজ যা আমরা টেক্সটাইল প্রিন্টিংয়ে ব্যবহার করি। তা ছাড়া নাইট্রো সেলুলোজ যা প্রতিরক্ষা খাতসহ সেলুলোজ কাগজ, কটন, বায়োফুয়েল, ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্য এবং পলিমার ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যবহৃত হয়। সেলুলোজ থেকে বায়োএথানল তৈরি করা যেতে পারে, যা নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস হিসেবে ব্যবহার হয়। এটি ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্য যা ক্যাপসুল এবং ট্যাবলেট তৈরিতেও ব্যবহৃত হয়।
বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পেও বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে বহুমূল্য ভেষজ উপাদান বিদেশ থেকে আমদানি করি, অথচ দেশেই জিংকো বিলোবা, অশ্বগন্ধা, স্পিরুলিনা ও অন্যান্য ঔষধি গাছ ব্যাপকভাবে চাষ করা সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের দেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো প্রতি কেজি জিংকো বিলোবা নির্যাস ১০-১৫ হাজার টাকায় আমদানি করে যা থেকে তৈরি ওষুধের মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ১ লাখ থেকে দেড় লাখ টাকা। এই গাছ যদি দেশেই উৎপাদন করা যায়, তাহলে আমাদের ফার্মাসিউটিক্যাল খাত স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে এবং রপ্তানির সম্ভাবনাও তৈরি হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী ও টেকসই করতে কৃষি ও শিল্পের সমন্বয় ঘটানো অত্যন্ত জরুরি।
উদাহরণ হিসেবে স্টার্চ বা গ্লুকোজ উৎপাদনের কথা ধরা যাক। স্টার্চ তৈরি হয় ভুট্টা কিংবা আলু থেকে যা কৃষকরা প্রচুর উৎপাদন করতে পারেন। একটি মাঝারি মানের স্টার্চ কারখানা স্থাপন করা গেলে সেটি চালানোর জন্য শত শত একর জমিতে চাষাবাদ প্রয়োজন হবে, যা হাজারো কৃষকের আয় ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। শুধু স্টার্চ উৎপাদনেই সীমাবদ্ধ না থেকে গ্লুকোজ, ল্যাকটিক অ্যাসিড, সরবিটল এবং আরো বহু কেমিক্যাল উৎপাদন সম্ভব যা খাদ্য, ওষুধ ও প্রসাধন শিল্পের অন্যতম উপাদান।
কৃষিকে সরাসরি ওষুধ শিল্পের সঙ্গে সংযুক্ত করাও একটি বিশাল সম্ভাবনাময় খাত। বাংলাদেশে ওষুধ শিল্প দ্রুত বিকশিত হচ্ছে; কিন্তু অধিকাংশ ঔষধি কাঁচামাল আমদানিনির্ভর। কৃষিকে ভেষজ ওষুধ ও বায়ো-ফার্মাসিউটিক্যাল খাতে আনা গেলে তাতে শুধু আমদানি-নির্ভরতা কমবে না; বরং রপ্তানির নতুন সুযোগ তৈরি হবে। উদাহরণস্বরূপ, জিংকো বিলোবা, অশ্বগন্ধা, তুলসী, নিম, অ্যালোভেরা এবং অন্যান্য ঔষধি গাছ ব্যাপকভাবে চাষ করলে আমাদের ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্প দেশীয় কাঁচামালের ওপর নির্ভর করতে পারবে।
শুধু তা-ই নয়, সুগন্ধি শিল্পের জন্য লেমন গ্রাস, গোলাপ, ল্যাভেন্ডার, চন্দন এবং অন্যান্য সুগন্ধি গাছ উৎপাদন করা সম্ভব, যা আন্তর্জাতিক বাজারে অত্যন্ত চাহিদাসম্পন্ন। বাংলাদেশে যদি পরিকল্পিতভাবে কৃষিকে শিল্পের সঙ্গে সংযুক্ত করা যায়, তাহলে দেশীয় কৃষিপণ্য ও শিল্প কাঁচামালের এক বিশাল জোগান তৈরি হবে, যা দেশের শিল্পের বিকাশ, আমদানিব্যয় হ্রাস এবং কৃষকদের অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করবে। এই সমন্বয় করা অর্থনৈতিক মডেল বাস্তবায়ন করতে পারলে বাংলাদেশ শুধু কৃষিপ্রধান দেশ নয়, বরং কৃষি-শিল্প সমন্বিত শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খাত হলো বাংলাদেশে আতর উৎপাদন একটি কৃষিভিত্তিক ও কেমিক্যাল প্রসাধন শিল্পের সমন্বয়ে সম্ভাবনাময় খাত। আগর গাছ থেকে আতর সংগ্রহের প্রক্রিয়া রাসায়নিক, যা একটি কেমিক্যাল শিল্পের অংশ। বাংলাদেশে আগর গাছের চাষ করা হয় এবং এটি মধ্যপ্রাচ্যসহ আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি হয়। অন্যদিকে, ঝিনাইদহসহ বিভিন্ন জেলায় ফুল চাষ হয়ে থাকে, যেখানে ফুল থেকে দ্রাবক নিষ্কাশন প্রক্রিয়ায় সুগন্ধি পৃথক করে বিভিন্ন প্রসাধনী উৎপাদন সম্ভব। এসব প্রসাধনী দেশের চাহিদা মিটিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি করা যেতে পারে। ফুল চাষের সঙ্গে আরেকটি লাভজনক উৎস হচ্ছে মধু চাষ। ফুলের সুগন্ধি দ্রাবক নিষ্কাশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিয়ে দেশের শিল্প খাতের গুরুত্বপূর্ণ প্রসাধনীর চাহিদা মেটানো যেতে পারে। এই কৃষি ও কেমিক্যাল শিল্পের সংমিশ্রণ দেশের অর্থনীতিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে।
সাগর এদেশের জন্য এক বিশাল সম্ভাবনা। বঙ্গোপসাগরের বিশাল এলাকা শুধু তেল-গ্যাসের খনি হিসেবেই পরিচিত নয়Ñ এটি মাছ, রত্ন এবং অন্যান্য সম্পদেও ভরপুর। সমুদ্রের গভীরে জমাটবাঁধা মিথেন হাইড্রেট আছে যা শক্তির উৎস হিসেবে ব্যবহার হতে পারে। এর পাশাপাশি পাওয়া যায় নানা ধরনের বিশেষ শৈবাল যা রপ্তানির সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারে। সমুদ্রের মাছ থেকে কডলিভার তেল সংগ্রহ করে তা বাজারজাত করা সম্ভব, যা আমাদের দেশের স্থানীয় ওষুধের কাঁচামালের জোগান দিতে সহায়তা করবে। পাশাপাশি এই প্রক্রিয়ায় রপ্তানির সুযোগও বৃদ্ধি পাবে। মাছ চাষ ও আহরণকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে পারে অসংখ্য মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা।
এবার আসি সমুদ্রকেন্দ্রিক কৃষি ও শিল্পের সমন্বয় নিয়ে। এদেশের লবণ চাষ একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত যা কৃষি ও শিল্পের সংমিশ্রণে অর্থনীতির নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। এটি শুধু কৃষিভিত্তিক উৎপাদন নয়, বরং প্রসেসিং, কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি এবং রপ্তানি বাজারের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত একটি সম্ভাবনাময় শিল্প। সঠিক পরিকল্পনা ও প্রযুক্তির প্রয়োগ নিশ্চিত করা গেলে এটি দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। বাংলাদেশে কস্টিক সোডা ও ক্লোরিন উৎপাদন শিল্পের জন্য বছরে ৪ থেকে ৪ লাখ ৫০ হাজার টন অপরিশোধিত লবণ আমদানি করা হয়। ২০২২ সালের একটি তথ্যমতে, লবণ আমদানিতে প্রতি টনে খরচ হয় ৪৫ ডলার। যদি লবণ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এই লবণ নিজেদের উৎপাদন থেকে আমদানি করে, তাহলে খরচ হবে ৩০ ডলার, যার ফলে প্রতি টনে ১৫ ডলার সাশ্রয় হবে।
স্মার্ট ইরিগেশন, উন্নত বাষ্পীভবন ও ন্যানো ফিল্টারেশন প্রযুক্তির মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বাড়ানো সম্ভব। কাঁচা লবণের পরিবর্তে রিফাইন্ড, আয়োডাইজড ও ফার্মাসিউটিক্যাল গ্রেড লবণ উৎপাদন করলে বাজারমূল্য কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি সোডিয়াম ক্লোরাইড, সোডিয়াম কার্বোনেট ও ক্লোর-অ্যালকালি ইন্ডাস্ট্রির মাধ্যমে কেমিক্যাল শিল্পের প্রসার ঘটানো যেতে পারে। উন্নতমানের লবণ উৎপাদন করে ভারত, চীন ও মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে প্রবেশ করা সম্ভব, যা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ তৈরি করবে। সঠিক পরিকল্পনা, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও বিনিয়োগ নিশ্চিত করা গেলে লবণ খাত বাংলাদেশের অন্যতম সম্ভাবনাময় শিল্পে পরিণত হতে পারে।
লেখক : সিনিয়র ম্যানেজার, চায়না ন্যাশনাল কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লি. (সিএনসিইসি)
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে শিল্প ও কৃষির অপরিসীম সম্ভাবনা রয়েছে, যা আমাদের ভৌগোলিক অবস্থান, প্রাকৃতিক সম্পদ এবং জনসংখ্যার গুণগত ব্যবহারের মাধ্যমে কাজে লাগানো সম্ভব। আমাদের উর্বর মাটি ও কৃষি উৎপাদন সক্ষমতা আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে বহুগুণ বাড়ানো সম্ভব, যেখানে স্মার্ট এগ্রিকালচার, এগ্রো-প্রসেসিং এবং বায়ো-টেক গবেষণা নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। দেশের ২০ কোটি মানুষের বিশাল বাজার, দ্রুত বিকাশমান মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং তরুণ উদ্যোক্তা সংস্কৃতি স্থানীয় শিল্প ও রপ্তানি খাতে ব্যাপক সুযোগ তৈরি করছে। শিল্প খাতে, বিশেষ করে পেট্রোকেমিক্যাল, স্পেশালিটি কেমিক্যাল, ফার্মাসিউটিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে বাংলাদেশ আমদানি-নির্ভরতা কমিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।
আমাদের সমুদ্রসম্পদ ও বঙ্গোপসাগরের বিশাল জলভাগ একটি নতুন সম্ভাবনাময় খাত, যেখানে মেরিন ফিশিং, অফশোর গ্যাস অনুসন্ধান ও আন্তর্জাতিক বন্দর সুবিধা দেশের অর্থনীতিকে আরো গতিশীল করতে পারে। ডিজিটাল ইকোনমি, সফটওয়্যার, ফিনটেক এবং এআইভিত্তিক শিল্প আমাদের তরুণদের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। পাশাপাশি, কানেকটিভিটি বৃদ্ধি, রেল ও সড়ক অবকাঠামোর উন্নয়ন এবং পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ বিনিয়োগ আকর্ষণের নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে। আমাদের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী যদি সঠিক প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জন করতে পারে, তাহলে বাংলাদেশ দ্রুত একটি শক্তিশালী, প্রযুক্তিনির্ভর এবং আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতিতে পরিণত হতে পারে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যা ক্ষুধা ও দারিদ্র্য দূর করে দেশকে উন্নত ও সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাবে। আমাদের দেশ প্রাকৃতিক সম্পদ ও ভৌগোলিক বৈচিত্র্যে ভরপুর যা সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে কাজে লাগানো গেলে অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসতে পারে। আল্লাহ আমাদের উর্বর মাটি, বিশাল জলসম্পদ এবং বঙ্গোপসাগরের নবগঠিত ভূমি দিয়ে এক অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছেন। কিন্তু আমরা এখনো এর পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করতে পারিনি।
প্রতি বছর বঙ্গোপসাগরে প্রায় ২০-৩০ বর্গ কিলোমিটার নতুন ভূমি জাগছে যা পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার অভাবে অনাবাদি অবস্থায় পড়ে থাকে। এসব জমিকে কৃষি, বনায়ন এবং শিল্পোন্নয়নের আওতায় আনতে পারলে খাদ্য উৎপাদন, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং শিল্প খাতে নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি হবে। এই ভূমিকে চাষযোগ্য করে কৃষি সম্প্রসারণ করা গেলে দেশের খাদ্য উৎপাদন বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে যা অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি করবে।
এছাড়া বনায়নের মাধ্যমে কাঠ ও আসবাবপত্র শিল্পকে বিকশিত করা সম্ভব। বাংলাদেশ প্রতি বছর শত শত কোটি টাকার পেপার পাল্প আমদানি করে। অথচ আমরা যদি এসব ভূমিতে বাঁশ ও কাগজ উৎপাদনের উপযোগী গাছ রোপণ করি, তবে আমাদের শিল্প খাতে কাঁচামালের অভাব দূর এবং রপ্তানি করাও সম্ভব হবে। এই কাঠ থেকে আবার তৈরি হয় গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক উপাদান কার্বক্সি মিথাইল সেলুলোজ যা আমরা টেক্সটাইল প্রিন্টিংয়ে ব্যবহার করি। তা ছাড়া নাইট্রো সেলুলোজ যা প্রতিরক্ষা খাতসহ সেলুলোজ কাগজ, কটন, বায়োফুয়েল, ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্য এবং পলিমার ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যবহৃত হয়। সেলুলোজ থেকে বায়োএথানল তৈরি করা যেতে পারে, যা নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস হিসেবে ব্যবহার হয়। এটি ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্য যা ক্যাপসুল এবং ট্যাবলেট তৈরিতেও ব্যবহৃত হয়।
বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পেও বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে বহুমূল্য ভেষজ উপাদান বিদেশ থেকে আমদানি করি, অথচ দেশেই জিংকো বিলোবা, অশ্বগন্ধা, স্পিরুলিনা ও অন্যান্য ঔষধি গাছ ব্যাপকভাবে চাষ করা সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের দেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো প্রতি কেজি জিংকো বিলোবা নির্যাস ১০-১৫ হাজার টাকায় আমদানি করে যা থেকে তৈরি ওষুধের মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ১ লাখ থেকে দেড় লাখ টাকা। এই গাছ যদি দেশেই উৎপাদন করা যায়, তাহলে আমাদের ফার্মাসিউটিক্যাল খাত স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে এবং রপ্তানির সম্ভাবনাও তৈরি হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী ও টেকসই করতে কৃষি ও শিল্পের সমন্বয় ঘটানো অত্যন্ত জরুরি।
উদাহরণ হিসেবে স্টার্চ বা গ্লুকোজ উৎপাদনের কথা ধরা যাক। স্টার্চ তৈরি হয় ভুট্টা কিংবা আলু থেকে যা কৃষকরা প্রচুর উৎপাদন করতে পারেন। একটি মাঝারি মানের স্টার্চ কারখানা স্থাপন করা গেলে সেটি চালানোর জন্য শত শত একর জমিতে চাষাবাদ প্রয়োজন হবে, যা হাজারো কৃষকের আয় ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। শুধু স্টার্চ উৎপাদনেই সীমাবদ্ধ না থেকে গ্লুকোজ, ল্যাকটিক অ্যাসিড, সরবিটল এবং আরো বহু কেমিক্যাল উৎপাদন সম্ভব যা খাদ্য, ওষুধ ও প্রসাধন শিল্পের অন্যতম উপাদান।
কৃষিকে সরাসরি ওষুধ শিল্পের সঙ্গে সংযুক্ত করাও একটি বিশাল সম্ভাবনাময় খাত। বাংলাদেশে ওষুধ শিল্প দ্রুত বিকশিত হচ্ছে; কিন্তু অধিকাংশ ঔষধি কাঁচামাল আমদানিনির্ভর। কৃষিকে ভেষজ ওষুধ ও বায়ো-ফার্মাসিউটিক্যাল খাতে আনা গেলে তাতে শুধু আমদানি-নির্ভরতা কমবে না; বরং রপ্তানির নতুন সুযোগ তৈরি হবে। উদাহরণস্বরূপ, জিংকো বিলোবা, অশ্বগন্ধা, তুলসী, নিম, অ্যালোভেরা এবং অন্যান্য ঔষধি গাছ ব্যাপকভাবে চাষ করলে আমাদের ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্প দেশীয় কাঁচামালের ওপর নির্ভর করতে পারবে।
শুধু তা-ই নয়, সুগন্ধি শিল্পের জন্য লেমন গ্রাস, গোলাপ, ল্যাভেন্ডার, চন্দন এবং অন্যান্য সুগন্ধি গাছ উৎপাদন করা সম্ভব, যা আন্তর্জাতিক বাজারে অত্যন্ত চাহিদাসম্পন্ন। বাংলাদেশে যদি পরিকল্পিতভাবে কৃষিকে শিল্পের সঙ্গে সংযুক্ত করা যায়, তাহলে দেশীয় কৃষিপণ্য ও শিল্প কাঁচামালের এক বিশাল জোগান তৈরি হবে, যা দেশের শিল্পের বিকাশ, আমদানিব্যয় হ্রাস এবং কৃষকদের অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করবে। এই সমন্বয় করা অর্থনৈতিক মডেল বাস্তবায়ন করতে পারলে বাংলাদেশ শুধু কৃষিপ্রধান দেশ নয়, বরং কৃষি-শিল্প সমন্বিত শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খাত হলো বাংলাদেশে আতর উৎপাদন একটি কৃষিভিত্তিক ও কেমিক্যাল প্রসাধন শিল্পের সমন্বয়ে সম্ভাবনাময় খাত। আগর গাছ থেকে আতর সংগ্রহের প্রক্রিয়া রাসায়নিক, যা একটি কেমিক্যাল শিল্পের অংশ। বাংলাদেশে আগর গাছের চাষ করা হয় এবং এটি মধ্যপ্রাচ্যসহ আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি হয়। অন্যদিকে, ঝিনাইদহসহ বিভিন্ন জেলায় ফুল চাষ হয়ে থাকে, যেখানে ফুল থেকে দ্রাবক নিষ্কাশন প্রক্রিয়ায় সুগন্ধি পৃথক করে বিভিন্ন প্রসাধনী উৎপাদন সম্ভব। এসব প্রসাধনী দেশের চাহিদা মিটিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি করা যেতে পারে। ফুল চাষের সঙ্গে আরেকটি লাভজনক উৎস হচ্ছে মধু চাষ। ফুলের সুগন্ধি দ্রাবক নিষ্কাশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিয়ে দেশের শিল্প খাতের গুরুত্বপূর্ণ প্রসাধনীর চাহিদা মেটানো যেতে পারে। এই কৃষি ও কেমিক্যাল শিল্পের সংমিশ্রণ দেশের অর্থনীতিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে।
সাগর এদেশের জন্য এক বিশাল সম্ভাবনা। বঙ্গোপসাগরের বিশাল এলাকা শুধু তেল-গ্যাসের খনি হিসেবেই পরিচিত নয়Ñ এটি মাছ, রত্ন এবং অন্যান্য সম্পদেও ভরপুর। সমুদ্রের গভীরে জমাটবাঁধা মিথেন হাইড্রেট আছে যা শক্তির উৎস হিসেবে ব্যবহার হতে পারে। এর পাশাপাশি পাওয়া যায় নানা ধরনের বিশেষ শৈবাল যা রপ্তানির সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারে। সমুদ্রের মাছ থেকে কডলিভার তেল সংগ্রহ করে তা বাজারজাত করা সম্ভব, যা আমাদের দেশের স্থানীয় ওষুধের কাঁচামালের জোগান দিতে সহায়তা করবে। পাশাপাশি এই প্রক্রিয়ায় রপ্তানির সুযোগও বৃদ্ধি পাবে। মাছ চাষ ও আহরণকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে পারে অসংখ্য মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা।
এবার আসি সমুদ্রকেন্দ্রিক কৃষি ও শিল্পের সমন্বয় নিয়ে। এদেশের লবণ চাষ একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত যা কৃষি ও শিল্পের সংমিশ্রণে অর্থনীতির নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। এটি শুধু কৃষিভিত্তিক উৎপাদন নয়, বরং প্রসেসিং, কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি এবং রপ্তানি বাজারের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত একটি সম্ভাবনাময় শিল্প। সঠিক পরিকল্পনা ও প্রযুক্তির প্রয়োগ নিশ্চিত করা গেলে এটি দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। বাংলাদেশে কস্টিক সোডা ও ক্লোরিন উৎপাদন শিল্পের জন্য বছরে ৪ থেকে ৪ লাখ ৫০ হাজার টন অপরিশোধিত লবণ আমদানি করা হয়। ২০২২ সালের একটি তথ্যমতে, লবণ আমদানিতে প্রতি টনে খরচ হয় ৪৫ ডলার। যদি লবণ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এই লবণ নিজেদের উৎপাদন থেকে আমদানি করে, তাহলে খরচ হবে ৩০ ডলার, যার ফলে প্রতি টনে ১৫ ডলার সাশ্রয় হবে।
স্মার্ট ইরিগেশন, উন্নত বাষ্পীভবন ও ন্যানো ফিল্টারেশন প্রযুক্তির মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বাড়ানো সম্ভব। কাঁচা লবণের পরিবর্তে রিফাইন্ড, আয়োডাইজড ও ফার্মাসিউটিক্যাল গ্রেড লবণ উৎপাদন করলে বাজারমূল্য কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি সোডিয়াম ক্লোরাইড, সোডিয়াম কার্বোনেট ও ক্লোর-অ্যালকালি ইন্ডাস্ট্রির মাধ্যমে কেমিক্যাল শিল্পের প্রসার ঘটানো যেতে পারে। উন্নতমানের লবণ উৎপাদন করে ভারত, চীন ও মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে প্রবেশ করা সম্ভব, যা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ তৈরি করবে। সঠিক পরিকল্পনা, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও বিনিয়োগ নিশ্চিত করা গেলে লবণ খাত বাংলাদেশের অন্যতম সম্ভাবনাময় শিল্পে পরিণত হতে পারে।
লেখক : সিনিয়র ম্যানেজার, চায়না ন্যাশনাল কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লি. (সিএনসিইসি)
এই বছর অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে উদ্ভাবন ও সৃজনশীল ধ্বংসের প্রক্রিয়া (creative destruction) কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে সেই গবেষণার ওপর। নতুন প্রযুক্তি ও ধারণা পুরোনো ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন করে সমাজ যখন পরিবর্তনের জন্য উন্মুক্ত থাকে, তখনই টেক
১৮ ঘণ্টা আগে‘মনের তালা খুলল কে, চাবিওয়ালা, চাবিওয়ালা!’ প্রখ্যাত শিল্পী রুনা লায়লার সেই সুরেলা প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে বেড়াচ্ছি! তবে ব্যক্তিগত জীবনে নয়, রাষ্ট্রীয় জীবনে। এই রাষ্ট্রের জীবনেও একটা বিশেষ তালা আছে, আর তার নাম আর্টিকেল ৭০! এই তালা লাগানো হয়েছিল সেই সব মাননীয়র জন্য, যাদের মধ্যে ‘ছাগলীয়’ প্রবৃত্তি রয়ে
১৮ ঘণ্টা আগেভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে প্রায়ই তার পরম বন্ধু বলে বেশ গৌরবের সঙ্গে প্রচার করে থাকেন। ভিন্ন দেশের এ দুই রাজনীতিবিদের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের মূল সূত্র হলো মুসলমানদের প্রতি তাদের তীব্র ঘৃণা। বর্তমান বিশ্বে ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত শীর্ষ দুটি
১৮ ঘণ্টা আগেগাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন হতাশা চরমে, তখনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন এক নতুন ‘২০ দফার শান্তি পরিকল্পনা’। সেখানে তিনি নিজেকে বসিয়েছেন একটি তথাকথিত ‘বোর্ড অব পিস’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে।
২ দিন আগে