
হার্শ ভি পান্ত ও শিভাম শেখাওয়াত

আমির খান মুত্তাকি ইসলামিক আমিরাত আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। গত ১০ অক্টোবর তিনি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠক হয়েছে নয়াদিল্লিতে। এই বৈঠক বুঝিয়ে দিয়েছে তালেবানদের সঙ্গে ভারতের লেনদেনের কৌশলটা কতটা নড়বড়ে।
ভারতের কর্মকর্তারা খুবই সতর্ক ছিলেন। মুত্তাকিকে তারা ‘আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তালেবান সরকারের নাম তারা একবারও নেননি। বৈঠকের কক্ষে অফিশিয়াল পতাকাও ছিল না। পুরোনো আফগান প্রজাতন্ত্রের পতাকা বা তালেবানদের সাদা ব্যানার—কোনোটাই সেখানে ছিল না।
আফগান দূতাবাসের পরিস্থিতি ছিল ভিন্নরকম। প্রজাতন্ত্রের পুরোনো তিনরঙের পতাকা উড়েছে বাইরে। কিন্তু মুত্তাকি আর তার টিম ভেতরে সাদা পতাকা ব্যবহার করেছে। তারা দাবি করেছেন, দূতাবাস তালেবানদের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। যেসব জনবল সেখানে কাজ করছে, তারাও তালেবানদের অধীনে কাজ করছেন বলে জানানো হয়েছে।
মুত্তাকির সফর শুরু হয় ৯ অক্টোবর। এক সপ্তাহ দীর্ঘ ছিল সফর। এই সফর ব্যাপক আগ্রহ ও নিবিড় পর্যবেক্ষণ উসকে দিয়েছে। তালেবানের একজন নেতাকে ভারত সরকারিভাবে আতিথেয়তা জানাচ্ছে—এটা খুবই বিরল। খুব কম মানুষই ভেবেছে এমনটা ঘটতে পারে। ২০২১ সালে আগস্টে এই সশস্ত্র গোষ্ঠী আবার ক্ষমতায় আসে।
কিন্তু ভারতকে এখন বাস্তববাদিতা আর বাস্তব রাজনীতির পথে হাঁটতে হচ্ছে। এর অর্থ হলো, বাস্তব চাহিদা আর জাতীয় স্বার্থে মনোযোগ দিতে হচ্ছে তাদের। ভারত ধারাবাহিকভাবে তালেবানদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ বাড়িয়েছে। এটা হয়েছে বিগত কয়েক বছর ধরে। তবে, এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে তালেবানদের স্বীকৃতি দেয়নি ভারত।
ভারতের যোগাযোগের সূত্রগুলো বেড়েছে। জানুয়ারিতে মুত্তাকি ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে দুবাইয়ে দেখা করেছিলেন। এপ্রিলে পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছিল। মুত্তাকি এপর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক যুগ্মসচিবের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। এই যুগ্মসচিব পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং ইরান সম্পর্কিত ইস্যুগুলো দেখাশোনা করেন। মুত্তাকি আর জয়শঙ্কর এমনকি মে মাসে ফোনে কথাও বলেছেন।
তালেবানদের সঙ্গে ভারতের বিনিময় এখন বেশ দ্রুত বাড়ছে। এর কারণ হলো নয়াদিল্লি অপারেশন সিঁদুর শুরু করেছিল। এই অভিযান ছিল পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের মোকাবিলার বৃহত্তর কৌশলের অংশ।
একই সঙ্গে, তালেবানরা ফিরে আসার পর থেকে আফগানিস্তান আর পাকিস্তানের সম্পর্কেরও অবনতি হয়েছে। ফলে তালেবানদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের সুযোগ বেড়ে গেছে ভারতের। ভারত সেখানে নিজেদের কৌশলগত স্বার্থ রক্ষা করতে চায়।
আঞ্চলিক কিছু বিষয়ও ভারতকে এই দিকে ঠেলে দিয়েছে। এ অঞ্চলের অন্য দেশগুলোও ধীরে ধীরে তালেবানদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াচ্ছে। তারা সম্পর্ক জোরদার করছে। রাশিয়া প্রথম দেশ হিসেবে জুন মাসে তালেবানদের স্বীকৃতি দিয়েছে। চীন ও মধ্য এশিয়ার আরো কিছু দেশ আফগানিস্তানের সঙ্গে রাষ্ট্রদূত বিনিময় করেছে।
তালেবান সরকারও ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়তে চায়। তারা কূটনৈতিক পরিসরে আরো বৈচিত্র্য নিয়ে আসতে চায়। এটা তাদের কৌশলের সঙ্গে মানানসই। নিজেদের তারা বাস্তববাদী খেলোয়াড় হিসেবে দেখাতে চাচ্ছে। অভিন্ন স্বার্থের ভিত্তিতে তারা অন্য দেশগুলোর সঙ্গে কাজ করতে চায়। সম্পর্ক যদি আনুষ্ঠানিকতা না-ও পায়, তবু তারা এই কাজ এগিয়ে নিতে চায়।
এই কৌশলের মূল কথা হলো—‘কারো শত্রু নয়, সবার বন্ধু’। এর উদ্দেশ্য হলো তালেবান সরকারের বৈধতা নিশ্চিত করা। তারা নিজেদের অ-আদর্শিক সরকার হিসেবে পরিচিত করাতে চাচ্ছে। তারা নিজেদের এমনভাবে তুলে ধরতে চাচ্ছে যে, যেখানে তাদের মনোযোগ হলো অর্থনীতি। ভারত সবশেষ দেশ হিসেবে এই ধারণা গ্রহণ করেছে।
১০ অক্টোবরের বৈঠকের পর দুই পক্ষই যৌথ বিবৃতি দিয়েছে। জয়শঙ্কর আফগানিস্তানের সঙ্গে ভারতের দীর্ঘদিনের সাংস্কৃতিক বন্ধনের কথা তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, আফগানিস্তানের উন্নয়নে সহায়তা দিতে ভারত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
পেহেলগাম হামলায় ‘জোরালো নিন্দা’ জানানোর কারণে তিনি তালেবানদের ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, তালেবানরা ভারতের নিরাপত্তা উদ্বেগ বুঝতে পারে। দুই পক্ষই এই অঞ্চলে শান্তি, স্থিতিশীলতা আর পারস্পরিক আস্থা প্রতিষ্ঠায় সম্মত হয়েছে। তারা বলেছেন, নিয়মিত যোগাযোগটা দুই পক্ষ জারি রাখবে।
এই বৈঠক ভারত-আফগানিস্তানের জন্য বাস্তব ফলও নিয়ে এসেছে। রাজনৈতিকভাবে ভারত কাবুলে তাদের দূতাবাসের কাজ পুরোপুরি চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ২০২২-এর জুন থেকে দূতাবাস মূলত টেকনিক্যাল মিশন হিসেবে পরিচালিত হচ্ছিল। ভারতও আনুষ্ঠানিকভাবে আফগানিস্তানের কূটনীতিকদের স্বীকৃতি দিয়েছে। কোনো পক্ষই অবশ্যই রাষ্ট্রদূত নিয়োগের কথা উল্লেখ করেনি।
ভারত মানবিক সহায়তা দেওয়ারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যেসব সরকারি অবকাঠামো ও উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ থমকে গিয়েছিল, সেগুলো আবার শুরুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে যেসব ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে, সেগুলো পুনর্নির্মাণে এতে সহায়তা হবে। ভারত আফগান শিক্ষার্থীদের জন্য ‘ই-ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশন্স’ স্কলারশিপ দেওয়াও জারি রাখবে। নতুন হেলথ কেয়ার সেন্টারের জন্য সহায়তা দেওয়ার কথাও বলেছেন জয়শঙ্কর। কাবুলে যে ইন্দিরা গান্ধী চিলড্রেন হাসপাতাল রয়েছে, সেটার উন্নয়নেরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। বৈঠকের পর মুত্তাকিকে তিনি ২০টি অ্যাম্বুলেন্স দিয়েছেন।
