আইনগত সহায়তা আইনের সংশোধনী

মতিউর রহমান
প্রকাশ : ১৪ আগস্ট ২০২৫, ০৯: ২৮

নুরে জান্নাতের মায়ের সঙ্গে যখন ওর বাবার দাম্পত্য কলহ শুরু হয়, তখন ওর বয়স মাত্র আট মাস; আট মাস বলতে মাতৃগর্ভে আট মাস। মায়ের পেটে আরো দুই মাস থাকার পর নুরে জান্নাত যখন পৃথিবীতে আসে, তখন বাবা-মা দুজনেই আদালতের দুই কাঠ গড়ায়। নুরে জান্নাতের মা তার বাবার বিরুদ্ধে যৌতুকের কারণে নির্যাতনের অভিযোগে মামলা করেন। নুরে জান্নাত ভূমিষ্ঠ হয়ে বড় হয়েছে। কিন্তু বাবার স্নেহ-পরশবঞ্চিত তীব্র দুঃখ-হতাশা নিয়ে। ২০২২ সাল। আমি পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ছিলাম তখন। আমার আদালতে মামলাটি শুনানির জন্য ডাক পড়ে।

বিজ্ঞাপন

একপক্ষে নুরে জান্নাতের বাবা নুরজামাল ইসলাম আর অন্যপক্ষে মা আঁখি মণি। আঁখি মণির কোলে নুরে জান্নাত। বাবা ও মায়ের হাজারো দোষ থাকলেও এই ১১ মাস বয়সি নুরে জান্নাত বোঝে না এসবের কোনো কিছুই। সর্বজনীন এই শিশুদের মধ্যে কোনো রাগ নেই, অনুরাগ নেই, সুশীল সমাজের বিরোধ নেই, সাংবিধানিক সংকট নেই। অথচ সমাজের সবচেয়ে ভয়ানক দ্বন্দ্ব আর বিচ্ছেদের শিকার কচি মনগুলো।

আমি এজলাসে বসে নুরে জান্নাতের নাম ধরে ডাকি। নুরে জান্নাত আমার দিকে তাকায়। নিজের হাতে নিজে তালি দেয়। শব্দহীন সে তালি বাজে না। বাবাবিহীন পৃথিবীতে তালি বাজার কথাও নয়। আমি বাজাতে চাই সে তালি। খুব করে উভয় পক্ষের সঙ্গে কথা বলি। পরস্পরের পজিটিভ দিকগুলো তুলে ধরি।

অতীতকে ভুলে গিয়ে শুধু নুরে জান্নাতের জন্য একে অন্যকে ক্ষমা করে দেওয়ার বিনীত অনুরোধ করি আমি। অবশেষে বরফ গলতে শুরু করে। নুরজামাল এগিয়ে এসে হাত ধরে আঁখি মণির। আঁখি মণির আঁখি আর বাধা মানে না।

‘চাইলে এই বিরোধ অনেক আগে আপস করা যেত, আপস করেননি কেন?’

নুরে জান্নাতের মা-বাবাকে প্রশ্ন করি আমি। তারা একে অন্যের দিকে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে, অপরাধীর মতো আমার দিকে তাকায়। অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে বুঝতে পারে তা।

আদালতে মামলা না করে শুরুতেই আপসের উদ্যোগ নিলে জান্নাতের জীবন থেকে এই সময়টুকু ঝরে যেত না, এ কথা স্বীকার করে তারা উভয়ে।

সারা দেশে দাম্পত্য কলহ নিয়ে এ রকম হাজারো ঘটনা আছে। ছোটখাটো দাম্পত্য বিরোধের জেরে স্বামী বা স্ত্রী রাগের মাথায় আদালতে মামলা করলেও শেষমেশ আপস মধ্যস্থতায় সমাধানের অনেক নজির রয়েছে।

এ কথা সত্য, আদালতে মামলা হলে বছরের পর বছর সময় লাগে নিষ্পত্তি হতে।

যৌতুকের কারণে নির্যাতনের মামলাগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সরাসরি আমলে না নিয়ে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাকে তদন্ত করতে দেওয়া হয়। এই তদন্তকালেও অনেক মামলা আপস হয়ে যায়।

আর পুরো বিচার সম্পন্ন হতে সময় লাগে গড় পড়তা তিন-চার বছর। দাম্পত্য জীবন থেকে তিন চার বছর ঝরে যাওয়া একটা মানুষের জন্য অনেক ক্ষতি।

এ ক্ষেত্রে শুরুতে উভয় পক্ষের মধ্যে আপস নিষ্পত্তির উদ্যোগ গ্রহণ করলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আপস হয়ে যায় আরো অল্প সময়ে। ভাঙনের থেকে রক্ষা পায় পরিবারগুলো।

পৃথিবীর অনেক দেশেই মামলার আগে মেডিয়েশনের জন্য মেয়েডিটরের কাছে যাওয়ার বিধান রয়েছে। আমাদের দেশেও বিচারপ্রার্থী মানুষের এই দাবি ছিল অনেক দিনের।

এসব বিষয় বিবেচনা করে, আইনগত সহায়তা প্রদান (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫ প্রণয়ন করা হয়েছে। এই অধ্যাদেশে দেশের যেকোনো নাগরিককে আইনি তথ্য ও পরামর্শ সেবা প্রদান, মামলার আগে ও পরে মধ্যস্থতার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তিসহ অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ এবং মধ্যস্থতা বিষয়ে অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আইনজীবীদের মধ্য থেকে স্পেশাল মিডিয়েটর নিয়োগের বিধান যুক্ত করা হয়েছে।

এই অধ্যাদেশের সবচেয়ে বড় দিক হলো মধ্যস্থতা চুক্তির কার্যকারিতা। আগে লিগ্যাল এইড অফিসার কর্তৃক প্রদত্ত চুক্তিপত্র পক্ষদের ওপর বাধ্যকর ছিল না। ফলে তারা আপস চুক্তি লঙ্ঘন করে আবার মামলায় জড়িয়ে যেত। বর্তমান আইনে পক্ষদের মধ্যে সম্পাদিত এবং চিফ লিগ্যাল এইড অফিসার কর্তৃক প্রত্যায়িত মধ্যস্থতা চুক্তি চূড়ান্ত বলবৎযোগ্য এবং পক্ষদের ওপর বাধ্যকর হবে মর্মে বিধান করা হয়েছে। এর ফলে ছোটখাটো বিরোধীয় বিষয়গুলো আপস-মীমাংসার মাধ্যমে জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার ও মেডিয়েটরের দ্বারাই নিষ্পত্তি হবে।

আর বিরোধ নিষ্পত্তি না হলে তো আদালতে যাওয়ার সুযোগ থাকছেই। বর্তমান অধ্যাদেশের তফসিলে পারিবারিক আদালত আইন, বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন, সহকারী জজদের এখতিয়ারভুক্ত বণ্টন-সম্পর্কিত বিরোধ, অগ্রক্রয় সম্পর্কিত বিরোধ, বাবা-মায়ের ভরণপোষণ আইন, চেক ডিজঅনার সম্পর্কিত অভিযোগ (৫ লাখ টাকা পর্যন্ত), যৌতুক নিরোধ আইন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১(গ) ধারায় বর্ণিত যৌতুকের জন্য নির্যাতন সম্পর্কিত অভিযোগ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

অধ্যাদেশের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে আমি প্রশংসা করতে শুনেছি অনেককে। হয়রানি থেকে বাঁচার ক্ষেত্রে এটি একটি মাইলফলক অধ্যাদেশ হয়েছে মর্মে প্রশংসা করেছেন আইনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশিষ্টজনরা। আবার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১(গ) ধারায় যৌতুকের কারণে নির্যাতনের বিষয়টি মামলা-পূর্ব মধ্যস্থতার বিধানের আওতাভুক্ত করায় সমালোচনাও করেছেন কেউ কেউ। মামলায় দীর্ঘ হয়রানি ও আইনি জটিলতায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংসারগুলো ভেঙে যায়। এ ক্ষেত্রে দম্পতির শিশুসন্তান থাকলে ভোগান্তি হয় আরো বেশি। অভিজ্ঞতায় দেখেছি—কয়েক বছর মামলা চলার পর ক্লান্ত বাদিনী আপস করতে চান, স্বামীর সংসারে ফিরে যেতে চান।

মাঝখানে গড়ায় গঙ্গা থেকে পদ্মা পর্যন্ত অনেক পানি। একটা সংসার ভেঙে যাওয়ার বিনিময়ে লাভবান হয় অনেকগুলো পক্ষ। তাই আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপট ও বিচারের সংস্কৃতি বিবেচনায় তাই বিচার-পূর্ব মধ্যস্থতা ধন্বন্তরি হিসেবে কাজ করে।

আইনগত সহায়তা প্রদান (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারির ফলে এখন আর্থিক সামর্থ্য নির্বিশেষে যেকোনো ব্যক্তি সরকারি আইনি সহায়তা কার্যক্রমের আওতায় জেলা লিগ্যাল এইড অফিসারের কাছে বিনামূল্যে আইনি তথ্যসেবা গ্রহণ, আইনি পরামর্শ গ্রহণ এবং বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তির সেবা গ্রহণ করতে পারবেন। মামলার আগে মামলায় জয়-পরাজয়, লাভ-ক্ষতি ইত্যাদি বিষয়ে পরামর্শ গ্রহণ করতে পারবেন।

এমন অনেক বিষয় রয়েছে, যা মামলা পর্যন্ত যাওয়ার প্রয়োজন নেই। সেসব বিষয়ে আইনি পরামর্শ নিয়েই অনেকে সন্তুষ্ট থেকেছেন। তা ছাড়া মামলার বিভিন্ন পর্যায়ে কী করণীয়, আইনি জটিলতায় পড়ার আগে করণীয় ও বর্জনীয় ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কেও জেলা লিগ্যাল এইড অফিসারের কাছে আইনি সহায়তা নিতে পারবেন অনায়াসে।

অনেকে আছেন, যাদের প্রকৃত অধিকারের ন্যায্যতা থাকা সত্ত্বেও শুধু আইনি জটিলতা, সম্মানহানি ও আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর ভয়ে প্রতিপক্ষকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নিজের অধিকার ছেড়ে দেন। এমন মানুষের জন্য আদালতের কাঠগড়া নয়; বরং জেলা লিগ্যাল এইড অফিসারের কাছে আপস মধ্যস্থতায় বিরোধ নিষ্পত্তির সুযোগ রয়েছে। এতে একদিকে যেমন রক্ষা হয় সামাজিক সম্মান, তেমনি কোনো ধরনের হয়রানি ও ঝামেলা ছাড়াই বিরোধের স্থায়ী নিষ্পত্তি ঘটে।

বাংলাদেশে অধস্তন আদালত এবং উচ্চ আদালত মিলে ৪৫ লাখের মতো মামলা বিচারাধীন। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে এসব মামলা-মোকদ্দমায় আদালতের বারান্দায় বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। দেশের সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেকগুলো প্রতিবন্ধকতার মধ্যে মামলাজট একটি বড় অন্তরায়। রায়ের মাধ্যমে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির পরও উভয় পক্ষের মধ্যে সমস্যাগুলো জিইয়ে থাকে যুগের পর যুগ। ফলে দাদার আমলে নিষ্পত্তিকৃত বিষয়টি বংশানুক্রমে নাতিদের পর্যন্ত গড়ায়।

বিচারপ্রার্থী মানুষকে দ্রুততম সময়ে কম খরচে ন্যায়বিচার দেওয়া আদালতের প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব হলেও বিপুলসংখ্যক মামলার বিপরীতে বিচারক-স্বল্পতা এবং পরিবেশগত প্রতিবন্ধকতাসহ নানা সমস্যার কারণে তা সম্ভব হয়ে উঠছে না। এ ক্ষেত্রে আইনগত সহায়তা প্রদান (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ মানুষের আইনি সহযোগিতা পাওয়ার পথকে আরো প্রসারিত করেছে।

লেখক : সিনিয়র সহকারী সচিব, আইন মন্ত্রণালয়

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত