
সুমাইয়া ঘানুশি

যুক্তরাষ্ট্রে ন্যায়বিচারের সংগ্রাম কখনোই সত্যিকার অর্থে নিঃশেষ হয়ে যায় না, এর মৃত্যু ঘটে না। এই লড়াইকে চাপা দেওয়া যেতে পারে, একপাশে সরিয়ে দেওয়া যেতে পারে; কিন্তু তারপরও সবসময়ই এই লড়াই ফিরে আসার পথ খুঁজে নেয় নতুন রূপে নতুন মুখ ও নতুন কণ্ঠস্বর হয়ে। মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ মুসলিমদের মানবাধিকার আদায়ের আন্দোলনের নেতা ম্যালকম এক্স যে আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন, তার মশাল আজ দেশটির নতুন প্রজন্মের নেতা নিউ ইয়র্কের উদীয়মান মুসলিম রাজনীতিবিদ জোহরান মামদানির হাতে এসে উঠেছে।
ম্যালকম এক্স বিংশ শতাব্দীর এক বহুল আলোচিত নাম। জন্মের পর তার নাম রাখা হয় ম্যালকম লিট্ল এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর তার নতুন নামকরণ হয় ম্যালকম এক্স। তিনি আলহাজ মালিক আল-শাব্বাজ নামেও পরিচিত। তিনি নেশন অব ইসলাম নামে একটি সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত হয়েছিলেন। পরে তিনি এই সংগঠন ত্যাগ করেন।
তিনি ছিলেন একজন আফ্রিকান-মার্কিন মুসলিম রাজনীতিবিদ ও ধর্মীয় নেতা, যিনি যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গদের মানবাধিকার আদায়ের আন্দোলনে অন্যতম নেতা ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে অবহেলিত, নিপীড়িত ও নির্যাতিত নিগ্রো কৃষ্ণাঙ্গদের গোলামির জিঞ্জির বা দাসপ্রথা থেকে মুক্ত করতে তিনি লড়াই শুরু করেছিলেন। তিনি এই অবহেলিত জনগোষ্ঠীকে মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। এর জন্য তিনি যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে তুলেছিলেন ব্যাপক এক গণআন্দোলন। তিনি দেশটিতে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৬৫ সালে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
কিন্তু তাতে তার এই লড়াই থেমে যায়নি। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে যুক্তরাষ্ট্রের নিপীড়িত মুসলিম জনগোষ্ঠীর পক্ষে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জন এই লড়াইকে এগিয়ে নিয়েছেন। বর্তমানে এই লড়াইয়ের হাল ধরেছেন আরেক ডেমোক্রেটিক পার্টির উঠতি মুসলিম নেতা জোহরান মামদানি, যিনি ম্যালকম এক্সের একজন যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবেই নিজেকে তৈরি করেছেন। মামদানি উগান্ডার বিখ্যাত শিক্ষাবিদ মাহমুদ মামদানি ও ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা মীরা নায়ারের ছেলে। তার জন্ম উগান্ডার রাজধানী কাম্পালায়। তবে সাত বছর বয়সে তিনি নিউ ইয়র্কে চলে আসেন।
৩৩ বছর বয়সি মামদানি বর্তমানে নিউ ইয়র্ক স্টেট অ্যাসেম্বলিতে অ্যাসেম্বলি ডিস্ট্রিক্ট ৩৬-এর তিন মেয়াদের প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি নিউ ইয়র্ক সিটির মেয়র পদে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী হিসেবে গতকাল অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন। গাজা যুদ্ধ ইস্যু মামদানির নির্বাচনি প্রচারের কেন্দ্রে ছিল। ম্যালকম এক্সকে হত্যা করার ছয় দশক পর মামদানি সাম্য, ন্যায়বিচার এবং মুক্তির প্রতি তার তীব্র ও অকপট বিশ্বাসের প্রতিনিধিত্ব করছেন।
ম্যালকম এক্স ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ এবং বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে দক্ষিণ আমেরিকায় প্রণীত জাতিগত বিভেদ আইনের প্রচলিত ব্যবস্থা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। তার কাছে এই আইন অপরিবর্তনীয় বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু হজ করতে মক্কায় আসার পর যা দেখেছিলেন, তা তার সব দ্বিধা ভেঙে দেয়। তিনি নতুন চিন্তা-চেতনায় অনুপ্রাণিত হন। তিনি দেখেছিলেন হজে আসা প্রতিটি বর্ণ ও ভাষার মানুষ একসঙ্গে মিলেমিশে চলাফেরা করছেন, খাচ্ছেন এবং ইবাদত-বন্দেগি করছেন।
এ সম্পর্কে ম্যালকম এক্স বলেছিলেন, ‘আমি কখনো এত আন্তরিক আতিথেয়তা এবং সত্যিকারের ভ্রাতৃত্বের অপ্রতিরোধ্য চেতনা দেখিনি। আমরা সবাই একই আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করছিলাম এবং ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের এমন চেতনা প্রদর্শন করছিলাম, যা আমেরিকায় কল্পনারও বাইরে ছিল। এটা আমাকে বিশ্বাস করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল যে, যুক্তরাষ্ট্রেও শ্বেতাঙ্গ ও অ-শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকতে পারে না।’
হজ কেবল ম্যালকম এক্সের রাজনীতিকেই নতুন রূপ দেয়নি, এটি তার আত্মাকেও রূপান্তরিত করেছে। তিনি মক্কা থেকে নতুন এক চেতনা নিয়ে, সর্বজনীন মানবিক মর্যাদার এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি বহন করে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসেন। তার এই চেতনার মূলকথা ছিল—‘কেবল কৃষ্ণাঙ্গদের মুক্তি নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রকে ইসলাম ধর্ম বুঝতে হবে, কারণ এটিই একমাত্র ধর্ম, যা তার সমাজ থেকে জাতিগত সমস্যা মুছে ফেলে।’
ম্যালকম এক্স বর্ণবাদকে কেবল যুক্তরাষ্ট্রের একটি অভ্যন্তরীণ পাপ হিসেবে নয়, বরং বৈশ্বিক একটি কাঠামো হিসেবে দেখতে পেয়েছিলেন। বর্ণবাদ একটি ঔপনিবেশিক নেটওয়ার্ক, যা আফ্রিকান আমেরিকানদের সংগ্রামকে আলজেরিয়ান, ঘানা, ভিয়েতনামি ও ফিলিস্তিনিদের সংগ্রামের সঙ্গে সংযুক্ত করে। তিনি তার ‘জায়োনিস্ট লজিক’ প্রবন্ধে তিনি জায়োনিজম বা ইহুদিবাদকে ‘ঔপনিবেশিকতার একটি নতুন রূপ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যেটি দখলদারত্বকে মানবিক ভাষায় রূপ দিয়ে ঢেকে রাখার একটি প্রকল্প। তিনি এমন একটি বাস্তবতার নাম দিয়েছেন, যা আমেরিকার নেতারা স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, নিপীড়ন স্থানীয় নয়, এটি বিশ্বব্যাপী কাঠামোগত একটি ব্যবস্থা।
ছয় দশক পর তরুণ মুসলিম রাজনীতিবিদ জোহরান মামদানি নিউ ইয়র্কের একটি মসজিদে দাঁড়িয়ে ম্যালকম এক্সের এই কথাগুলো বলছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি কে তা পরিবর্তন করব না, আমি কীভাবে খাই তা পরিবর্তন করব না। আমি যে বিশ্বাসের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরে গর্বিত তা পরিবর্তন করব না। তবে একটি জিনিস আমি পরিবর্তন করব, আর তা হচ্ছে—আমি আর নিজেকে ছায়ায় ঢেকে রাখব না, ছায়ার মধ্যে নিজেকে খুঁজব না।’
মামদানি প্রথম যখন রাজনীতিতে আসেন, তখন তার বিশ্বাসকে চুপ করে রাখতে বলা হয়েছিল তাকে। সে সময় তাকে এই কথাটাই বলা হয়েছিল যে, আমেরিকার জনজীবনের জন্য যেটা ‘অতিরিক্ত মুসলিম’ হিসেবে গণ্য হতে পারে, তা প্রকাশ্যে আনা যাবে না, চেপে রাখতে হবে। এটি এমন একটি শিক্ষা, যা পশ্চিমা বিশ্বের অনেক মুসলিমই মনে রেখেছেন—কম চাও, কম আশা করো। তোমাকে অবহেলার জন্য কৃতজ্ঞ থাকো। কিন্তু মামদানি নিজের মুসলিম পরিচয় অদৃশ্য রাখার এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তিনি তার ধর্মীয় বিশ্বাসকে দায় হিসেবে নয়, বরং শক্তির উৎস হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
সোশ্যাল মিডিয়ায় সম্প্রতি পোস্ট করা এক ভিডিওতে মামদানি বলেছেন, ‘প্রত্যেক মুসলিমের স্বপ্ন হলো নিউ ইয়র্কের অন্য যেকোনো নাগরিকের মতোই আচরণ করা। কিন্তু আমাদের অনেক দিন ধরে বলা হয়েছে—কম চাও এবং যা পাও তাতেই সন্তুষ্ট থাকো।’
মামদানি দীর্ঘদিন ফিলিস্তিনিদের অধিকার আদায়ের পক্ষে কাজ করেছেন। তিনি তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই ইসরাইলবিরোধী আন্দোলন ‘বয়কট, বিতাড়ন ও নিষেধাজ্ঞা’র প্রচারণাকে জোরালো সমর্থন করে আসছেন। তার এই অবস্থানটি তার রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে এখনো রয়ে গেছে।
তিনি গাজায় ইসরাইলি গণহত্যা ও বর্বরতায় যুক্তরাষ্ট্রের জড়িত থাকার অভিযোগ তুলে প্রকাশ্যে নিন্দা করেছেন। তিনি ঘোষণা করেছেন, যদি তিনি মেয়র নির্বাচিত হন তাহলে নিউ ইয়র্ক সিটিতে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু পা রাখলে তার গ্রেপ্তার চাইবেন। তার এই প্রতীকী অবস্থান তার সমর্থকদের উত্তেজিত এবং বিরোধীদের ক্ষুব্ধ করে এবং যুক্তরাষ্ট্রের ইহুদি লবিতে তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়।
করপোরেট ও রিয়েল এস্টেট কোম্পানিগুলো তাকে নির্বাচনি প্রতিযোগিতা থেকে সরিয়ে দিতে ২২ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি ব্যয় করেছে। কিন্তু এতে শেষ পর্যন্ত কাজ হয়নি। নির্বাচন থেকে তাকে সরানো সম্ভব হয়নি তার জনপ্রিয়তার কারণে। এজন্য মামদানি এক ভিন্ন ধরনের আক্রমণের মুখোমুখি হন—চরিত্রহনন। তাকে একজন চরমপন্থি হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য অবিরাম অপপ্রচার চালানো হয়েছে।
ম্যালকম এক্স এবং মামদানি উভয়ের কাছেই আফ্রিকা কেবল পূর্বপুরুষ নয়, এটি একটি বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি। ম্যালকম এক্সের প্যান-আফ্রিকানিজম তার আন্তর্জাতিকতাবাদকে রূপ দিয়েছে। ঘানা, মিসর ও নাইজেরিয়ায় তার ভ্রমণ বিশ্বব্যাপী উপনিবেশবাদ সম্পর্কে তার ধারণাকে আরো স্পষ্ট ও গভীর করে তুলেছিল। মামদানি তার বাবা মাহমুদ মামদানির কাছ থেকেও একই রকম দৃষ্টিভঙ্গি উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন।
ম্যালকম এক্স এমন রাজনীতির মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন, যা আমেরিকার করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে অসহনীয় হয়ে উঠেছিল।
১৯৬৫ সালে তার ওপর সংঘটিত হত্যাকাণ্ড কেবল একজন মানুষকে চুপ করিয়ে দেওয়া ছিল না—এটি ছিল শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য, সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদী আধিপত্যকে তাদের মূলে চ্যালেঞ্জ করে এমন একটি আন্দোলনকে চিরতরে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তা থামানো যায়নি। যুগে যুগে বিভিন্ন জনের হাত ধরে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের সেই আলোকবর্তিকা আজ মামদানির হাতে এসে পৌঁছেছে। মামদানির সম্ভাব্য বিজয় সেই ন্যায় প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের আলোকবর্তিকাকে বিজয়ের আরো কাছে নিয়ে যাবে, সেদিকেই তাকিয়ে আছে আমেরিকার মুসলিমরা।
মিডল ইস্ট আই থেকে ভাষান্তর : মোতালেব জামালী

যুক্তরাষ্ট্রে ন্যায়বিচারের সংগ্রাম কখনোই সত্যিকার অর্থে নিঃশেষ হয়ে যায় না, এর মৃত্যু ঘটে না। এই লড়াইকে চাপা দেওয়া যেতে পারে, একপাশে সরিয়ে দেওয়া যেতে পারে; কিন্তু তারপরও সবসময়ই এই লড়াই ফিরে আসার পথ খুঁজে নেয় নতুন রূপে নতুন মুখ ও নতুন কণ্ঠস্বর হয়ে। মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ মুসলিমদের মানবাধিকার আদায়ের আন্দোলনের নেতা ম্যালকম এক্স যে আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন, তার মশাল আজ দেশটির নতুন প্রজন্মের নেতা নিউ ইয়র্কের উদীয়মান মুসলিম রাজনীতিবিদ জোহরান মামদানির হাতে এসে উঠেছে।
ম্যালকম এক্স বিংশ শতাব্দীর এক বহুল আলোচিত নাম। জন্মের পর তার নাম রাখা হয় ম্যালকম লিট্ল এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর তার নতুন নামকরণ হয় ম্যালকম এক্স। তিনি আলহাজ মালিক আল-শাব্বাজ নামেও পরিচিত। তিনি নেশন অব ইসলাম নামে একটি সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত হয়েছিলেন। পরে তিনি এই সংগঠন ত্যাগ করেন।
তিনি ছিলেন একজন আফ্রিকান-মার্কিন মুসলিম রাজনীতিবিদ ও ধর্মীয় নেতা, যিনি যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গদের মানবাধিকার আদায়ের আন্দোলনে অন্যতম নেতা ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে অবহেলিত, নিপীড়িত ও নির্যাতিত নিগ্রো কৃষ্ণাঙ্গদের গোলামির জিঞ্জির বা দাসপ্রথা থেকে মুক্ত করতে তিনি লড়াই শুরু করেছিলেন। তিনি এই অবহেলিত জনগোষ্ঠীকে মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। এর জন্য তিনি যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে তুলেছিলেন ব্যাপক এক গণআন্দোলন। তিনি দেশটিতে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৬৫ সালে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
কিন্তু তাতে তার এই লড়াই থেমে যায়নি। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে যুক্তরাষ্ট্রের নিপীড়িত মুসলিম জনগোষ্ঠীর পক্ষে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জন এই লড়াইকে এগিয়ে নিয়েছেন। বর্তমানে এই লড়াইয়ের হাল ধরেছেন আরেক ডেমোক্রেটিক পার্টির উঠতি মুসলিম নেতা জোহরান মামদানি, যিনি ম্যালকম এক্সের একজন যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবেই নিজেকে তৈরি করেছেন। মামদানি উগান্ডার বিখ্যাত শিক্ষাবিদ মাহমুদ মামদানি ও ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা মীরা নায়ারের ছেলে। তার জন্ম উগান্ডার রাজধানী কাম্পালায়। তবে সাত বছর বয়সে তিনি নিউ ইয়র্কে চলে আসেন।
৩৩ বছর বয়সি মামদানি বর্তমানে নিউ ইয়র্ক স্টেট অ্যাসেম্বলিতে অ্যাসেম্বলি ডিস্ট্রিক্ট ৩৬-এর তিন মেয়াদের প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি নিউ ইয়র্ক সিটির মেয়র পদে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী হিসেবে গতকাল অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন। গাজা যুদ্ধ ইস্যু মামদানির নির্বাচনি প্রচারের কেন্দ্রে ছিল। ম্যালকম এক্সকে হত্যা করার ছয় দশক পর মামদানি সাম্য, ন্যায়বিচার এবং মুক্তির প্রতি তার তীব্র ও অকপট বিশ্বাসের প্রতিনিধিত্ব করছেন।
ম্যালকম এক্স ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ এবং বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে দক্ষিণ আমেরিকায় প্রণীত জাতিগত বিভেদ আইনের প্রচলিত ব্যবস্থা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। তার কাছে এই আইন অপরিবর্তনীয় বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু হজ করতে মক্কায় আসার পর যা দেখেছিলেন, তা তার সব দ্বিধা ভেঙে দেয়। তিনি নতুন চিন্তা-চেতনায় অনুপ্রাণিত হন। তিনি দেখেছিলেন হজে আসা প্রতিটি বর্ণ ও ভাষার মানুষ একসঙ্গে মিলেমিশে চলাফেরা করছেন, খাচ্ছেন এবং ইবাদত-বন্দেগি করছেন।
এ সম্পর্কে ম্যালকম এক্স বলেছিলেন, ‘আমি কখনো এত আন্তরিক আতিথেয়তা এবং সত্যিকারের ভ্রাতৃত্বের অপ্রতিরোধ্য চেতনা দেখিনি। আমরা সবাই একই আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করছিলাম এবং ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের এমন চেতনা প্রদর্শন করছিলাম, যা আমেরিকায় কল্পনারও বাইরে ছিল। এটা আমাকে বিশ্বাস করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল যে, যুক্তরাষ্ট্রেও শ্বেতাঙ্গ ও অ-শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকতে পারে না।’
হজ কেবল ম্যালকম এক্সের রাজনীতিকেই নতুন রূপ দেয়নি, এটি তার আত্মাকেও রূপান্তরিত করেছে। তিনি মক্কা থেকে নতুন এক চেতনা নিয়ে, সর্বজনীন মানবিক মর্যাদার এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি বহন করে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসেন। তার এই চেতনার মূলকথা ছিল—‘কেবল কৃষ্ণাঙ্গদের মুক্তি নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রকে ইসলাম ধর্ম বুঝতে হবে, কারণ এটিই একমাত্র ধর্ম, যা তার সমাজ থেকে জাতিগত সমস্যা মুছে ফেলে।’
ম্যালকম এক্স বর্ণবাদকে কেবল যুক্তরাষ্ট্রের একটি অভ্যন্তরীণ পাপ হিসেবে নয়, বরং বৈশ্বিক একটি কাঠামো হিসেবে দেখতে পেয়েছিলেন। বর্ণবাদ একটি ঔপনিবেশিক নেটওয়ার্ক, যা আফ্রিকান আমেরিকানদের সংগ্রামকে আলজেরিয়ান, ঘানা, ভিয়েতনামি ও ফিলিস্তিনিদের সংগ্রামের সঙ্গে সংযুক্ত করে। তিনি তার ‘জায়োনিস্ট লজিক’ প্রবন্ধে তিনি জায়োনিজম বা ইহুদিবাদকে ‘ঔপনিবেশিকতার একটি নতুন রূপ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যেটি দখলদারত্বকে মানবিক ভাষায় রূপ দিয়ে ঢেকে রাখার একটি প্রকল্প। তিনি এমন একটি বাস্তবতার নাম দিয়েছেন, যা আমেরিকার নেতারা স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, নিপীড়ন স্থানীয় নয়, এটি বিশ্বব্যাপী কাঠামোগত একটি ব্যবস্থা।
ছয় দশক পর তরুণ মুসলিম রাজনীতিবিদ জোহরান মামদানি নিউ ইয়র্কের একটি মসজিদে দাঁড়িয়ে ম্যালকম এক্সের এই কথাগুলো বলছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি কে তা পরিবর্তন করব না, আমি কীভাবে খাই তা পরিবর্তন করব না। আমি যে বিশ্বাসের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরে গর্বিত তা পরিবর্তন করব না। তবে একটি জিনিস আমি পরিবর্তন করব, আর তা হচ্ছে—আমি আর নিজেকে ছায়ায় ঢেকে রাখব না, ছায়ার মধ্যে নিজেকে খুঁজব না।’
মামদানি প্রথম যখন রাজনীতিতে আসেন, তখন তার বিশ্বাসকে চুপ করে রাখতে বলা হয়েছিল তাকে। সে সময় তাকে এই কথাটাই বলা হয়েছিল যে, আমেরিকার জনজীবনের জন্য যেটা ‘অতিরিক্ত মুসলিম’ হিসেবে গণ্য হতে পারে, তা প্রকাশ্যে আনা যাবে না, চেপে রাখতে হবে। এটি এমন একটি শিক্ষা, যা পশ্চিমা বিশ্বের অনেক মুসলিমই মনে রেখেছেন—কম চাও, কম আশা করো। তোমাকে অবহেলার জন্য কৃতজ্ঞ থাকো। কিন্তু মামদানি নিজের মুসলিম পরিচয় অদৃশ্য রাখার এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তিনি তার ধর্মীয় বিশ্বাসকে দায় হিসেবে নয়, বরং শক্তির উৎস হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
সোশ্যাল মিডিয়ায় সম্প্রতি পোস্ট করা এক ভিডিওতে মামদানি বলেছেন, ‘প্রত্যেক মুসলিমের স্বপ্ন হলো নিউ ইয়র্কের অন্য যেকোনো নাগরিকের মতোই আচরণ করা। কিন্তু আমাদের অনেক দিন ধরে বলা হয়েছে—কম চাও এবং যা পাও তাতেই সন্তুষ্ট থাকো।’
মামদানি দীর্ঘদিন ফিলিস্তিনিদের অধিকার আদায়ের পক্ষে কাজ করেছেন। তিনি তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই ইসরাইলবিরোধী আন্দোলন ‘বয়কট, বিতাড়ন ও নিষেধাজ্ঞা’র প্রচারণাকে জোরালো সমর্থন করে আসছেন। তার এই অবস্থানটি তার রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে এখনো রয়ে গেছে।
তিনি গাজায় ইসরাইলি গণহত্যা ও বর্বরতায় যুক্তরাষ্ট্রের জড়িত থাকার অভিযোগ তুলে প্রকাশ্যে নিন্দা করেছেন। তিনি ঘোষণা করেছেন, যদি তিনি মেয়র নির্বাচিত হন তাহলে নিউ ইয়র্ক সিটিতে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু পা রাখলে তার গ্রেপ্তার চাইবেন। তার এই প্রতীকী অবস্থান তার সমর্থকদের উত্তেজিত এবং বিরোধীদের ক্ষুব্ধ করে এবং যুক্তরাষ্ট্রের ইহুদি লবিতে তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়।
করপোরেট ও রিয়েল এস্টেট কোম্পানিগুলো তাকে নির্বাচনি প্রতিযোগিতা থেকে সরিয়ে দিতে ২২ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি ব্যয় করেছে। কিন্তু এতে শেষ পর্যন্ত কাজ হয়নি। নির্বাচন থেকে তাকে সরানো সম্ভব হয়নি তার জনপ্রিয়তার কারণে। এজন্য মামদানি এক ভিন্ন ধরনের আক্রমণের মুখোমুখি হন—চরিত্রহনন। তাকে একজন চরমপন্থি হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য অবিরাম অপপ্রচার চালানো হয়েছে।
ম্যালকম এক্স এবং মামদানি উভয়ের কাছেই আফ্রিকা কেবল পূর্বপুরুষ নয়, এটি একটি বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি। ম্যালকম এক্সের প্যান-আফ্রিকানিজম তার আন্তর্জাতিকতাবাদকে রূপ দিয়েছে। ঘানা, মিসর ও নাইজেরিয়ায় তার ভ্রমণ বিশ্বব্যাপী উপনিবেশবাদ সম্পর্কে তার ধারণাকে আরো স্পষ্ট ও গভীর করে তুলেছিল। মামদানি তার বাবা মাহমুদ মামদানির কাছ থেকেও একই রকম দৃষ্টিভঙ্গি উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন।
ম্যালকম এক্স এমন রাজনীতির মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন, যা আমেরিকার করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে অসহনীয় হয়ে উঠেছিল।
১৯৬৫ সালে তার ওপর সংঘটিত হত্যাকাণ্ড কেবল একজন মানুষকে চুপ করিয়ে দেওয়া ছিল না—এটি ছিল শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য, সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদী আধিপত্যকে তাদের মূলে চ্যালেঞ্জ করে এমন একটি আন্দোলনকে চিরতরে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তা থামানো যায়নি। যুগে যুগে বিভিন্ন জনের হাত ধরে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের সেই আলোকবর্তিকা আজ মামদানির হাতে এসে পৌঁছেছে। মামদানির সম্ভাব্য বিজয় সেই ন্যায় প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের আলোকবর্তিকাকে বিজয়ের আরো কাছে নিয়ে যাবে, সেদিকেই তাকিয়ে আছে আমেরিকার মুসলিমরা।
মিডল ইস্ট আই থেকে ভাষান্তর : মোতালেব জামালী

জিয়া হত্যা ষড়যন্ত্রের সঙ্গে তার সামরিক একান্ত সচিব লে. কর্নেল মাহফুজের সম্পৃক্ততা ছিল। ৩০ মে ১৯৮১ সালে সার্কিট হাউসে গিয়ে তার আচরণ দেখে আমার সন্দেহ হয়েছে। মাহফুজ যে এ হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ত ছিলেন, তা সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস তার ‘অ্যা লিগেসি অব ব্লাড’ বইয়েও লিখেছেন। জিয়ার সামরিক একান্ত সচিব কর্ন
৩ ঘণ্টা আগে
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী ঘোষণার মধ্য দিয়ে ভোটের ট্রেন চলতে শুরু করল। বাধাহীন নির্বাচনি কার্যক্রম শেষ হতে আরো কিছু পথ অতিক্রম করতে হবে। বিএনপি মনোনীত পদপ্রার্থীদের যে নাম প্রকাশ করেছে, তা বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, যথেষ্ট খোঁজখবর নিয়ে, জরিপের ভিত্তিতে প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।
৪ ঘণ্টা আগে
জিয়াউদ্দিন এম চৌধুরী ১৯৮১ সালের ৩০ মে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের সময় চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক (ডিসি) ছিলেন। সিভিল সার্ভিসের এই সাবেক কর্মকর্তা ১৯৬৮ সালে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। স্বাধীনতার পর প্রধানমন্ত্রী সচিবালয়ে বিশেষ সহকারী এবং পরে শিল্পমন্ত্রী এএইচএম কামারুজ্জামানের একান্ত সচিব ছিলে
১ দিন আগে
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর আমি বুয়েটের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলাম। তখন শেরে বাংলা হলের উত্তর ব্লকের ৩১০ নম্বর ঘরে আমার তিন বছরের আবাস। মনে পড়ছে ৬ নভেম্বর রাতে আমাদের ঘুমানো সম্ভব হয়নি। মধ্যরাত থেকেই ঢাকা সেনানিবাসের দিক থেকে প্রচণ্ড গোলাগুলির আওয়াজ পাচ্ছিলাম।
১ দিন আগে