মুত্তাকি ভারতকে আফগানিস্তানের খনিজ খাতে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন। তালেবান সরকার অন্যান্য দেশকেও একই প্রস্তাব দিয়েছে। জলবিদ্যুৎ প্রকল্পেও সহযোগিতা চেয়েছেন তিনি। ইরানের চাবাহার বন্দরকে আরো ভালোভাবে কাজে লাগানোর বিষয়েও তারা আলোচনা করেছেন। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা থাকলেও এই ইস্যুটি গুরুত্বপূর্ণ। মুত্তাকি ভিসা ও বিনিয়োগ ইস্যু তুলেছিলেন। আত্তারি-ওয়াগাহ সীমান্ত ক্রসিং আবার খুলে দেওয়ার কথাও বলেছেন তিনি। মে মাসে ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যকার এই ক্রসিং বন্ধ করে দেওয়া হয়। আফগানিস্তান ও ভারত এয়ার করিডোর গড়ে তোলার বিষয়েও একমত হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে তারা ফ্লাইট বাড়ানোর বিষয়েও সম্মত হয়েছে।
তালেবান নেতা ভারতে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানও পরিদর্শন করেছেন। উত্তর প্রদেশের দারুল উলুম মাদরাসায় গিয়েছিলেন তিনি। সুন্নি মুসলিমদের জন্য এই প্রতিষ্ঠানটি গুরুত্বপূর্ণ। ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান চেম্বার্স অব কমার্সেস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন মুত্তাকি। কথা বলেছেন আফগান শরণার্থীদের সঙ্গেও। দুটো সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেন তিনি।
প্রথম সংবাদ সম্মেলনে নারী সাংবাদিকদের অনুমতি দেওয়া হয়নি। কিন্তু তিন দিন পরই দ্বিতীয় সংবাদ সম্মেলনে নারী সাংবাদিকরা দল বেঁধে এসেছিলেন। আফগানিস্তানে নারীদের অবস্থা নিয়ে তারা কঠিন কঠিন প্রশ্ন করেছেন। এতে মনে হয়েছে, তালেবানদের অধীনে নারী ইস্যুর বিষয়টি ভারতের কাছে এখনো উদ্বেগের বিষয়।
এখনই বোঝা যাবে না যে, ভারতের নীতিতে এই উদ্বেগ কতটা স্পর্শ করবে। ভারতকে অবশ্যই আরো সতর্ক হতে হবে। তালেবান সরকারের সঙ্গে তাদের লেনদেন করতে হবে। কিন্তু ভুল করেও তাদের স্বীকৃতি দেওয়া যাবে না।
নয়াদিল্লির উচ্চমাত্রার কূটনীতি অনেকেরই নজরে পড়েছে। মুত্তাকি জয়শঙ্করের সঙ্গে বৈঠক করছেন। একই সময় পাকিস্তান আফগান রাজধানীতে বিমান হামলা করেছে। জানা গেছে, তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানের (টিটিপি) নেতাদের টার্গেট করে ওই হামলা হয়েছিল বলে জানা গেছে। তালেবানরা এরপর পাকিস্তানি সীমান্ত পোস্টগুলো টার্গেট করে হামলা করে। কয়েক ডজন মানুষ সেখানে মারা গেছে। পরে রোববার দুই পক্ষই অস্ত্রবিরতিতে রাজি হয়েছে।
পাকিস্তান যে সময় হামলা চালাল, সেটি তাদের উদ্বেগের বহিঃপ্রকাশ। নয়াদিল্লি আর কাবুলের সম্পর্কের উন্নতি তাদের মধ্য অস্বস্তি সৃষ্টি করেছে। তালেবানরা যাতে টিটিপিকে সমর্থন দেওয়া বন্ধ করে, সেটি নিশ্চিত করতে পাকিস্তান সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে।
ভারত আফগানিস্তানের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষায় তাদের প্রতিশ্রুতির কথা বলেছে। এটিও ইসলামাবাদের অস্বস্তি বাড়াতে পারে। তালেবানের সঙ্গে নয়াদিল্লির যোগাযোগের মূলে রয়েছে একটি প্রতিশ্রুতি। সেটা হলো আফগানিস্তানের ভূখণ্ড ভারতের স্বার্থের বিরুদ্ধে ব্যবহার হবে না।
মুত্তাকিও এই প্রতিশ্রুতির পুনরাবৃত্তি করেছেন। আগেও কথাটা তিনি বলেছিলেন। কিন্তু এই প্রতিশ্রুতি রাখার ব্যাপারে তালেবানদের সক্ষমতা ও সদিচ্ছা নিয়ে সন্দেহ আছে। আফগানিস্তানে কোনো নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ বা বহিরাগত গোষ্ঠী আছে—এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছে তালেবান। যদিও এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে বলে অনেকে দাবি করে থাকে।
পাকিস্তান আর আফগানিস্তানের সম্পর্কের অবনতি স্বল্প মেয়াদে নয়াদিল্লিকে সাহায্য করেছে। কিন্তু তাদের গভীর সম্পর্কটা এভাবে চলে যাবে না। ভারত অপারেশন সিঁদুর শুরু করেছিল। উত্তেজনা বাড়ানোর বিষয়ে নিন্দা জানিয়েছিল তালেবান। দুই পক্ষকেই তারা শান্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল।
আফগানিস্তান আর পাকিস্তানও তাদের সম্পর্কের অগ্রগতি করেছে। মে মাসে রাষ্ট্রদূত বদল করেছে তারা। নিয়মিত তারা বৈঠক করছে। তারা নিজেরাও বৈঠক করছে। চীনকে সঙ্গে নিয়েও করছে। সহযোগিতা বাড়ানোরও চেষ্টা করছে তারা। এই মাসে দুই দেশের মধ্যে সঙ্ঘাত হয়েছে। তারপরও মুত্তাকি পাকিস্তানকে আলোচনার আহ্বান জানিয়েছেন। আফগানিস্তানের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক ধ্বংসের জন্য পাকিস্তানের একটি ছোট গোষ্ঠীকে তিনি দায়ী করেছেন শুধু।
এই সবকিছুর অর্থ হলো ভারতকে বাস্তববাদী হতে হবে। মুত্তাকির সফরের পর তালেবান সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে ভারতকে হিসাব কষে লক্ষ্য ঠিক করতে হবে।
তবে, যোগাযোগ রক্ষা করাটা কৌশলগত প্রয়োজনেই দরকার। তালেবান সরকারের ব্যাপারে কৌশল বদলেছে ভারত। অস্থির এই সময় আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা অর্জনকেই নয়াদিল্লি হয়তো অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
ফরেন পলিসি অবলম্বনে : জুলফিকার হায়দার

আমির খান মুত্তাকি ইসলামিক আমিরাত আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। গত ১০ অক্টোবর তিনি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠক হয়েছে নয়াদিল্লিতে। এই বৈঠক বুঝিয়ে দিয়েছে তালেবানদের সঙ্গে ভারতের লেনদেনের কৌশলটা কতটা নড়বড়ে।
ভারতের কর্মকর্তারা খুবই সতর্ক ছিলেন। মুত্তাকিকে তারা ‘আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তালেবান সরকারের নাম তারা একবারও নেননি। বৈঠকের কক্ষে অফিশিয়াল পতাকাও ছিল না। পুরোনো আফগান প্রজাতন্ত্রের পতাকা বা তালেবানদের সাদা ব্যানার—কোনোটাই সেখানে ছিল না।
আফগান দূতাবাসের পরিস্থিতি ছিল ভিন্নরকম। প্রজাতন্ত্রের পুরোনো তিনরঙের পতাকা উড়েছে বাইরে। কিন্তু মুত্তাকি আর তার টিম ভেতরে সাদা পতাকা ব্যবহার করেছে। তারা দাবি করেছেন, দূতাবাস তালেবানদের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। যেসব জনবল সেখানে কাজ করছে, তারাও তালেবানদের অধীনে কাজ করছেন বলে জানানো হয়েছে।
