কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও চাকরির ভবিষ্যৎ

জসীম উদ্দীন মুহম্মদ
প্রকাশ : ১৪ জুন ২০২৫, ১৩: ২৯

একবিংশ শতাব্দীর দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স একটি যুগান্তকারী প্রযুক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এটি কেবল আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকেই প্রভাবিত করছে না, বরং কর্মসংস্থানের ভবিষ্যৎ নিয়েও নতুন করে ভাবার অবকাশ তৈরি করেছে।

দশকের পর দশক ধরে প্রযুক্তির বিবর্তন আমাদের কাজের ধরন, জীবনধারা ও অর্থনৈতিক কাঠামোকে আমূল পাল্টে দিয়েছে। কৃষিবিপ্লব থেকে শুরু করে শিল্পবিপ্লব, ডিজিটাল বিপ্লব—প্রতিটি পর্যায়ে মানুষকে তার পুরোনো অভ্যাস ছাড়তে হয়েছে, শিখতে হয়েছে নতুন কিছু। তবে বিগত কয়েক বছর ধরে পরিবর্তনের যে ঢেউ বইছে, তার নাম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, যা ছাপিয়ে যাচ্ছে আগের সব ঢেউকে।

এখন প্রশ্ন হলো প্রযুক্তির এই উত্থান কি আমাদের জন্য সম্ভাবনা, নাকি অদৃশ্য হুমকি? বাস্তবতা হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখন শুধু বিজ্ঞানের কল্পকাহিনির বিষয় নয়, বরং দুনিয়ার এক অনিবার্য বাস্তবতা। সে এখন মানুষের ভাষা বুঝতে পারে, সিদ্ধান্ত নিতে পারে, এমনকি সৃজনশীল কাজেও অংশ নিচ্ছে। এসব এখন আর শুধু প্রযুক্তিপ্রেমীদের জানার বিষয় নয়; বরং চাকরিজীবী থেকে শুরু করে শিক্ষক, লেখক, চিকিৎসক, ব্যবসায়ী সবার কর্মজীবনের সঙ্গেই এর সম্পর্ক অনিবার্য হয়ে উঠছে।

বিশ্বখ্যাত গবেষণা সংস্থা ম্যাকিনসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী প্রায় ৮০ কোটি চাকরি অটোমেশনের দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। অন্যদিকে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) ‘ফিউচার জবস’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, এআইয়ের স্বয়ংক্রিয়তায় একদিকে চাকরি হারাতে পারে ৮ কোটি ৫০ লাখ মানুষ; অপরদিকে সৃষ্টি করবে প্রায় ৯৭ মিলিয়ন নতুন ধরনের কাজ। অর্থাৎ, এই পরিবর্তন একদিকে যেমন হুমকি, তেমনি অন্যদিকে সম্ভাবনার দরজাও খুলে দিচ্ছে।

এখন প্রশ্ন হলো, এআইয়ের উত্থান একদিকে যেমন নতুন সুযোগের দ্বার খুলে দিচ্ছে, তেমনই অন্যদিকে কিছু প্রচলিত চাকরির বিলুপ্তির আশঙ্কাও তৈরি করছে। বাংলাদেশে অটোমেশন এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলেও এর ছোঁয়া লাগছে গার্মেন্ট, ব্যাংক, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে। গার্মেন্টে রোবটিক প্রযুক্তির ব্যবহার, ব্যাংকে চ্যাটবট, আর অনলাইন শিক্ষা প্ল্যাটফরমের জনপ্রিয়তা এর প্রমাণ। কিন্তু এই পরিবর্তনের জন্য আমরা কি সত্যিই প্রস্তুত?

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এমন প্রযুক্তি, যা যন্ত্রকে মানুষের মতো বুদ্ধিদীপ্ত আচরণ করতে, শিখতে, সমস্যা সমাধান করতে এবং সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম করে তোলে। এর মধ্যে আছে মেশিন লার্নিং, ডিপ লার্নিং, ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং, রোবোটিক্স প্রভৃতি। এ কারণে স্বাভাবিকভাবেই চাকরির বাজারে এআইয়ের বহুমাত্রিক প্রভাব পড়বে। স্বয়ংক্রিয়করণ বা অটোমেশন পদ্ধতিতে এআই ও রোবোটিক্সের মাধ্যমে অনেক পুনরাবৃত্তিমূলক ও শ্রমঘন কাজ স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হচ্ছে। উৎপাদন খাত, গ্রাহক পরিষেবা, ডেটা এন্ট্রি, হিসাবরক্ষণ, এমনকি কিছু আইনি ও চিকিৎসাসেবার ক্ষেত্রেও অটোমেশন বাড়ছে। এর ফলে এসব খাতে মানুষের কাজের প্রয়োজনীয়তা কমতে পারে, অথবা ইতোমধ্যে কিছু ক্ষেত্রে কমে গেছে।

তাই এআইয়ের যুগে টিকে থাকতে হলে আমাদের উন্নত করতে হবে সেসব দক্ষতা, যেগুলো এখনো কেবল মানুষের মধ্যেই বিদ্যমান। যেমন সমালোচনামূলক চিন্তা ও সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা, ডেটা বিশ্লেষণ ও প্রযুক্তিগত সাক্ষরতা, সৃজনশীলতা ও আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা বা ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স, এআই ব্যবস্থাপনা, নৈতিকতা ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার ক্ষমতা ইত্যাদি। MIT ও Harvard-এর যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, যারা এআই’কে প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং সহযোগী হিসেবে ব্যবহার করছেন, তারা কর্মদক্ষতা ও উৎপাদনশীলতায় ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত উন্নতি করেছেন।

দক্ষতার পরিবর্তনের ফলে এআই কিছু চাকরিকে বিলুপ্ত করলেও নতুন কিছু চাকরির সুযোগ তৈরি করছে। তবে এসব নতুন চাকরির জন্য ভিন্ন ধরনের দক্ষতা প্রয়োজন হবে। ডেটা সায়েন্টিস্ট, এআই ইঞ্জিনিয়ার, মেশিন লার্নিং স্পেশালিস্ট, রোবোটিক্স টেকনিশিয়ান, এথিক্যাল এআই কনসালটেন্ট—এমন সব নতুন ভূমিকার চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু এ বিষয়ে আমাদের এখনো যথার্থ প্রস্তুতি নেই।

উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এআই মানুষের কাজকে আরো সহজ ও দ্রুততর করতে সাহায্য করে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে পারে। যেমন চিকিৎসক এআই ব্যবহার করে রোগ নির্ণয়কে আরো নির্ভুল করতে পারেন, প্রকৌশলী নকশার কাজ দ্রুত সম্পন্ন করতে পারেন। এতে কর্মীদের দক্ষতা বাড়বে এবং তারা আরো জটিল ও সৃজনশীল কাজে মনোযোগ দিতে পারবেন।

গিগ ইকোনমি বা ফ্রিল্যান্সিং এবং দূরবর্তী কাজে এআইয়ের কারণে কাজের ধরন আরো নমনীয় হতে পারে। ফ্রিল্যান্সিংয়ের সুযোগ বাড়বে, যেখানে ব্যক্তিরা নির্দিষ্ট প্রকল্পের ভিত্তিতে কাজ করবেন। দূরবর্তী কাজের প্রবণতাও বাড়তে পারে, যা ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতা কমাবে।

কোন ধরনের চাকরি ঝুঁকিতে এবং কোনটি নিরাপদ?

সাধারণত যেসব কাজে পুনরাবৃত্তিমূলক, নিয়মভিত্তিক ও সীমিত সৃজনশীলতার প্রয়োজন হয়, সেসব চাকরি এআই দ্বারা অটোমেশনের ঝুঁকিতে আছে। এর মধ্যে আছে ফ্যাক্টরি কর্মী, কল সেন্টার এজেন্ট, ডেটা এন্ট্রি অপারেটর, কিছু প্রশাসনিক কাজ, হিসাবরক্ষক প্রভৃতি ক্ষেত্র এবং ট্যাক্সি ড্রাইভারের জায়গায় আসবে স্বয়ংক্রিয় গাড়ি।

অন্যদিকে যেসব কাজের জন্য উচ্চমানের সৃজনশীলতা, সহানুভূতি, জটিল সমস্যার সমাধান, কৌশলগত চিন্তাভাবনা এবং আন্তঃব্যক্তিক দক্ষতার প্রয়োজন হয়, সেসব চাকরি এআই দ্বারা প্রতিস্থাপিত হওয়ার সম্ভাবনা কম। এর মধ্যে আছে—শিক্ষক, চিকিৎসক (বিশেষজ্ঞ ও মানবিক দিক), মনোবিজ্ঞানী, সৃজনশীল শিল্পী, লেখক, চিত্রশিল্পী, সংগীতজ্ঞ, গবেষক, ব্যবস্থাপক ও নেতৃত্বস্থানীয় পদ, উচ্চ পর্যায়ের বিক্রয় ও বিপণন, এআই ডেভেলপার ও প্রকৌশলী।

এআইয়ের এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এবং সুযোগগুলো কাজে লাগাতে আমাদের প্রস্তুত হতে হবে এবং সেই প্রস্তুতি নেওয়ার এখনই সময়। এসব প্রস্তুতির ক্ষেত্রে সবার আগে শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার জরুরি। শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কারে দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষায় জোর দিতে হবে। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিত শিক্ষাকে উৎসাহিত করতে হবে, কারণ এসব ক্ষেত্র এআইয়ের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সব স্তরের শিক্ষার্থীদের এআই সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দিতে হবে, যাতে তারা এর সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে অবগত থাকে এবং এআইয়ের যথাযথ ব্যবহার করতে পারে।

দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মেলাতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আজীবন শেখার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। সেইসঙ্গে কর্মজীবীদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও আপস্কিলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। সুপরিকল্পিত কর্মসংস্থান নীতি গ্রহণ করতে হবে সরকারকে। যেসব চাকরি ঝুঁকিতে আছে, সেগুলোর কর্মীদের নতুন দক্ষতার প্রশিক্ষণ দিয়ে অন্য খাতে তাদের কাজের সুযোগ তৈরি করতে হবে।

বিশেষ করে উদ্ভাবন ও গবেষণার ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার কোনো বিকল্প নেই। এজন্য এআই গবেষণায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং এআই-ভিত্তিক স্টার্টআপগুলোকে উৎসাহিত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, তথ্য ও প্রযুক্তির সঙ্গে সমান তালে চলতে না পারলে বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক পৃথিবীতে টিকে থাকা কঠিন হবে।

এআইয়ের কারণে যারা চাকরি হারাতে পারেন, তাদের জন্য একটি শক্তিশালী সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করা উচিত। এ ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা এবং ব্যক্তিপর্যায়ে সক্ষমদের নিয়ে এই সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে, প্রস্তুতিহীন বিপদ মোকাবিলা করার চেয়ে যথাযথ প্রস্তুতি নিয়ে বিপদ মোকাবিলা করা হাজার হাজার গুণ শ্রেয়। আবার এআইয়ের নৈতিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে এবং এর অপব্যবহার রোধে নীতিমালা প্রণয়ন অপরিহার্য। এই নীতিমালা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।

পরিশেষে বলতে চাই, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কোনো কল্পবিজ্ঞান নয়, এটি বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। এটি কর্মসংস্থানের ভবিষ্যৎকে আমূল পরিবর্তন করবে। এই পরিবর্তনকে ভয় না পেয়ে এটিকে সুযোগ হিসেবে দেখা উচিত। যদি আমরা সঠিক প্রস্তুতি গ্রহণ করি, তাহলে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে সক্ষম হব। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের প্রতিযোগী নয়, বরং মানুষের সহযোগী হতে পারে, যদি আমরা প্রস্তুত থাকি।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি আনন্দ মোহন কলেজ, ময়মনসিংহ

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত