অনৈক্যের ফল কী হতে পারে

সায়ন্থ সাখাওয়াৎ
প্রকাশ : ০৫ জুন ২০২৫, ১০: ৪৫

রাজনীতিতে নানামুখী অনিশ্চয়তা আছে। সমাজের নানা শ্রেণির মানুষের দাবি-দাওয়া নিয়ে রাজপথে চলছে অস্থিরতা। এসব অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতায় অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, সংস্কার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নতুন বিনিয়োগে আস্থা পাচ্ছেন না বিনিয়োগকারীরা। এতে কর্মসংস্থান বাড়ছে না। গত ৯ মাসে অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে স্থিতিশীলতা এলেও বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে সুখবর নেই। কথাগুলো লিখেছেন অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন। (প্রথম আলো, ০২ জুন ২০২৫) এ সময় বাংলাদেশ নিয়ে কথাগুলো যে সত্য এটা অস্বীকার করার উপায় নেই কারো। ডক্টর দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যও বলেছেন, ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের হিসাবে এ সরকারের আমলে ২৭ লাখ মানুষ আরো বেশি দরিদ্র হয়ে গেছে। এর মধ্যে ১৮ লাখ হলো নারী। এটাই বাস্তবতা।

বিজ্ঞাপন

দেশে বহুবিধ ইস্যুতে চলছে অস্থিরতা। নির্বাচিত সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্বে না এলে যে এই নানামুখী অস্থিরতা অনিশ্চয়তা কাটবে না, এটাও বাস্তবতা। ইতিমধ্যে বিএনপি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের জন্য কঠোর অবস্থানে যাওয়ার আভাস দিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস জাপান সফরকালে বলেছেন, একটিমাত্র দল ডিসেম্বরে নির্বাচন চায়। কিন্তু সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্ট বলছে, বহু দলই ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায়। এ বিষয়ে পত্রিকাগুলোর কিছু নিউজ হেডলাইন পড়লেও বোঝা যায় ডিসেম্বরে নির্বাচন চাওয়াদের পাল্লা ভূমিতে ঠেকে গেছে। ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায় ৫৩ রাজনৈতিক দল (যুগান্তর, ০২ জুন ২০২৫), দেশের সব গণতান্ত্রিক দল ডিসেম্বরে নির্বাচন চায় : ১২-দলীয় জোট (প্রথম আলো, ৩১ মে ২০২৫), ডিসেম্বরে ভোট চায় শতাধিক দল (কালের কণ্ঠ অনলাইন, ৩১ মে ২০২৫), ৫০টির অধিক রাজনৈতিক দল ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন চায় (ইনকিলাব, ৩১ মে ২০২৫)-এই নিউজ হেডলাইনগুলো যে বার্তা স্পষ্ট করে তা হলো ডিসেম্বরে নির্বাচন না হলে ডক্টর ইউনূসের সরকার বেকায়দায় পড়তে পারে।

কালের কণ্ঠ লিখেছে, নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত শতাধিক দল আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন দাবি করছে।

নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৫০টি রাজনৈতিক দল রয়েছে। এর মধ্যে স্থগিত রয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নিবন্ধন। বাকি ৪৯ দলের প্রায় সব কটিই ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দাবি করছে। এ ছাড়া আরো শতাধিক অনিবন্ধিত দলের অধিকাংশই চায় ডিসেম্বর কিংবা তারও আগে সংসদ নির্বাচন। এ ব্যাপারে তাদের সবার অবস্থানই পরিষ্কার।

এমনকি রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় পর্বের আলোচনার উদ্বোধনী পর্বে ২ জুনও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বক্তব্যে নির্বাচনের রোডম্যাপ দেওয়ার বিষয়টিই ঘুরেফিরে গুরুত্ব পেয়েছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এ বিষয়ে প্রকাশিত রিপোর্টে লেখা হয়, আলোচনায় অংশ নেওয়া বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন করার পক্ষে মত দিয়েছে। কোনো কোনো দল বলেছে, প্রধান উপদেষ্টা যে ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন দেওয়ার কথা বলেছেন, সেটা কোন মাসে হবে, তা ঘোষণা করা উচিত। আবার কোনো দল ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণার পর নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করতে বলেছে। সংবাদমাধ্যমগুলো আলোচনায় অংশ নেওয়া বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাৎ হোসেন সেলিমকে উদ্ধৃত করে লিখেছে, প্রায় ৩২টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২৬ জন বক্তব্য দিয়েছেন। তাদের মধ্যে ২৩ জন অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় ডিসেম্বরে নির্বাচন দাবি করেছেন। একটি দল বলেছে, নির্বাচন জানুয়ারিতে হতে পারে, ফেব্রুয়ারিতে হতে পারে। তারপর নির্বাচন হওয়ার মতো প্রাকৃতিক পরিবেশ নেই। একটি রাজনৈতিক দল বিচার ও সংস্কারের পর নির্বাচন দাবি করেছে।

কিন্তু প্রধান উপদেষ্টার জাপান সফর নিয়ে করা প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রেসসচিব শফিকুল আলমের কথায় সরকারের অস্পষ্টতা ছিল লক্ষণীয়। তিনি বলেছেন, এটা (নির্বাচন) আগেও হতে পারে, ৩০ জুন মানে এর বেশি যাবে না। এর মধ্যে এটা ডিসেম্বরে হতে পারে, জানুয়ারিতে হতে পারে, ফেব্রুয়ারিতে হতে পারে, মার্চেও হতে পারে, এপ্রিলে হতে পারে, মে মাসেও হতে পারে, জুনেও হতে পারে। কিন্তু জুনের ৩০-এর পরে যাবে না।

