দেশে এখন সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ভূমিকম্প। গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, হাটবাজার সর্বত্রই ভূমিকম্প নিয়ে আলোচনা। এই আলোচনায় বিদ্যমান রাজনৈতিক উত্তেজনা নিয়ে মানুষের কৌতূহলও যেন ম্লান হয়ে পড়ছে। সবাই যেন এখন ভূমিকম্পবিশারদ। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ভূমিকম্পটি জাতীয় মনস্তত্ত্বে এমনই বিভীষিকার সঞ্চার করেছে যে একদল যখন এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নিয়ে ব্যস্ত, অন্যদল এর ধর্মীয় দৃষ্টিকোণটি তাদের প্রাজ্ঞ, জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় তুলে ধরতে সচেষ্ট। বিভিন্ন সূত্রে যতদূর জানতে পারছি, অনেকেই এই ভূমিকম্পের পর রাজধানীর মাত্রাতিরিক্ত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলো থেকে বাসা পরিবর্তন করে শহরতলির ফাঁকা জায়গায় চলে যাচ্ছেন। তাছাড়া, সামনে আরো বড় বিপদ আসতে পারেÑএই আশঙ্কায় অনেকের রাতের ঘুমও নাকি হারাম হয়ে গেছে। যাই হোক, রক্ত-মাংসের মানুষ হিসেবে সমাজে আর দশজনের বর্তমান মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা আমাকেও প্রভাবিত করেছে। তবে ধর্মে বিশ্বাসী মানুষ হিসেবে আমার কাছে এটি এক অদৃশ্য মহাশক্তির মহাবদলের ইঙ্গিতই মনে হয়েছে। শুধুই মনে হয়েছে, সেই অদৃশ্য মহাশক্তির মুহূর্তের ক্ষমতার কাছে মানুষ কত অসহায়! অথচ এই ক্ষমতা নিয়ে আমাদের কতই না লোভ! ক্ষমতা পাকাপোক্তকরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচি ও ইশতেহারে যে আন্তরিকতা কাজ করে, তার ছিটেফোঁটারও প্রতিফলন দেখা যায় না প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায়।
পৃথিবীতে একটি বড় পরিবর্তন আসবে, তা গত শতাব্দীর শেষদিকেই বোঝা যাচ্ছিল। সভ্যতার বড় বাঁক নেওয়ার আগে যেসব ইঙ্গিতবাহী লক্ষণ থাকে, নতুন সহস্রাব্দের শুরু থেকেই তা একে একে প্রকাশ পেতে থাকে। প্রাকৃতিক এবং মানবসৃষ্ট এসব লক্ষণের ব্যাপারে বহু আগে থেকেই মহাপুরুষ পর্যায়ের ভবিষ্যদ্বাণী ও সতর্কবার্তা ছিল। কিন্তু আমরা সেসব সংকেত সময়মতো আমলে নিইনি। ইবোলা, সার্স ও ডেঙ্গু—এসব রোগের প্রাদুর্ভাব এবং দাবানল কিংবা ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের পুনরাবৃত্তি থেকেও শিক্ষা নিইনি। ফলে আজ আমরা এমন এক অবস্থায় পৌঁছেছি, এই বুঝি এক মহাপ্রলয়ে মানবসভ্যতার ইতি ঘটে যাবেÑএই আশঙ্কা আমাদের সার্বক্ষণিক তাড়া করে বেড়াচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে জাপানি লেখক হারুকি মুরাকামির বিখ্যাত সাহিত্যকর্ম ‘আফটার দ্য কুয়েক’-এর কথা মনে পড়ে যায়। আমরা কি তবে সেই গল্পের চরিত্রগুলোর বাস্তব প্রতিরূপ হতে চলেছি!
মানুষ আগামীকাল কীভাবে বাঁচবে, তা নির্ভর করে আজ সে কীভাবে জীবন কাটাচ্ছে, তার ওপর। যদি বিশ্বনেতারা আরো বিচক্ষণতা, ধৈর্য ও মানবিক সদিচ্ছা নিয়ে পৃথিবী পরিচালনা করতেন, তাহলে হয়তো আমাদের আজকের এই নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হতো না। আজ আমরা এমন এক পৃথিবীতে বাস করছি, যেখানে আমাদের সবচেয়ে ভয়ংকর শত্রু হলো ভূমিকম্প আর ভাইরাসের মতো অদৃশ্য শক্তি। অথচ দৃশ্যমান শত্রুদের বিরুদ্ধে যুগ যুগ ধরে যুদ্ধ করেই আমরা নষ্ট করছি যাবতীয় অর্থ, সম্পদ আর শক্তি। এগুলো বলার কারণ, শুধু বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীজুড়েই ভূমিকম্পের প্রকোপ আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। বিগত এক দশকে আগাম অনুমেয় নয় এই প্রাকৃতিক দুর্যোগটি প্রভূত প্রাণ ও সম্পদহানির কারণ হয়েছে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাফল্য আমাদের উন্নতির পথ দেখিয়েছে ঠিকই, কিন্তু তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে বাহ্যিক শক্তি বৃদ্ধির জন্য। যুদ্ধশিল্প, যুদ্ধÑঅর্থনীতি, ভোগবাদ, বৈষম্যÑএসবই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে আমাদের কর্মকাণ্ডে। সেক্স-ডল, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিক জীবনযাপনের মতো আবিষ্কারও মানবিকতার চেয়ে বস্তুগত উন্নয়নেরই উৎকট বহিঃপ্রকাশ। ইমোজি ও জিআইএফের দ্রুততর ডিজিটাল যোগাযোগের যুগে প্রবেশ করে সময় এবং শক্তি ব্যবস্থাপনায় বিপ্লব ঘটিয়েছি। কিন্তু এগুলো আমাদের পবিত্র গ্রন্থে উল্লিখিত সেই সতর্কবার্তার ইঙ্গিত নয় তো, যেখানে বলা হয়েছে মানবজাতির ওপর প্রযুক্তির আসমানি অভিশাপ নেমে আসবে? ভূমিকম্পের এত ঘন ঘন পুনরাবৃত্তি সেসব ঐতিহাসিক শাস্তির পুনরাবৃত্তি নয়তো, যেগুলো অতীতের বহু শক্তিশালী জাতির ওপর নেমে এসেছিল তাদের সীমালঙ্ঘনের কারণে? আলিমুল গায়েবেই ভালো জানেন।
আল্লাহপাক প্রাণিকুলের সবাইকে স্বাধীন ইচ্ছা দেননি। শুধু মানুষকে দিয়েছেন। ভৌত সম্পদের সহজলভ্যতা মানুষের এই স্বাধীন ইচ্ছাকে ভুলপথে পরিচালিত করছে। আমরা আজ আল্লাহর বিধান লঙ্ঘনে কোনো কিছুরই পরোয়া করছি না। জীবনের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি অতিরিক্ত ভোগবাদী হয়ে উঠেছে। সবকিছুর মূল্যায়নে ভৌত লাভই প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই মনোভাব আমাদের অন্তর্জগৎকে ধীরে ধীরে শূন্য করে দিচ্ছে।
কোভিড-পরবর্তী বিশ্বে অর্থনীতি, রাজনীতি, ধর্ম ও সমাজ—সব ক্ষেত্রেই বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। এই পরিবর্তনের বৈশ্বিক প্রভাব অবচেতনভাবে মানুষের আচরণে যেভাবে পড়েছে, তা এখনো সর্বত্র কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। ঠিক এ অবস্থায় ভূমিকম্পের এহেন পুনরাবৃত্তি আসলেই চিন্তার বিষয়। আন্তর্জাতিক রাজনীতির নতুন সমীকরণে করোনা মহামারির ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মতো। এদিক থেকে ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্বিপাকের সক্ষমতা উড়িয়ে দেওয়ার নয়। বৈশিষ্ট্যগতভাবে বিশ্বরাজনীতিতে আমূল পরিবর্তন আনয়নে সব রসদই ভূমিকম্পেও বিদ্যমান। বিভিন্ন ধর্মে উল্লিখিত ভূমিকম্পের আধ্যাত্মিক তাৎপর্য ও গুরুত্বের বিষয়টি আমাদের করোনাকালে সমকামী ও হিজাববিদ্বেষী ইতালি, জার্মানি এবং নেদারল্যান্ডসের মতো দেশগুলোয় মসজিদে আজানের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সীমান্ত, জাতি বা অর্থনৈতিক অবস্থান নয়, আমাদের প্রথম পরিচয় হলো মানুষ। ভূমিকম্পসহ যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ধাক্কা শুধু একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমানায় আবদ্ধ থাকে না। এটি বুঝতে আমাদের বড় দেরি হয়ে যাচ্ছে। মানবজাতি টিকে না থাকলে কোনো মতবাদ বা চিন্তাধারা টিকে থাকার নয়।
সবশেষে মনে রাখা উচিত—আমরা সবাই পরকালের পথে যাত্রার অপেক্ষায় আছি। এক মুহূর্তেই সেই আহ্বান আসতে পারে। সেই যাত্রায় কোনো দুনিয়াবি সম্পর্কÑহোক তা ভৌত বা আবেগীয়—কারো সঙ্গে থাকবে না। প্রত্যেকে একাই যাবে এবং সেখানে দুনিয়ার কর্মই হবে চিরস্থায়ী জীবনযাত্রার মূল মানদণ্ড।
লেখক : কবি, সাংবাদিক