মুত্তাকির সফর শুরু হয় ৯ অক্টোবর। এক সপ্তাহ দীর্ঘ ছিল সফর। এই সফর ব্যাপক আগ্রহ ও নিবিড় পর্যবেক্ষণ উসকে দিয়েছে। তালেবানের একজন নেতাকে ভারত সরকারিভাবে আতিথেয়তা জানাচ্ছে—এটা খুবই বিরল। খুব কম মানুষই ভেবেছে এমনটা ঘটতে পারে। ২০২১ সালে আগস্টে এই সশস্ত্র গোষ্ঠী আবার ক্ষমতায় আসে।
কিন্তু ভারতকে এখন বাস্তববাদিতা আর বাস্তব রাজনীতির পথে হাঁটতে হচ্ছে। এর অর্থ হলো, বাস্তব চাহিদা আর জাতীয় স্বার্থে মনোযোগ দিতে হচ্ছে তাদের। ভারত ধারাবাহিকভাবে তালেবানদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ বাড়িয়েছে। এটা হয়েছে বিগত কয়েক বছর ধরে। তবে, এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে তালেবানদের স্বীকৃতি দেয়নি ভারত।
ভারতের যোগাযোগের সূত্রগুলো বেড়েছে। জানুয়ারিতে মুত্তাকি ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে দুবাইয়ে দেখা করেছিলেন। এপ্রিলে পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছিল। মুত্তাকি এপর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক যুগ্মসচিবের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। এই যুগ্মসচিব পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং ইরান সম্পর্কিত ইস্যুগুলো দেখাশোনা করেন। মুত্তাকি আর জয়শঙ্কর এমনকি মে মাসে ফোনে কথাও বলেছেন।
তালেবানদের সঙ্গে ভারতের বিনিময় এখন বেশ দ্রুত বাড়ছে। এর কারণ হলো নয়াদিল্লি অপারেশন সিঁদুর শুরু করেছিল। এই অভিযান ছিল পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের মোকাবিলার বৃহত্তর কৌশলের অংশ।
একই সঙ্গে, তালেবানরা ফিরে আসার পর থেকে আফগানিস্তান আর পাকিস্তানের সম্পর্কেরও অবনতি হয়েছে। ফলে তালেবানদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের সুযোগ বেড়ে গেছে ভারতের। ভারত সেখানে নিজেদের কৌশলগত স্বার্থ রক্ষা করতে চায়।
আঞ্চলিক কিছু বিষয়ও ভারতকে এই দিকে ঠেলে দিয়েছে। এ অঞ্চলের অন্য দেশগুলোও ধীরে ধীরে তালেবানদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াচ্ছে। তারা সম্পর্ক জোরদার করছে। রাশিয়া প্রথম দেশ হিসেবে জুন মাসে তালেবানদের স্বীকৃতি দিয়েছে। চীন ও মধ্য এশিয়ার আরো কিছু দেশ আফগানিস্তানের সঙ্গে রাষ্ট্রদূত বিনিময় করেছে।
তালেবান সরকারও ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়তে চায়। তারা কূটনৈতিক পরিসরে আরো বৈচিত্র্য নিয়ে আসতে চায়। এটা তাদের কৌশলের সঙ্গে মানানসই। নিজেদের তারা বাস্তববাদী খেলোয়াড় হিসেবে দেখাতে চাচ্ছে। অভিন্ন স্বার্থের ভিত্তিতে তারা অন্য দেশগুলোর সঙ্গে কাজ করতে চায়। সম্পর্ক যদি আনুষ্ঠানিকতা না-ও পায়, তবু তারা এই কাজ এগিয়ে নিতে চায়।
এই কৌশলের মূল কথা হলো—‘কারো শত্রু নয়, সবার বন্ধু’। এর উদ্দেশ্য হলো তালেবান সরকারের বৈধতা নিশ্চিত করা। তারা নিজেদের অ-আদর্শিক সরকার হিসেবে পরিচিত করাতে চাচ্ছে। তারা নিজেদের এমনভাবে তুলে ধরতে চাচ্ছে যে, যেখানে তাদের মনোযোগ হলো অর্থনীতি। ভারত সবশেষ দেশ হিসেবে এই ধারণা গ্রহণ করেছে।
১০ অক্টোবরের বৈঠকের পর দুই পক্ষই যৌথ বিবৃতি দিয়েছে। জয়শঙ্কর আফগানিস্তানের সঙ্গে ভারতের দীর্ঘদিনের সাংস্কৃতিক বন্ধনের কথা তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, আফগানিস্তানের উন্নয়নে সহায়তা দিতে ভারত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
পেহেলগাম হামলায় ‘জোরালো নিন্দা’ জানানোর কারণে তিনি তালেবানদের ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, তালেবানরা ভারতের নিরাপত্তা উদ্বেগ বুঝতে পারে। দুই পক্ষই এই অঞ্চলে শান্তি, স্থিতিশীলতা আর পারস্পরিক আস্থা প্রতিষ্ঠায় সম্মত হয়েছে। তারা বলেছেন, নিয়মিত যোগাযোগটা দুই পক্ষ জারি রাখবে।
এই বৈঠক ভারত-আফগানিস্তানের জন্য বাস্তব ফলও নিয়ে এসেছে। রাজনৈতিকভাবে ভারত কাবুলে তাদের দূতাবাসের কাজ পুরোপুরি চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ২০২২-এর জুন থেকে দূতাবাস মূলত টেকনিক্যাল মিশন হিসেবে পরিচালিত হচ্ছিল। ভারতও আনুষ্ঠানিকভাবে আফগানিস্তানের কূটনীতিকদের স্বীকৃতি দিয়েছে। কোনো পক্ষই অবশ্যই রাষ্ট্রদূত নিয়োগের কথা উল্লেখ করেনি।
ভারত মানবিক সহায়তা দেওয়ারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যেসব সরকারি অবকাঠামো ও উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ থমকে গিয়েছিল, সেগুলো আবার শুরুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে যেসব ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে, সেগুলো পুনর্নির্মাণে এতে সহায়তা হবে। ভারত আফগান শিক্ষার্থীদের জন্য ‘ই-ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশন্স’ স্কলারশিপ দেওয়াও জারি রাখবে। নতুন হেলথ কেয়ার সেন্টারের জন্য সহায়তা দেওয়ার কথাও বলেছেন জয়শঙ্কর। কাবুলে যে ইন্দিরা গান্ধী চিলড্রেন হাসপাতাল রয়েছে, সেটার উন্নয়নেরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। বৈঠকের পর মুত্তাকিকে তিনি ২০টি অ্যাম্বুলেন্স দিয়েছেন।
মুত্তাকি ভারতকে আফগানিস্তানের খনিজ খাতে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন। তালেবান সরকার অন্যান্য দেশকেও একই প্রস্তাব দিয়েছে। জলবিদ্যুৎ প্রকল্পেও সহযোগিতা চেয়েছেন তিনি। ইরানের চাবাহার বন্দরকে আরো ভালোভাবে কাজে লাগানোর বিষয়েও তারা আলোচনা করেছেন। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা থাকলেও এই ইস্যুটি গুরুত্বপূর্ণ। মুত্তাকি ভিসা ও বিনিয়োগ ইস্যু তুলেছিলেন। আত্তারি-ওয়াগাহ সীমান্ত ক্রসিং আবার খুলে দেওয়ার কথাও বলেছেন তিনি। মে মাসে ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যকার এই ক্রসিং বন্ধ করে দেওয়া হয়। আফগানিস্তান ও ভারত এয়ার করিডোর গড়ে তোলার বিষয়েও একমত হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে তারা ফ্লাইট বাড়ানোর বিষয়েও সম্মত হয়েছে।
তালেবান নেতা ভারতে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানও পরিদর্শন করেছেন। উত্তর প্রদেশের দারুল উলুম মাদরাসায় গিয়েছিলেন তিনি। সুন্নি মুসলিমদের জন্য এই প্রতিষ্ঠানটি গুরুত্বপূর্ণ। ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান চেম্বার্স অব কমার্সেস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন মুত্তাকি। কথা বলেছেন আফগান শরণার্থীদের সঙ্গেও। দুটো সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেন তিনি।
প্রথম সংবাদ সম্মেলনে নারী সাংবাদিকদের অনুমতি দেওয়া হয়নি। কিন্তু তিন দিন পরই দ্বিতীয় সংবাদ সম্মেলনে নারী সাংবাদিকরা দল বেঁধে এসেছিলেন। আফগানিস্তানে নারীদের অবস্থা নিয়ে তারা কঠিন কঠিন প্রশ্ন করেছেন। এতে মনে হয়েছে, তালেবানদের অধীনে নারী ইস্যুর বিষয়টি ভারতের কাছে এখনো উদ্বেগের বিষয়।
এখনই বোঝা যাবে না যে, ভারতের নীতিতে এই উদ্বেগ কতটা স্পর্শ করবে। ভারতকে অবশ্যই আরো সতর্ক হতে হবে। তালেবান সরকারের সঙ্গে তাদের লেনদেন করতে হবে। কিন্তু ভুল করেও তাদের স্বীকৃতি দেওয়া যাবে না।
নয়াদিল্লির উচ্চমাত্রার কূটনীতি অনেকেরই নজরে পড়েছে। মুত্তাকি জয়শঙ্করের সঙ্গে বৈঠক করছেন। একই সময় পাকিস্তান আফগান রাজধানীতে বিমান হামলা করেছে। জানা গেছে, তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানের (টিটিপি) নেতাদের টার্গেট করে ওই হামলা হয়েছিল বলে জানা গেছে। তালেবানরা এরপর পাকিস্তানি সীমান্ত পোস্টগুলো টার্গেট করে হামলা করে। কয়েক ডজন মানুষ সেখানে মারা গেছে। পরে রোববার দুই পক্ষই অস্ত্রবিরতিতে রাজি হয়েছে।
পাকিস্তান যে সময় হামলা চালাল, সেটি তাদের উদ্বেগের বহিঃপ্রকাশ। নয়াদিল্লি আর কাবুলের সম্পর্কের উন্নতি তাদের মধ্য অস্বস্তি সৃষ্টি করেছে। তালেবানরা যাতে টিটিপিকে সমর্থন দেওয়া বন্ধ করে, সেটি নিশ্চিত করতে পাকিস্তান সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে।
ভারত আফগানিস্তানের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষায় তাদের প্রতিশ্রুতির কথা বলেছে। এটিও ইসলামাবাদের অস্বস্তি বাড়াতে পারে। তালেবানের সঙ্গে নয়াদিল্লির যোগাযোগের মূলে রয়েছে একটি প্রতিশ্রুতি। সেটা হলো আফগানিস্তানের ভূখণ্ড ভারতের স্বার্থের বিরুদ্ধে ব্যবহার হবে না।
মুত্তাকিও এই প্রতিশ্রুতির পুনরাবৃত্তি করেছেন। আগেও কথাটা তিনি বলেছিলেন। কিন্তু এই প্রতিশ্রুতি রাখার ব্যাপারে তালেবানদের সক্ষমতা ও সদিচ্ছা নিয়ে সন্দেহ আছে। আফগানিস্তানে কোনো নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ বা বহিরাগত গোষ্ঠী আছে—এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছে তালেবান। যদিও এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে বলে অনেকে দাবি করে থাকে।
পাকিস্তান আর আফগানিস্তানের সম্পর্কের অবনতি স্বল্প মেয়াদে নয়াদিল্লিকে সাহায্য করেছে। কিন্তু তাদের গভীর সম্পর্কটা এভাবে চলে যাবে না। ভারত অপারেশন সিঁদুর শুরু করেছিল। উত্তেজনা বাড়ানোর বিষয়ে নিন্দা জানিয়েছিল তালেবান। দুই পক্ষকেই তারা শান্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল।
আফগানিস্তান আর পাকিস্তানও তাদের সম্পর্কের অগ্রগতি করেছে। মে মাসে রাষ্ট্রদূত বদল করেছে তারা। নিয়মিত তারা বৈঠক করছে। তারা নিজেরাও বৈঠক করছে। চীনকে সঙ্গে নিয়েও করছে। সহযোগিতা বাড়ানোরও চেষ্টা করছে তারা। এই মাসে দুই দেশের মধ্যে সঙ্ঘাত হয়েছে। তারপরও মুত্তাকি পাকিস্তানকে আলোচনার আহ্বান জানিয়েছেন। আফগানিস্তানের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক ধ্বংসের জন্য পাকিস্তানের একটি ছোট গোষ্ঠীকে তিনি দায়ী করেছেন শুধু।
এই সবকিছুর অর্থ হলো ভারতকে বাস্তববাদী হতে হবে। মুত্তাকির সফরের পর তালেবান সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে ভারতকে হিসাব কষে লক্ষ্য ঠিক করতে হবে।
তবে, যোগাযোগ রক্ষা করাটা কৌশলগত প্রয়োজনেই দরকার। তালেবান সরকারের ব্যাপারে কৌশল বদলেছে ভারত। অস্থির এই সময় আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা অর্জনকেই নয়াদিল্লি হয়তো অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
ফরেন পলিসি অবলম্বনে : জুলফিকার হায়দার

স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার তথাকথিত বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ তথা সেক্যুলারিজমের নামে সমাজকে বিভাজিত করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল। কোথাও স্বাধীন মতপ্রকাশের সুযোগ ছিল না। স্বৈরাচারের পক্ষের লোক হিসেবে পরিচিত না হলে চাকরি পাওয়া যেত
১০ ঘণ্টা আগে
২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশে যা ঘটেছে, তা নিছক একটি ছাত্র আন্দোলন ছিল না। ইতিহাসের ধারায় অনেক আন্দোলন আসে, কিছু ধূলিসাৎ হয়ে যায়, কিছু পারিপার্শ্বিক চাপে ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যায়। কিন্তু কিছু আন্দোলন থাকে, যেগুলো একটি জাতি, সমাজ এবং দেশকে বড়মাত্রায় নাড়া দিয়ে যায়। জুলাইয়ের ছাত্র আন্দোলন কিংবা জুলাই
১০ ঘণ্টা আগে
বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অভ্যুত্থান থেকে উৎসারিত একটি বৈপ্লবিক শক্তিই তাদের অধিকার দিয়েছে পুরোনো-অকেজো কিংবা বিতর্কিত, মনগড়া সংবিধানসহ সবকিছু ছুড়ে ফেলে দিয়ে একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার কাজে দৃপ্ত পদভারে এগিয়ে যেতে। সে কারণে দেশ ও জাতির চাহিদা অনুযায়ী অতি আবশ্যকীয় কিছু মৌলিক সংস্কার-সংবলিত ‘জুলাই ঘোষণা’ কিংবা
১০ ঘণ্টা আগে
লাতিন আমেরিকার ‘মাদক সন্ত্রাসীদের’ বিরুদ্ধে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের চলমান সামরিক অভিযান ক্যারিবীয় অঞ্চলকে একটি নতুন যুদ্ধক্ষেত্রে রূপান্তরিত করেছে। মাদকবিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে ওয়াশিংটন গত আগস্ট মাস থেকে এই অঞ্চলজুড়ে যুদ্ধজাহাজ, পারমাণবিক সাবমেরিন, যুদ্ধবিমান এবং হাজার হাজার সেনা
১ দিন আগে