প্রেসসচিবের এই বেসুরো গানে মানুষ না খুঁজে পেয়েছে কোনো তাল-লয়, না পেয়েছে কোনো মেসেজ। রাজনৈতিক দল ও দেশের মানুষ তো এত তারিখ চায় না। তারা একটা সম্ভাব্য তারিখ চায়। সেটি দিতে না পারলে চুপ থাকাই শ্রেয়। অপ্রয়োজনীয় কথা যত বেশি বলা হবে, বিরক্তি তত বাড়বে।

যেসব দল ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায়, তারা তো তার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরছে। কিন্তু ডিসেম্বরের মধ্যে না দিয়ে এটাকে জুন পর্যন্ত টেনে নেওয়ার পক্ষে সরকার তো কোনো স্পষ্ট যুক্তি তুলে ধরছে না। তারা বলার চেষ্টা করছে, জুন পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকলে বড় প্যাকেজের সংস্কার সম্ভব হবে। কিন্তু সরকার কী ধরনের প্যাকেজ চায়, তা জানিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে কেন বলছে না যে এই সংস্কারগুলোর বিষয়ে ঐকমত্য সৃষ্টি করে যদি ডিসেম্বরের মধ্যে সম্পন্ন করা যায়, তবে ডিসেম্বরেই নির্বাচন দেওয়া যাবে। এমনকি এই যে ডিসেম্বর থেকে শুরু করে ৩০ জুন পর্যন্ত প্রেসসচিব ম্যারাথন সংগীত পরিবেশন করলেন, সেটা না করে বলে দিলেই পারেন যে তারা কোন মাসের কত তারিখে নির্বাচন করবেন, কবে শিডিউল হবে এবং কেন এ সময়টাই সেরা। এই বাড়তি সময় তাদের কেন দরকার হচ্ছে এবং এর মধ্যে তারা কী কী করতে চান, সেটা বললেও তো একটা আলোচনা হতে পারত। কিন্তু সরকারের মতলব রহস্যময়। মনে হচ্ছে, রহস্য উপন্যাসের শেষ অধ্যায় তারা স্ট্যাপলিং করে রাখতে পণ করেছেন।

সরকারের এই রহস্যময়তা বিএনপিসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাদের দূরত্ব বাড়িয়ে তাকে বৈরিতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলো প্রধান উপদেষ্টা ডক্টর মুহম্মদ ইউনূসকে টার্গেট করে কথা বলা শুরু করেছে। ফলে যে মানুষটি দশ মাস আগে গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের সব দলের কাছে ছিলেন হিরো, তিনি বিএনপিসহ অনেক দলের কাছে ইতিমধ্যে প্রায় ভিলেনের কাছাকাছি চলে এসেছেন।

এই দলগুলোর সঙ্গে, বিশেষ করে বিএনপির সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের অনৈক্য যদি কোনো কারণে অনতিক্রম্য হয়ে ওঠে, তাহলে তার খেসারত যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তা নিয়েও শঙ্কিত অনেকেই। সরকার যদি তার অবস্থানে অনড় থাকে এবং যৌক্তিক ব্যাখ্যা তুলে ধরে বিএনপির সঙ্গে দূরত্ব না কমিয়ে দলটিকে রাস্তায় নামতে বাধ্য করে, তাতে কারো ভালো হবে না। বিএনপি নির্বাচন আদায়ের একদফা দাবি নিয়ে রাস্তায় নামতে বাধ্য হলে তার মধ্যে পতিত ফ্যাসিস্টরা ঢুকে পড়ে দেশে অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টা করতে পারে। গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তিগুলোর অনৈক্য প্রকট হলে ফ্যাসিবাদের সেই অপচেষ্টা প্রতিহত করা সম্ভব নাও হতে পারে। পদত্যাগে বাধ্য হতে পারে ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার। তখন নিশ্চিতভাবে দেশ নতুন করে সাংবিধানিক সংকটে পড়তে পারে। বর্তমানে যেখানে ডক্টর ইউনূসের সরকার প্রশ্নেই গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তিগুলোর ঐক্য নেই, সেখানে নতুন করে আবার নির্বাচনকালীন সরকার গঠনে একমত হওয়া খুব সহজ হবে না। সেই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কার হাতে গিয়ে পড়ে, সেটা নিয়েও শঙ্কা আছে। সেই ঘোলা পানিতে বাংলাদেশে আবার ভারত তার হারানো আধিপত্য ফিরে পাওয়ার জন্য মরিয়া হবে।

ডক্টর ইউনূসের সরকার ফেল করলে তার খেসারত দিতে হবে পুরো দেশকে। গণতন্ত্রে উত্তোরণের পথ আরো জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে। তাই অন্তর্বর্তী সরকার ও বিএনপি মুখোমুখি বৈরী অবস্থানে আসুক, সেটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল চাওয়ার পরও যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য কারণ ব্যাখ্যা করে সবার ঐকমত্য তৈরি ছাড়াই ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে নির্বাচন না দিয়ে দেশে সংকট সৃষ্টি করলে তার দায় ডক্টর ইউনূসের ওপরই বর্তাবে। আবার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে যেতে নির্বাচন ছাড়া অন্য কোনো পথ রাজনৈতিক দলের জন্য যেহেতু নেই, তাই ক্ষমতায় যেতে হলে নির্বাচন ব্যাহত হয়, এমন কিছু বিএনপিরও করা ঠিক হবে না। এ ক্ষেত্রে আলোচনার বিকল্প নেই। খোলা মনে ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে সরকার ও বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা ছাড়া এ সংকট নিরসনের আর কোনো পথ নেই।

লেখক : কবি, কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়:

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত