ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আজ সাংবাদিকতার নৈতিক মানদণ্ড থেকে বহু দূরে সরে গেছে। তথ্যের পরিবর্তে চাঞ্চল্যকর, জাতীয়তাবাদ এবং সাম্প্রদায়িক বিভেদকে পুঁজি করে যে নতুন ধারার ‘মিডিয়া বুমিং’ দেখা যাচ্ছে, তা শুধু নির্লজ্জই নয়, অনেক ক্ষেত্রে সাংবাদিকতার নামে সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সমার্থক। একটি মুক্ত গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ যখন সমালোচকের ভূমিকা ছেড়ে উসকানিদাতার ভূমিকা নেয়, তখন তা সমাজের জন্য চরম বিপদ ডেকে আনে।
সাংবাদিকতার নামে উসকানি : পেশাদারিত্বের অবক্ষয়
মূলধারার ভারতীয় মিডিয়াগুলোর একটি বড় অংশ এখন সংবাদ পরিবেশনের চেয়ে দর্শকদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি এবং একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক এজেন্ডাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কাজ করছে।
কঠিন তথ্যভিত্তিক রিপোর্টিংয়ের স্থান দখল করেছে উচ্চ-কণ্ঠস্বর, লাইভ গ্রাফিকস এবং ‘ব্রেকিং নিউজ’-এর নামে সামান্য ঘটনাকে দীর্ঘায়িত করে অতিরিক্ত চাঞ্চল্যকরভাবে উপস্থাপন করা। উদ্দেশ্য সত্য জানানো নয়, বরং দর্শকদের একটি নির্দিষ্ট মানসিক অবস্থায় ধরে রাখা।
সবচেয়ে জঘন্য বিষয়টি হলো, অনেক সাংবাদিক নিজেই সোশ্যাল মিডিয়ার ‘ট্রোল আর্মি’-এর ভূমিকা নিচ্ছেন। ব্যক্তিগত আক্রমণ, অশালীন ভাষা এবং বিরোধী মতাদর্শের মানুষকে হেয়প্রতিপন্ন করাই তাদের প্রধান কাজ। সাংবাদিকতা যদি পেশাদারিত্ব হারায় এবং একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর পক্ষ নিতে শুরু করে, তখন তা জনগণের বিশ্বাসকে ধ্বংস করে দেয়।
বাংলাদেশে নিয়ে গুজব ও মিথ্যাচার
সাম্প্রতিক বছরগুলোয়, বিশেষ করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ কোনো ঘটনা ঘটলেই ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে গুজব এবং মিথ্যা তথ্য ছড়িয়েছে।
বাংলাদেশের কোনো সাম্প্রদায়িক ঘটনার সময় ভারতীয় মিডিয়া প্রায়ই অতিরঞ্জিত বা সম্পূর্ণ মিথ্যা খবর প্রকাশ করে, যেখানে বাংলাদেশের হিন্দুদের ওপর ‘গণহত্যা’ বা ব্যাপক ‘অত্যাচার’-এর ভিত্তিহীন দাবি করা হয়। ফ্যাক্ট-চেকাররা বহুবার দেখিয়েছেন, পুরোনো বা ভিন্ন দেশের ছবি ব্যবহার করে ঘটনাকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের পর দেখা গেছে, ভারতীয় মিডিয়ার অসংখ্য আউটলেট উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মিথ্যা খবর প্রচার করেছে। এ ধরনের প্রচারণার উদ্দেশ্য বাংলাদেশে হিন্দুদের মধ্যে ভয় সৃষ্টি করা এবং ভারতে হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীর মধ্যে বিদ্বেষ বাড়ানো। এর ফলে প্রতিবেশী দুই রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে এবং সীমান্ত অঞ্চলে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়।
ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থাগুলোর অনুসন্ধানে বারবার উঠে এসেছে যে, অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে ৪৯টিরও বেশি ভারতীয় গণমাধ্যম উদ্দেশ্যমূলকভাবে বাংলাদেশ নিয়ে ভুয়া খবর ছড়িয়েছে। এর মধ্যে ছিল সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়ানো, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর অতিরঞ্জিত হামলার খবর প্রচার এবং ভুয়া চিঠি বা ভিডিও ব্যবহার করে আতঙ্ক সৃষ্টি করা।
বাংলাদেশের পলাতক গোষ্ঠীকে রাজনৈতিক পুঁজি দেওয়া
জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে, যখন বাংলাদেশের জনগণ ভারতের আধিপত্যবাদী নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে এবং নতুন সরকার জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে দৃঢ়তা দেখাচ্ছে, ঠিক তখনই ভারতীয় মিডিয়ার একটি বড় অংশ ‘তথ্যসন্ত্রাস’ শুরু করেছে।
ভারতে আশ্রয় নেওয়া পতিত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সুপরিকল্পিতভাবে ভারতীয় মিডিয়ার এসব মিথ্যা প্রতিবেদন বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছেন। এর মাধ্যমে তারা জনগণের মধ্যে ভয় এবং আতঙ্ক সৃষ্টি করে রাজনৈতিক অস্থিরতা জিইয়ে রাখতে চেয়েছে, যা তাদের পুরোনো ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা মাত্র।
মুসলিমদের বিরুদ্ধে সুপরিকল্পিত মিথ্যা প্রতিবেদন
ভারতীয় মিডিয়ার এই নির্লজ্জতার কেন্দ্রে রয়েছে মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সুপরিকল্পিতভাবে মিথ্যা ও পক্ষপাতদুষ্ট প্রতিবেদন তৈরি করা।
মূলধারার বহু চ্যানেল তথাকথিত ‘লাভ জিহাদ’-এর মতো মনগড়া এবং ভিত্তিহীন শব্দবন্ধ ব্যবহার করে মুসলিমদের এক ‘ষড়যন্ত্রকারী’ সম্প্রদায় হিসেবে তুলে ধরে। এর পেছনে কোনো যাচাইকৃত তথ্য নেই, আছে শুধু সাম্প্রদায়িক মেরূকরণ তীব্র করার উদ্দেশ্য।
প্রায় প্রতিটি অপরাধমূলক ঘটনার পরই কোনো ধরনের প্রমাণ ছাড়াই একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় গোষ্ঠীর দিকে সন্দেহের আঙুল তোলা হয়। মিডিয়া বিচার ও তদন্তের আগেই ‘সন্ত্রাসবাদী’ ট্যাগ ব্যবহার করে, যা ন্যায়বিচারের প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে এবং সমাজে মুসলিমদের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করে।
অনেক মিডিয়ার রাজনৈতিক এবং ব্যবসায়িক এজেন্ডা এতই স্পষ্ট, তাদের প্রতিবেদনগুলো আর সংবাদ থাকে না, বরং ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক প্রচারণায় পরিণত হয়। তারা সরকারের সমালোচনা থেকে বিরত থাকে এবং শুধু মুসলিম বা বিরোধী দলগুলোর সমালোচনায় নিজেদের শক্তি নিয়োজিত করে।
গণতন্ত্রের চরম বিপদ
ভারতে সাংবাদিকতার নামে যে ‘জঘন্য মিডিয়া বুমিং’ চলছে, তা সমাজের সম্প্রীতি এবং গণতন্ত্রের মৌলিক কাঠামোকে নষ্ট করছে। যখন সাংবাদিকতা সত্যের অনুসন্ধান ছেড়ে বিদ্বেষ ছড়ানোর হাতিয়ার হয়, তখন তা শুধু নির্লজ্জতাই নয়, এক ধরনের সন্ত্রাসমূলক কার্যকলাপের জন্ম দেয়। এই প্রবণতা বন্ধ না হলে, সমাজের বিভেদ আরো গভীর হবে এবং মুক্ত গণমাধ্যমের ধারণাটি ভারত থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
লেখক : সাংগঠনিক সম্পাদক, ক্যাম্পেইন ফর মিডিয়া ফ্রিডম
ই-মেইল : kamranpressbd@gmail.com

