আহমদ আনিসুর রহমান
ইতিহাসে মাঝেমধ্যে এমন সব ব্যক্তিত্বের নীরব উদয় হয়ে থাকে, যারা খুব ঢাকঢোল পিটিয়ে, লাখ লাখ অনুসারীর বিশাল বিশাল জনসভায় বক্তৃতা না দিয়েও নিজের নীরব ও সীমিত কর্মের মাধ্যমে সমাজ সদস্যদের অনুপ্রাণিত এবং প্রভাবিত করে এক নীরব সাংস্কৃতিক বিপ্লবের রূপায়ণ করেন। যার মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি ও তাদের থেকে ব্যাপকতর সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির এমন পরিবর্তন হয়, যার পথ ধরে সামাজিক এবং রাজনৈতিক বিপ্লবের পথ প্রশস্ত হয়। বাংলাদেশের জন্য বদরুদ্দীন উমর ছিলেন এমনই এক ব্যক্তিত্ব। জীবদ্দশায় বাংলাদেশের বিভিন্ন পর্যায়ের পরিবর্তনে তার অবদান তেমন আলোচিত বা স্বীকৃত হয়নি; কিন্তু কালে, সামাজিক ইতিহাস বিশ্লেষকদের গবেষণায় তা উন্মোচিত হতে পারে একসময়।
তার এই নীরব অনুপ্রেরণা ও প্রভাবের কিঞ্চিৎ তার অনুজপ্রতিম আমাদের অনেকের মত, আমিও আজ উপলব্ধি করছি, তার প্রয়াণের পর। তারই কিঞ্চিৎ নমুনা লিপিবদ্ধ করে রাখার জন্য এই নাতিদীর্ঘ লেখা।
এই মাত্র কটি দিন পূর্বে, বহু বছর পরই কথা হচ্ছিল বদরুদ্দীন উমর, ‘উমর ভাই’কে নিয়ে। দেশ থেকে বহু দূরে, এক নবপরিচিতের নিজেকে ‘উমর ভাই’য়েরই সম্পর্কে নাতি বলে নিজের একটি পরিচয় দিলে। এরপর, এত তাড়াতাড়ি উনি চলে যাবেন, তা তখন চিন্তায়ও আসেনি। সেদিন তার সম্পর্কে যা বলিনি—খেয়ালও হয়তো করিনি—আজ তার প্রয়াণে সেসব কথা মনে হচ্ছে। আমিসহ আরো অনেকের অবচেতন মন-মানস, দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণার রূপায়ণে তার যে একটি প্রচ্ছন্ন প্রভাব ছিল, তা মনে পড়ছে।
ফ্রয়েডীয় মনোবিশ্লেষণ বিজ্ঞান মতে, আজীবন অবচেতনায় পরিচালিত করে যেসব ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-চেতনা, তার প্রায় সবটাই অবচেতনায় আত্মস্থ হয়ে থাকে সাধারণত শৈশবের প্রথম পাঁচ-ছটি বছর আর বাল্যকাল আর যৌবনের বয়ঃসন্ধিকালে, কৈশোরে, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করেন যারা, তাদের ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-চেতনার প্রভাবে। ঐতিহ্যগত সমাজব্যবস্থায়, এই বয়ঃসন্ধিকালেই নিয়মিত যৌন জীবনের সূচনাও হয় বলে, সে সময়ে প্রধানতর যৌনসঙ্গীর প্রভাবে তার যে ধ্যান-ধারণা ও চিন্তা-চেতনার অনেক কিছুই আত্মস্থ করে অবচেতনা, তাও হয় এই কৈশোরেই। এভাবে ঐতিহ্যগতভাবে, সাধারণত সারা জীবনের চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা—দৃতষ্টিভঙ্গি—মোটামুটি মৌলিকপর্যায়ে স্থায়ী হয়ে যায়—যদিও শিল্পায়ন-জাত পুঁজিবাদী সমাজে পুঁজির স্বার্থে বিবাহবয়স বিলম্বের কারণে পুঁজিবাদ্গ্রস্ত সমাজে অবচেতনার দৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণে কিছু ছেদ পড়ে। সে যাই হোক, আমিসহ, বাংলাদেশের আমাদের আর তার পরের প্রজন্মের অনেকের কৈশোরে আমাদের অবচেতনার চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গির রূপায়ণে যাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব কার্যকর হয়, তাদের ভেতর—তাদের ও আমাদের অজ্ঞাতেই—বদরুদ্দীন উমরও ছিলেন ।
তার সব চিন্তা-চেতনাই যে আমি আত্মস্থ করি, এমন নয়—অনেক কিছুতেই তার সঙ্গে একমত নই। কিন্তু তার দ্বারা যেসব বিষয়ে অনুপ্রাণিত হই, তার কথা বলা দরকার। সে অনুপ্রেরণা অন্যদেরও অনুপ্রাণিত করতে পারে, সে আশায়। এটা তারই আজীবন কর্মের অবদান হবে।
তার প্রথমটি হলো, সমাজ-বিশ্লেষণভিত্তিক সমাজ-সচেতনতায় ইতিবাচক সমাজপরিবর্তনে আত্মনিবেদন। সামাজিক রাজনৈতিক কর্মী বাবা-মায়ের সন্তান হিসেবে সমাজ-সচেতনাতা আর সমাজ পরিবর্তনে আত্মনিবেদন আশৈশবই উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ছিল আমার। কিন্তু তার ভিত্তি রূপে সমাজবিশ্লেষণ, যতদূর মনে পড়ে, ষাটের দশকের শেষ দিকে আমাদের কৈশোরে লক্ষ করি, অক্সফোর্ড ফেরা বদরুদ্দীন উমরের প্রকাশিত পুস্তক, ‘সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা’তে। তার অনুপ্রেরণাতেই সম্ভবত তারপর শিগগিরই আমার লেখালেখি পূর্বতন কথাসাহিত্য ও শিল্পীসুলভ বর্ণনামূলক প্রবন্ধ থেকে সমাজ-বিশ্লেষণভিত্তিক হতে শুরু করে।
গল্প, উপন্যাস, কবিতা লেখা প্রায় বন্ধই হয়ে যায় আমার। অন্যদিকে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকেই সমাজ-বিশ্লেষণাত্মক পড়াশোনার সঙ্গে কিঞ্চিৎ লেখার চেষ্টা কিছুটা করে বছরের শেষে, ১৯৭২ সালের প্রায় শুরু থেকেই প্রধানত তখনকার সবচেয়ে প্রভাবশালী সাময়িকী, সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’য় নিয়মিত সমাজ-বিশ্লেষণভিত্তিক প্রবন্ধ বা ‘কলাম’ লিখে নিজের ওই বয়সে ইতিবাচক সমাজ পরিবর্তনের দিকনির্দেশনা মনে হতো, তা প্রকাশ করি। এছাড়া দেশের প্রায় সব সাময়িকী ও পত্রিকায় দেদার লিখতে থাকি। যদিও সমাজ পরিবর্তনের স্পৃহা ও তার দিকনির্দেশনামূলক যা বলতাম, তা উমর ভাই থেকে না এসে থাকলেও—তার ভিত হিসেবে সমাজ-বিশ্লেষণের অভ্যাসটি খুব সম্ভব পরোক্ষ ও আংশিকভাবে হলেও ছিল তার প্রভাবেই।
উমর ভাইয়ের সমাজ-বিশ্লেষণ ছিল মার্ক্সীয় (Marxian), তার মার্ক্সবাদী (Marxist) সমাজ-রাজনৈতিক অবস্থানেরই উৎস। সরাসরি বা এককভাবে উমর ভাই থেকে না হলেও, সম্ভবত তারও প্রভাবে, আমি আমার নিজের সমাজ-বিশ্লেষণেও মার্ক্সীয় সমাজ-বিশ্লেষণ পদ্ধতি অনুসরণ করতে শুরু করি, অংশতঃ—যদিও তার মতো মার্ক্সবাদী, তথা ‘কমিউনিস্ট’ হইনি কখনো। মার্ক্সীয় বিশ্লেষণ পদ্ধতির সঙ্গে, নিজের অজ্ঞাতেই অনেকটা, আমার পরিচয় হয় সেকালে বাংলাদেশে সোভিয়েত রাজনৈতিক দর্শন ও অবস্থানের পক্ষে প্রচারণা ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রধান মাধ্যম দৈনিক ‘সংবাদ’-এর কিশোর বিভাগ, ‘খেলাঘর’ আর তার সাক্ষাৎ নিয়ন্ত্রণাধীন একই নামের দেশব্যাপী সক্রিয় কিশোর সংগঠনের মাধ্যমে।
১৯৬৭ বা ১৯৬৮ সালে ‘খেলাঘর’ সংগঠক, কুমিল্লানিবাসী ঢাকার দৈনিক ‘সংবাদ’-এর সাংবাদিক আহমদ নূরে আলম, ঢাকায় আমাদের পাড়ার কুমিল্লানিবাসী খেলার সাথি খোকা-ভুটিয়াদের বাসায় মেহমান এলে আমাদের পাড়ার কিশোরদের দেশের সর্ববৃহৎ ‘খেলাঘর’ শাখা প্রতিষ্ঠায় অনুপ্রাণিত করেন। পাড়ার খেলার সাথিদের সঙ্গে আমিও, তার পেছনের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির কথা না জেনে-বুঝেই তাতে যোগ দিই। নূরে আলম ভাই প্রতি সপ্তাহে আমাদের বাসার পাশের ছোট্ট খেলার মাঠে একটি ‘ধাঁধার আসর’-এর ব্যবস্থা করতেন—তা’তে সাধারণ জ্ঞানের প্রশ্ন করা হতো আর প্রতি সপ্তাহে আমিই প্রথম পুরস্কার পেতাম। সে পুরস্কারে প্রায়ই সোভিয়েত রুশিয়া থেকে প্রকাশিত সুন্দর সুন্দর গল্পের বই দেওয়া হতো। সেগুলো খুব আগ্রহ নিয়ে পড়তে থাকলে দ্রুতই আমি নাম মাত্র মূল্যে সুন্দর সুন্দর সোভিয়েত বই-পুস্তক ‘বিক্রি’ করা দোকান, বলাকা সিনেমা হলের কাছে ‘চলন্তিকা’ নামক দোকান থেকে বই এনে এনে পড়তে শুরু করি—সেভাবে মার্ক্সীয় ধ্যান-ধারণার সঙ্গে পরিচিত হয়ে তার আপাতঃদৃশ্য ‘বৈজ্ঞানিক’ বিশ্লেষণ সম্পৃক্ততায় আকৃষ্ট হই।
অবচেতনায় সেই ‘বৈজ্ঞানিক’ বিশ্লেষণে আকর্ষণের সূচনার সে সময় খুদ নিজেদের সমাজ নিয়ে বদরুদ্দীন উমরের একই মার্ক্সীয় সমাজ-বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ সম্পৃক্ত লেখা পড়ে তা’তে কিছুটা তুলনামূলক সচেতনেই যেন এখন আরো আকৃষ্ট হই। সে আকর্ষণের পথ ধরে অচিরেই আমি, আমন্ত্রণ-পূর্বক ফোর্ড ‘স্কলার’ হিসেবে অস্ট্রেলীয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে, গবেষণাভিত্তিক স্নাতকোত্তর করতে গেলে, সেখানে আর তৎপরবর্তী সময়ে, সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ে, অস্ট্রেলীয় কমিউনিস্ট তাত্ত্বিক, রেক্স মর্টিমারের অধীন—বিপ্লবী যুদ্ধের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণভিত্তিক গবেষণা-পূর্বক পিএইচডির কাজ শুরু করি। তার আরেকটু পরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এমআইটিতে পিএইচডি গবেষণাকালে, উইলার্ড জন্সনের অধীন নয়া-মার্ক্সীয় সমাজ-বিশ্লেষণভিত্তিক রাজনৈতিক অর্থনীতি যদিও এসব কাজে সাধারণ পাশ্চাত্য গণতান্ত্রিক বিশ্লেষণের সঙ্গে মার্ক্সীয় সমাজ-বিশ্লেষণ পদ্ধতিতেও গবেষণা করি।
কিন্তু বদরুদ্দীন উমরের বা রেক্স মর্টিমারের কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় রাজনীতির অনুসরণে কমিউনিস্ট হইনি একেবারেই, কখনো। তা একাধিক কারণে—তার ভেতর খোদ উমর ভাইয়ের নিজের জীবনের রাজনীতির মূল প্রেরণা, তার বাবা, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পণ্ডিত, মাননীয় আবুল হাশিমও অন্তর্ভুক্ত। তিনি ছিলেন বাংলাদেশে স্বজাতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের শেকড় থেকে উৎসারিত প্রেরণা-জাত মজলুমের পক্ষে দাঁড়ানোর স্পৃহার রাজনীতির অন্যতম অগ্রদূত, তৎকালে অবিভক্ত বাংলার বিশালতর মজলুম সংখ্যাগরিষ্ঠের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিষ্ঠান বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আর নবপ্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে পূর্ববাংলা তথা বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অধিকার রক্ষার সংগ্রামের অঙ্কুর, ভাষা আন্দোলনের অগ্রদূত ‘তমদ্দুন মজলিসের’ অন্যতম পথিকৃৎ—বদরুদ্দীন উমরের মজলুমের পক্ষে দাঁড়ানোর যে স্পৃহা তাকে মার্ক্স হয়ে মার্ক্সবাদ ও তার প্রায়োগিক রাজনৈতিক রূপ, ‘কমিউনিস্ট পার্টি’তে নিয়ে ফেলে, তার মুলে তার বাবার ওই একই প্রেরণা। অক্সফোর্ডে যাওয়ার পর সম্ভবত সেখানে আত্মস্থ করা অন্যান্য প্রভাবে তা মার্ক্সবাদী ধারায় চালিত হয়ে পড়ে। উমর ভাই দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে মার্ক্সীয় সমাজ-বিশ্লেষণ পদ্ধতি আপনে নিলেও, কৈশোরে তার থেকেও বেশি তার বাবা, মাননীয় আবুল হাশিমের প্রভাবে আমি কমিউনিস্ট হওয়া থেকে বিরত থেকে যাই।
পারিবারিক ঐতিহ্যের কারণেই আমার অবচেতনায় নিরঙ্কুশ কমিউনিস্ট চিন্তা-চেতনার গ্রহণীয় হয় না। আমার মা-বাবাও, উমর ভাইয়ের বাবা, মাননীয় আবুল হাশিমের মতোই সমাজসচেতন, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে সক্রিয় সংস্কারপন্থি ছিলেন আর তারই মতো তা’ ছিলেন দেশীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আওতায়। আশৈশব তাদেরই প্রভাবে অবচেতনা যেভাবে গড়ে উঠেছিল, কৈশোরে মার্ক্সবাদী কিশোর সংগঠন ‘খেলাঘর’-এর সঙ্গে সঙ্গে মাননীয় আবুল হাশিমের প্রতিষ্ঠানের ছত্রছায়ায় ঐতিহ্যবাদী সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘কিশোর সাহিত্য মজলিস’-এর কর্মকাণ্ডে সক্রিয়তার প্রভাবে তা’ই আরো প্রভাবশালী হয়। উমর ভাইয়ের নিজের কৈশোরে যে ‘কিশোর লীগ’ নামে ঔপনিবেশিক শাসনবিরোধী, সমাজবিপ্লবী কিন্তু একই সঙ্গে দেশীয় ঐতিহ্যবাদী সংগঠনে সক্রিয় ছিলেন উমর ভাই, তারই উত্তরসূরি রূপ ছিল, অনানুষ্ঠানিকভাবে মাসিক ‘সবুজ পাতা’র প্রকাশক প্রতিষ্ঠানের এক জ্যেষ্ঠ কিশোর কর্মচারী, শেখ তোফাজ্জল হোসেন চালিত ‘কিশোর সাহিত্য মজলিস’। দেশমুক্তির পর তারই উত্তরসূরি হিসেবে একই ‘তোফাজ্জল ভাই’-এর পরিচালনায় হয় ‘অনুশীলন সংঘ’। এসবেরই প্রভাব ছিল একই সঙ্গে উপনিবেশবাদবিরোধিতা, সমাজ-বিপ্লবী চিন্তা ও দেশীয় ঐতিহ্যবাদী চেতনা—আর এই দেশীয় ঐতিহ্যবাদী চেতনা, উপনিবেশবাদবিরোধী সমাজ-বিপ্লবী চিন্তা সত্ত্বেও কমিউনিস্ট দৃষ্টিভঙ্গির অন্তরায় ছিল।
এছাড়া আশৈশব আমেরিকান লাইব্রেরি থেকে নিয়মিত এনে এনে বই পড়ে পড়ে পাশ্চাত্য গণতান্ত্রিক মানবিক মূল্যবোধ আর নিয়মতান্ত্রিক সমাজ রক্ষা ও পরিবর্তনের ধারণাও এতদূর আত্মস্থ করি যে আমার সে অবচেতনা যে সেই মূল্যবোধ ও ধারণাকে ডিঙিয়ে কমিউনিস্ট তত্ত্ব মোতাবেক সশস্ত্র শ্রেণি-সংগ্রামের পথ আর মানবাধিকার দলনকারী কমিউনিস্ট স্বৈরশাসনব্যবস্থা গ্রহণে অপারগই থেকে যায়। কিন্তু জুলুম নিবারণ-পূর্বক সামাজিক ন্যায়-বিচার ও প্রগতির স্বার্থে, ঐতিহ্যবাহী মানবিক মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ সমাজ সংস্কারের কর্মের দিকনির্দেশনার ভিত্তি নিরূপণে বদরুদ্দীন উমরের অনুপ্রেরণালব্ধ মার্ক্সীয় সমাজ-বিশ্লেষণের মহামূল্য উপযোগ উপলব্ধিতে তা বাধ সাজেনি।
তিনি তার অনুসরণকারী অন্ধভক্তের কোনো দল—কোনো ‘কাল্ট’ তৈরি করে রেখে যাননি। তার সীমিত ক্ষমতায় সীমিত পরিসরেই যে কর্ম ও অনুপ্রেরণার ফসল রেখে গিয়েছেন, তাতে তার মানসিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব না করেই মুক্তবিহঙ্গের মতো যে যেটা যতখানি নেবে, জাতীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ তার যা কিছু, অন্যান্য উপাদানের সঙ্গে সমন্বিত তা দিয়েই হয়তো একদিন নির্মিত হবে সেই জাতীয় মুক্তি, যার স্বপ্ন তিনি দেখে গেছেন—দেখিয়ে গিয়েছেন। নকীব যেভাবে আগামীর ডাক দিয়ে যায়।
জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল করেছিলেন—তার সদস্যসংখ্যা নগণ্য। কিন্তু শুধু তার নামটুকুতেই যে কথাটুকু বলে দেওয়া, তা লাখ লাখ সদস্য-সমর্থকের জনসভার অর্জন-উপার্জন থেকে বড়। একটি সার্বিক মুক্তি পিপাসু জাতির চলমান অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধের আগামীর অপরিহার্য অত্যাবশ্যক মানসিক লংমার্চের সূচনাবত।
ইতিহাসে মাঝেমধ্যে এমন সব ব্যক্তিত্বের নীরব উদয় হয়ে থাকে, যারা খুব ঢাকঢোল পিটিয়ে, লাখ লাখ অনুসারীর বিশাল বিশাল জনসভায় বক্তৃতা না দিয়েও নিজের নীরব ও সীমিত কর্মের মাধ্যমে সমাজ সদস্যদের অনুপ্রাণিত এবং প্রভাবিত করে এক নীরব সাংস্কৃতিক বিপ্লবের রূপায়ণ করেন। যার মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি ও তাদের থেকে ব্যাপকতর সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির এমন পরিবর্তন হয়, যার পথ ধরে সামাজিক এবং রাজনৈতিক বিপ্লবের পথ প্রশস্ত হয়। বাংলাদেশের জন্য বদরুদ্দীন উমর ছিলেন এমনই এক ব্যক্তিত্ব। জীবদ্দশায় বাংলাদেশের বিভিন্ন পর্যায়ের পরিবর্তনে তার অবদান তেমন আলোচিত বা স্বীকৃত হয়নি; কিন্তু কালে, সামাজিক ইতিহাস বিশ্লেষকদের গবেষণায় তা উন্মোচিত হতে পারে একসময়।
তার এই নীরব অনুপ্রেরণা ও প্রভাবের কিঞ্চিৎ তার অনুজপ্রতিম আমাদের অনেকের মত, আমিও আজ উপলব্ধি করছি, তার প্রয়াণের পর। তারই কিঞ্চিৎ নমুনা লিপিবদ্ধ করে রাখার জন্য এই নাতিদীর্ঘ লেখা।
এই মাত্র কটি দিন পূর্বে, বহু বছর পরই কথা হচ্ছিল বদরুদ্দীন উমর, ‘উমর ভাই’কে নিয়ে। দেশ থেকে বহু দূরে, এক নবপরিচিতের নিজেকে ‘উমর ভাই’য়েরই সম্পর্কে নাতি বলে নিজের একটি পরিচয় দিলে। এরপর, এত তাড়াতাড়ি উনি চলে যাবেন, তা তখন চিন্তায়ও আসেনি। সেদিন তার সম্পর্কে যা বলিনি—খেয়ালও হয়তো করিনি—আজ তার প্রয়াণে সেসব কথা মনে হচ্ছে। আমিসহ আরো অনেকের অবচেতন মন-মানস, দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণার রূপায়ণে তার যে একটি প্রচ্ছন্ন প্রভাব ছিল, তা মনে পড়ছে।
ফ্রয়েডীয় মনোবিশ্লেষণ বিজ্ঞান মতে, আজীবন অবচেতনায় পরিচালিত করে যেসব ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-চেতনা, তার প্রায় সবটাই অবচেতনায় আত্মস্থ হয়ে থাকে সাধারণত শৈশবের প্রথম পাঁচ-ছটি বছর আর বাল্যকাল আর যৌবনের বয়ঃসন্ধিকালে, কৈশোরে, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করেন যারা, তাদের ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-চেতনার প্রভাবে। ঐতিহ্যগত সমাজব্যবস্থায়, এই বয়ঃসন্ধিকালেই নিয়মিত যৌন জীবনের সূচনাও হয় বলে, সে সময়ে প্রধানতর যৌনসঙ্গীর প্রভাবে তার যে ধ্যান-ধারণা ও চিন্তা-চেতনার অনেক কিছুই আত্মস্থ করে অবচেতনা, তাও হয় এই কৈশোরেই। এভাবে ঐতিহ্যগতভাবে, সাধারণত সারা জীবনের চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা—দৃতষ্টিভঙ্গি—মোটামুটি মৌলিকপর্যায়ে স্থায়ী হয়ে যায়—যদিও শিল্পায়ন-জাত পুঁজিবাদী সমাজে পুঁজির স্বার্থে বিবাহবয়স বিলম্বের কারণে পুঁজিবাদ্গ্রস্ত সমাজে অবচেতনার দৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণে কিছু ছেদ পড়ে। সে যাই হোক, আমিসহ, বাংলাদেশের আমাদের আর তার পরের প্রজন্মের অনেকের কৈশোরে আমাদের অবচেতনার চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গির রূপায়ণে যাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব কার্যকর হয়, তাদের ভেতর—তাদের ও আমাদের অজ্ঞাতেই—বদরুদ্দীন উমরও ছিলেন ।
তার সব চিন্তা-চেতনাই যে আমি আত্মস্থ করি, এমন নয়—অনেক কিছুতেই তার সঙ্গে একমত নই। কিন্তু তার দ্বারা যেসব বিষয়ে অনুপ্রাণিত হই, তার কথা বলা দরকার। সে অনুপ্রেরণা অন্যদেরও অনুপ্রাণিত করতে পারে, সে আশায়। এটা তারই আজীবন কর্মের অবদান হবে।
তার প্রথমটি হলো, সমাজ-বিশ্লেষণভিত্তিক সমাজ-সচেতনতায় ইতিবাচক সমাজপরিবর্তনে আত্মনিবেদন। সামাজিক রাজনৈতিক কর্মী বাবা-মায়ের সন্তান হিসেবে সমাজ-সচেতনাতা আর সমাজ পরিবর্তনে আত্মনিবেদন আশৈশবই উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ছিল আমার। কিন্তু তার ভিত্তি রূপে সমাজবিশ্লেষণ, যতদূর মনে পড়ে, ষাটের দশকের শেষ দিকে আমাদের কৈশোরে লক্ষ করি, অক্সফোর্ড ফেরা বদরুদ্দীন উমরের প্রকাশিত পুস্তক, ‘সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা’তে। তার অনুপ্রেরণাতেই সম্ভবত তারপর শিগগিরই আমার লেখালেখি পূর্বতন কথাসাহিত্য ও শিল্পীসুলভ বর্ণনামূলক প্রবন্ধ থেকে সমাজ-বিশ্লেষণভিত্তিক হতে শুরু করে।
গল্প, উপন্যাস, কবিতা লেখা প্রায় বন্ধই হয়ে যায় আমার। অন্যদিকে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকেই সমাজ-বিশ্লেষণাত্মক পড়াশোনার সঙ্গে কিঞ্চিৎ লেখার চেষ্টা কিছুটা করে বছরের শেষে, ১৯৭২ সালের প্রায় শুরু থেকেই প্রধানত তখনকার সবচেয়ে প্রভাবশালী সাময়িকী, সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’য় নিয়মিত সমাজ-বিশ্লেষণভিত্তিক প্রবন্ধ বা ‘কলাম’ লিখে নিজের ওই বয়সে ইতিবাচক সমাজ পরিবর্তনের দিকনির্দেশনা মনে হতো, তা প্রকাশ করি। এছাড়া দেশের প্রায় সব সাময়িকী ও পত্রিকায় দেদার লিখতে থাকি। যদিও সমাজ পরিবর্তনের স্পৃহা ও তার দিকনির্দেশনামূলক যা বলতাম, তা উমর ভাই থেকে না এসে থাকলেও—তার ভিত হিসেবে সমাজ-বিশ্লেষণের অভ্যাসটি খুব সম্ভব পরোক্ষ ও আংশিকভাবে হলেও ছিল তার প্রভাবেই।
উমর ভাইয়ের সমাজ-বিশ্লেষণ ছিল মার্ক্সীয় (Marxian), তার মার্ক্সবাদী (Marxist) সমাজ-রাজনৈতিক অবস্থানেরই উৎস। সরাসরি বা এককভাবে উমর ভাই থেকে না হলেও, সম্ভবত তারও প্রভাবে, আমি আমার নিজের সমাজ-বিশ্লেষণেও মার্ক্সীয় সমাজ-বিশ্লেষণ পদ্ধতি অনুসরণ করতে শুরু করি, অংশতঃ—যদিও তার মতো মার্ক্সবাদী, তথা ‘কমিউনিস্ট’ হইনি কখনো। মার্ক্সীয় বিশ্লেষণ পদ্ধতির সঙ্গে, নিজের অজ্ঞাতেই অনেকটা, আমার পরিচয় হয় সেকালে বাংলাদেশে সোভিয়েত রাজনৈতিক দর্শন ও অবস্থানের পক্ষে প্রচারণা ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রধান মাধ্যম দৈনিক ‘সংবাদ’-এর কিশোর বিভাগ, ‘খেলাঘর’ আর তার সাক্ষাৎ নিয়ন্ত্রণাধীন একই নামের দেশব্যাপী সক্রিয় কিশোর সংগঠনের মাধ্যমে।
১৯৬৭ বা ১৯৬৮ সালে ‘খেলাঘর’ সংগঠক, কুমিল্লানিবাসী ঢাকার দৈনিক ‘সংবাদ’-এর সাংবাদিক আহমদ নূরে আলম, ঢাকায় আমাদের পাড়ার কুমিল্লানিবাসী খেলার সাথি খোকা-ভুটিয়াদের বাসায় মেহমান এলে আমাদের পাড়ার কিশোরদের দেশের সর্ববৃহৎ ‘খেলাঘর’ শাখা প্রতিষ্ঠায় অনুপ্রাণিত করেন। পাড়ার খেলার সাথিদের সঙ্গে আমিও, তার পেছনের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির কথা না জেনে-বুঝেই তাতে যোগ দিই। নূরে আলম ভাই প্রতি সপ্তাহে আমাদের বাসার পাশের ছোট্ট খেলার মাঠে একটি ‘ধাঁধার আসর’-এর ব্যবস্থা করতেন—তা’তে সাধারণ জ্ঞানের প্রশ্ন করা হতো আর প্রতি সপ্তাহে আমিই প্রথম পুরস্কার পেতাম। সে পুরস্কারে প্রায়ই সোভিয়েত রুশিয়া থেকে প্রকাশিত সুন্দর সুন্দর গল্পের বই দেওয়া হতো। সেগুলো খুব আগ্রহ নিয়ে পড়তে থাকলে দ্রুতই আমি নাম মাত্র মূল্যে সুন্দর সুন্দর সোভিয়েত বই-পুস্তক ‘বিক্রি’ করা দোকান, বলাকা সিনেমা হলের কাছে ‘চলন্তিকা’ নামক দোকান থেকে বই এনে এনে পড়তে শুরু করি—সেভাবে মার্ক্সীয় ধ্যান-ধারণার সঙ্গে পরিচিত হয়ে তার আপাতঃদৃশ্য ‘বৈজ্ঞানিক’ বিশ্লেষণ সম্পৃক্ততায় আকৃষ্ট হই।
অবচেতনায় সেই ‘বৈজ্ঞানিক’ বিশ্লেষণে আকর্ষণের সূচনার সে সময় খুদ নিজেদের সমাজ নিয়ে বদরুদ্দীন উমরের একই মার্ক্সীয় সমাজ-বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ সম্পৃক্ত লেখা পড়ে তা’তে কিছুটা তুলনামূলক সচেতনেই যেন এখন আরো আকৃষ্ট হই। সে আকর্ষণের পথ ধরে অচিরেই আমি, আমন্ত্রণ-পূর্বক ফোর্ড ‘স্কলার’ হিসেবে অস্ট্রেলীয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে, গবেষণাভিত্তিক স্নাতকোত্তর করতে গেলে, সেখানে আর তৎপরবর্তী সময়ে, সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ে, অস্ট্রেলীয় কমিউনিস্ট তাত্ত্বিক, রেক্স মর্টিমারের অধীন—বিপ্লবী যুদ্ধের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণভিত্তিক গবেষণা-পূর্বক পিএইচডির কাজ শুরু করি। তার আরেকটু পরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এমআইটিতে পিএইচডি গবেষণাকালে, উইলার্ড জন্সনের অধীন নয়া-মার্ক্সীয় সমাজ-বিশ্লেষণভিত্তিক রাজনৈতিক অর্থনীতি যদিও এসব কাজে সাধারণ পাশ্চাত্য গণতান্ত্রিক বিশ্লেষণের সঙ্গে মার্ক্সীয় সমাজ-বিশ্লেষণ পদ্ধতিতেও গবেষণা করি।
কিন্তু বদরুদ্দীন উমরের বা রেক্স মর্টিমারের কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় রাজনীতির অনুসরণে কমিউনিস্ট হইনি একেবারেই, কখনো। তা একাধিক কারণে—তার ভেতর খোদ উমর ভাইয়ের নিজের জীবনের রাজনীতির মূল প্রেরণা, তার বাবা, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পণ্ডিত, মাননীয় আবুল হাশিমও অন্তর্ভুক্ত। তিনি ছিলেন বাংলাদেশে স্বজাতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের শেকড় থেকে উৎসারিত প্রেরণা-জাত মজলুমের পক্ষে দাঁড়ানোর স্পৃহার রাজনীতির অন্যতম অগ্রদূত, তৎকালে অবিভক্ত বাংলার বিশালতর মজলুম সংখ্যাগরিষ্ঠের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিষ্ঠান বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আর নবপ্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে পূর্ববাংলা তথা বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অধিকার রক্ষার সংগ্রামের অঙ্কুর, ভাষা আন্দোলনের অগ্রদূত ‘তমদ্দুন মজলিসের’ অন্যতম পথিকৃৎ—বদরুদ্দীন উমরের মজলুমের পক্ষে দাঁড়ানোর যে স্পৃহা তাকে মার্ক্স হয়ে মার্ক্সবাদ ও তার প্রায়োগিক রাজনৈতিক রূপ, ‘কমিউনিস্ট পার্টি’তে নিয়ে ফেলে, তার মুলে তার বাবার ওই একই প্রেরণা। অক্সফোর্ডে যাওয়ার পর সম্ভবত সেখানে আত্মস্থ করা অন্যান্য প্রভাবে তা মার্ক্সবাদী ধারায় চালিত হয়ে পড়ে। উমর ভাই দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে মার্ক্সীয় সমাজ-বিশ্লেষণ পদ্ধতি আপনে নিলেও, কৈশোরে তার থেকেও বেশি তার বাবা, মাননীয় আবুল হাশিমের প্রভাবে আমি কমিউনিস্ট হওয়া থেকে বিরত থেকে যাই।
পারিবারিক ঐতিহ্যের কারণেই আমার অবচেতনায় নিরঙ্কুশ কমিউনিস্ট চিন্তা-চেতনার গ্রহণীয় হয় না। আমার মা-বাবাও, উমর ভাইয়ের বাবা, মাননীয় আবুল হাশিমের মতোই সমাজসচেতন, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে সক্রিয় সংস্কারপন্থি ছিলেন আর তারই মতো তা’ ছিলেন দেশীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আওতায়। আশৈশব তাদেরই প্রভাবে অবচেতনা যেভাবে গড়ে উঠেছিল, কৈশোরে মার্ক্সবাদী কিশোর সংগঠন ‘খেলাঘর’-এর সঙ্গে সঙ্গে মাননীয় আবুল হাশিমের প্রতিষ্ঠানের ছত্রছায়ায় ঐতিহ্যবাদী সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘কিশোর সাহিত্য মজলিস’-এর কর্মকাণ্ডে সক্রিয়তার প্রভাবে তা’ই আরো প্রভাবশালী হয়। উমর ভাইয়ের নিজের কৈশোরে যে ‘কিশোর লীগ’ নামে ঔপনিবেশিক শাসনবিরোধী, সমাজবিপ্লবী কিন্তু একই সঙ্গে দেশীয় ঐতিহ্যবাদী সংগঠনে সক্রিয় ছিলেন উমর ভাই, তারই উত্তরসূরি রূপ ছিল, অনানুষ্ঠানিকভাবে মাসিক ‘সবুজ পাতা’র প্রকাশক প্রতিষ্ঠানের এক জ্যেষ্ঠ কিশোর কর্মচারী, শেখ তোফাজ্জল হোসেন চালিত ‘কিশোর সাহিত্য মজলিস’। দেশমুক্তির পর তারই উত্তরসূরি হিসেবে একই ‘তোফাজ্জল ভাই’-এর পরিচালনায় হয় ‘অনুশীলন সংঘ’। এসবেরই প্রভাব ছিল একই সঙ্গে উপনিবেশবাদবিরোধিতা, সমাজ-বিপ্লবী চিন্তা ও দেশীয় ঐতিহ্যবাদী চেতনা—আর এই দেশীয় ঐতিহ্যবাদী চেতনা, উপনিবেশবাদবিরোধী সমাজ-বিপ্লবী চিন্তা সত্ত্বেও কমিউনিস্ট দৃষ্টিভঙ্গির অন্তরায় ছিল।
এছাড়া আশৈশব আমেরিকান লাইব্রেরি থেকে নিয়মিত এনে এনে বই পড়ে পড়ে পাশ্চাত্য গণতান্ত্রিক মানবিক মূল্যবোধ আর নিয়মতান্ত্রিক সমাজ রক্ষা ও পরিবর্তনের ধারণাও এতদূর আত্মস্থ করি যে আমার সে অবচেতনা যে সেই মূল্যবোধ ও ধারণাকে ডিঙিয়ে কমিউনিস্ট তত্ত্ব মোতাবেক সশস্ত্র শ্রেণি-সংগ্রামের পথ আর মানবাধিকার দলনকারী কমিউনিস্ট স্বৈরশাসনব্যবস্থা গ্রহণে অপারগই থেকে যায়। কিন্তু জুলুম নিবারণ-পূর্বক সামাজিক ন্যায়-বিচার ও প্রগতির স্বার্থে, ঐতিহ্যবাহী মানবিক মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ সমাজ সংস্কারের কর্মের দিকনির্দেশনার ভিত্তি নিরূপণে বদরুদ্দীন উমরের অনুপ্রেরণালব্ধ মার্ক্সীয় সমাজ-বিশ্লেষণের মহামূল্য উপযোগ উপলব্ধিতে তা বাধ সাজেনি।
তিনি তার অনুসরণকারী অন্ধভক্তের কোনো দল—কোনো ‘কাল্ট’ তৈরি করে রেখে যাননি। তার সীমিত ক্ষমতায় সীমিত পরিসরেই যে কর্ম ও অনুপ্রেরণার ফসল রেখে গিয়েছেন, তাতে তার মানসিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব না করেই মুক্তবিহঙ্গের মতো যে যেটা যতখানি নেবে, জাতীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ তার যা কিছু, অন্যান্য উপাদানের সঙ্গে সমন্বিত তা দিয়েই হয়তো একদিন নির্মিত হবে সেই জাতীয় মুক্তি, যার স্বপ্ন তিনি দেখে গেছেন—দেখিয়ে গিয়েছেন। নকীব যেভাবে আগামীর ডাক দিয়ে যায়।
জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল করেছিলেন—তার সদস্যসংখ্যা নগণ্য। কিন্তু শুধু তার নামটুকুতেই যে কথাটুকু বলে দেওয়া, তা লাখ লাখ সদস্য-সমর্থকের জনসভার অর্জন-উপার্জন থেকে বড়। একটি সার্বিক মুক্তি পিপাসু জাতির চলমান অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধের আগামীর অপরিহার্য অত্যাবশ্যক মানসিক লংমার্চের সূচনাবত।
এই বছর অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে উদ্ভাবন ও সৃজনশীল ধ্বংসের প্রক্রিয়া (creative destruction) কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে সেই গবেষণার ওপর। নতুন প্রযুক্তি ও ধারণা পুরোনো ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন করে সমাজ যখন পরিবর্তনের জন্য উন্মুক্ত থাকে, তখনই টেক
৮ ঘণ্টা আগে‘মনের তালা খুলল কে, চাবিওয়ালা, চাবিওয়ালা!’ প্রখ্যাত শিল্পী রুনা লায়লার সেই সুরেলা প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে বেড়াচ্ছি! তবে ব্যক্তিগত জীবনে নয়, রাষ্ট্রীয় জীবনে। এই রাষ্ট্রের জীবনেও একটা বিশেষ তালা আছে, আর তার নাম আর্টিকেল ৭০! এই তালা লাগানো হয়েছিল সেই সব মাননীয়র জন্য, যাদের মধ্যে ‘ছাগলীয়’ প্রবৃত্তি রয়ে
৮ ঘণ্টা আগেভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে প্রায়ই তার পরম বন্ধু বলে বেশ গৌরবের সঙ্গে প্রচার করে থাকেন। ভিন্ন দেশের এ দুই রাজনীতিবিদের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের মূল সূত্র হলো মুসলমানদের প্রতি তাদের তীব্র ঘৃণা। বর্তমান বিশ্বে ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত শীর্ষ দুটি
৮ ঘণ্টা আগেগাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন হতাশা চরমে, তখনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন এক নতুন ‘২০ দফার শান্তি পরিকল্পনা’। সেখানে তিনি নিজেকে বসিয়েছেন একটি তথাকথিত ‘বোর্ড অব পিস’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে।
১ দিন আগে