শহীদ জিয়ার জাতীয়তাবাদের ভিত্তি

ব্রি. জে. (অব.) ড. একেএম শামছুল ইসলাম
প্রকাশ : ১৯ মার্চ ২০২৫, ১০: ৫৫

জাতীয়তাবাদ সবসময়ই একটি জাতির সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় রক্ষাকবচের ভূমিকা পালন করে। নিজের মাতৃভাষার জন্য সংগ্রাম করতে গিয়ে প্রথম বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়। ফলে এই জাতির মধ্যে জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটে।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার জন্য বাংলাদেশের মানুষের যে অভূতপূর্ব আত্মত্যাগ, পরবর্তী সময়ে তা জাতীয়তাবাদেরই স্বীকৃতি। ভাষাশহীদদের পবিত্র রক্তস্রোতের সঙ্গে মিশে আছে এই জাতির মুক্তি সংগ্রামের গৌরবগাথা। শুধু বাঙালি নয়, শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের প্রতিটি জাতি ও রাষ্ট্রের নিজেদের মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার সংগ্রাম হিসেবে আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস অবিনশ্বর, অনুকরণীয় ও অবিস্মরণীয় হয়ে আছে।

বিজ্ঞাপন

একুশের আদর্শের পরিমণ্ডলে জাতির ইতিহাসে সংযোজিত হয়েছে অনেকগুলো অধ্যায়। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের আলোকবর্তিকার উৎস হলো একুশে ফেব্রুয়ারি। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি হলো ত্যাগের ইতিহাস, সংগ্রামের মুকুটের উজ্জ্বল পালক, আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে অগ্নিশিখা, শোষণের বিরুদ্ধে শোষিতের দীপ্ত স্লোগান, নিজের মতো বাঁচতে শেখার জাতীয়তাবাদের প্রথম পাঠ, যা কৈশোরেই প্রোথিত হয়েছিল শহীদ জিয়ার মানসপটে। আর তা-ই আমরা দেখতে পাই আমৃত্যু তার বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি রচনার ঘটনা পরম্পরায়।

শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তার সংক্ষিপ্ত শাসনামলে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে রচনা করে গিয়েছিলেন একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের ভিত্তিমূল। তিনি সেই ভিত্তিকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রের সব যন্ত্রকাঠামো নিয়ে বিপুল কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করছিলেন, যদিও আকস্মিক শহীদ হওয়া এবং পরবর্তী সময়ে স্বৈরাচার এরশাদের অবৈধ ক্ষমতায়ন সেই কর্মযজ্ঞকে ব্যাহত করে। তবু তার রেখে যাওয়া কিছু অবদান আজও আমাদের পাথেয় ও অবলম্বন হিসেবে অগ্রণী ভূমিকা রেখে চলছে।

ভাষাসৈনিকদের শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে ১৯৭৬ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ জিয়ার যে শরীরী ভাষা আমরা দেখেছি, সেটিই বলে দেয় ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি তার শ্রদ্ধাবোধ, ভালোবাসা ও দায়বদ্ধতা। সেই দায়বদ্ধতা থেকেই তিনি প্রণয়ন করেন ‘একুশে পদক এবং স্বাধীনতা পদক’। তিনি ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ শিশু একাডেমি, যে একাডেমি জাতীয় শিশু-কিশোর প্রতিযোগিতার আয়োজনসহ আরো বেশ কিছু সাংস্কৃতিক কার্যক্রম পরিচালনা করার ভেতর দিয়ে দেশীয় সংস্কৃতিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।

শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমি অধ্যাদেশ প্রণয়ন করেন, যা বাংলা একাডেমিকে একটি সফল প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে কার্যকর ভূমিকা রাখে। শহীদ জিয়া বাংলাদেশের উপজাতি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যকে ধরে রাখতে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট এবং নেত্রকোনার বিরিশিরিতে প্রতিষ্ঠা করেন উপজাতীয় কালচারাল একাডেমি। শুধু তা-ই নয়, গাজীপুরের অদূরে একটি চলচ্চিত্র নগরী প্রতিষ্ঠায় তিনি পৃষ্ঠপোষকতা করেন এবং জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদানকে উৎসাহিত করার ভেতর দিয়ে দেশের চলচ্চিত্রশিল্পের উন্নয়নে যথাযথ অবদান রাখেন।

দেশের গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতার প্রচার, প্রসার এবং এটিকে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দিতে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠা করেন প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ। আরেকটি বিষয় না বললেই নয়, বর্তমানে যেখানে ‘জাতীয় প্রেস ক্লাব’ অবস্থিত, সেই জায়গাটিও তিনি জাতীয় প্রেস ক্লাবের জন্য বরাদ্দ ও বন্দোবস্ত দেন।

শহীদ জিয়ার দর্শন ও প্রায়োগিক জীবনে যে বিষয় বারংবার মূর্ত হয়েছে, সেটি হলো বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ও বাংলাদেশের আবহমান কালের সংস্কৃতি একে অপরের পরিপূরক। তিনি জানতেন, দেশাচারের যথাযথ চর্চা ছাড়া বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ধারণা অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। সেই বিবেচনায় ভাষাশহীদদের সম্মানে যেমন একুশে পদক চালু করেছিলেন, তেমনি জাতির ভবিষ্যৎ শিশুদের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন শিশু একাডেমি।

এ ছাড়া বাংলাদেশ টেলিভিশনের সূচনালগ্নের কয়েক বছর পর ১৯৭৯ সালে বিটিভিতে নতুন কুঁড়ির মতো জনপ্রিয় শিশু প্রতিযোগিতাকেন্দ্রিক অনুষ্ঠানকে অনুমোদন করেন শহীদ জিয়া। এই প্রতিযোগিতার ভেতর দিয়ে বেরিয়ে আসা অনেক প্রতিভাবান শিশু-কিশোর আজকে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত।

লেখক : সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত