শাহবাগি আধিপত্যবাদ : কীভাবে রুখে দাঁড়াব

ড. মো. ফরিদ তালুকদার
প্রকাশ : ১৭ মার্চ ২০২৫, ১০: ৫৬
ড. মো. ফরিদ তালুকদার

অপার সম্ভাবনাময় দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশের যখন অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক ও সামরিকভাবে শক্তিশালী অবস্থানে থাকার কথা, ঠিক সে সময় এদেশের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় এক ভয়ংকর ফ্যাসিবাদী শাসন। আর এই ফ্যাসিবাদী শাসন প্রতিষ্ঠায় ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের পাশাপাশি যে শক্তি সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে তার নাম শাহবাগ।

শাহবাগ কী?

বিজ্ঞাপন

শাহবাগ শুধু ২০১৩ সালের একটি ‘আন্দোলন’ বা ঢাকার জাতীয় জাদুঘরের সামনের একটি ‘স্থান’ নয়। ২০১৩ সালে আমার দেশ পত্রিকা যেই শাহবাগ সম্পর্কে সর্বপ্রথম আমাদের সচেতন করেছিল সেই শাহবাগ কোনো নির্দিষ্ট ‘স্থান’ বা ‘আন্দোলন’ নয়, শাহবাগ মূলত একটি আদর্শ বা ইডিওলজি, যাকে আমরা পাঠ করব শাহবাগি আদর্শ বা শাহবাগি ইডিওলজি হিসেবে।

২০১৩ সালে ঢাকার শাহবাগে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় যে মব তৈরি হয়েছিল, তা মূলত ভারতীয় আধিপত্যবাদ থেকে উদ্ভূত একটি আদর্শ। অন্যভাবে বললে এটা মূলত ভারতীয় আধিপত্যবাদের সম্প্রসারণ। শাহবাগি আদর্শের মোটাদাগে তিনটি দিক আছে—১. রাষ্ট্রের সব শক্তি ও মেশিনারিজের অপব্যবহার করে ভিন্নমত এবং ভিন্নমতের মানুষকে দমন বা নির্মূল করা; ২. ভারতকে পরীক্ষিত বন্ধু মনে করে বাংলাদেশের স্বার্থের ওপরে ভারতের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে রাষ্ট্রের সব নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা; এবং ৩. সর্বোপরি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের আধিপত্য ও প্রভাবকে সুসংহত ও স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত করা।

তাই ২০১৩ সালে ঢাকার শাহবাগের আন্দোলনে সরাসরি অংশগ্রহণ না করেও, এমনকি ২০১৩ সালের পরে জন্ম নিয়েও যে কেউ শাহবাগি হতে পারে, যদি সেই ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ওপরের উল্লিখিত চরিত্র বা বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৩ সালে আমেরিকায় অধ্যয়নরত বা অধ্যাপনায় নিযুক্ত অনেক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শাহবাগ আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে ফাঁসির দাবিতে মানববন্ধন করেছেন। যদিও তাদের অনেকেই সরাসরি শাহবাগ আন্দোলনে উপস্থিত ছিলেন না, তাহলে তারা কি শাহবাগি নন? অবশ্যই তারা শাহবাগি, কারণ শাহবাগি হওয়ার জন্য শারীরিকভাবে শাহবাগে উপস্থিত থাকা অপরিহার্য নয়; প্রয়োজন হলো শাহবাগি আদর্শ ধারণ করা।

শাহবাগি আদর্শের বিস্তৃতি কীভাবে হয়?

শাহবাগি আদর্শ প্রতিষ্ঠা ও বিস্তৃতিতে রাজনৈতিক সংগঠন ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বড় ভূমিকা পালন করে। আর এই রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর প্রধান ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আওয়ামী লীগ। আর সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে শিল্পকলা একাডেমি, উদীচী, ছায়ানটসহ আরো সরকারি-বেসরকারি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। এখানে বাম রাজনৈতিক দলগুলোকে আলাদাভাবে উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই। কারণ বাম দলগুলোকে আওয়ামী লীগ থেকে আলাদা করে দেখা বা পাঠ করার সুযোগ নেই। ছাত্রলীগ বা যুবলীগ যেমন আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন, তেমনি বাম দল যেমন জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টিকেও আওয়ামী লীগের সংগঠন হিসেবেই পাঠ করতে হবে আগামীর বাংলাদেশে। এই রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শক্তি শাহবাগি আদর্শকে বাংলাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়েছে এবং প্রতিষ্ঠিত করেছে।

লক্ষ্য অর্জনে শাহবাগি আদর্শ কীভাবে কাজ করে?

১. বিগত বছরগুলোয় আমরা দেখেছি, ভারত যা চায় শাহবাগ ও আওয়ামী লীগ তা-ই করে। শাহবাগ ও আওয়ামী লীগ মূলত ভারতের আধিপত্যবাদকে বাংলাদেশে ফেরি করে। ‘ভারত-আওয়ামী লীগ-শাহবাগ’ জোটবদ্ধ হয়ে কাজ করে। তাই ভারত, আওয়ামী লীগ ও শাহবাগকে আলাদা-আলাদাভাবে দেখার সুযোগ নেই। এরা এক ও অভিন্ন।

২. বাংলাদেশে যেহেতু ভাষার ভিত্তিতে (ভারতে একেক অঙ্গরাজ্যে একেক ভাষার মতো), ধর্মের ভিত্তিতে (মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া-সুন্নির বিভাজনের মতো), বর্ণের ভিত্তিতে (পশ্চিমা দেশে কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গের মতো) সাংঘর্ষিক বিভাজন নেই, সেহেতু এদেশে সামাজিক ও জাতিগত বন্ধন ছিল সুদৃঢ়। তাই বিভাজন তৈরি করে বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ভারত শাহবাগের মাধ্যমে এবং শাহবাগের বয়ানে বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের তথাকথিত পক্ষের শক্তি ও বিপক্ষের শক্তি—এই দুই শিবিরে ভাগ করে। পরে এই বিভাজনকে ভারত ও শাহবাগের রাজনৈতিক শক্তি আওয়ামী লীগের হাতে তুলে দিয়ে বিভাজনকে সামাজিকীকরণ ও রাষ্ট্রীয়করণ করা হয়। তারপর ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ পদ্ধতিতে বাংলাদেশকে ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে ভারত শোষণ করে।

৩. আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠায় ভারতের দরকার একটি অনুগত রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় রাখা। যেহেতু ভারত-আওয়ামী লীগ-শাহবাগ এক ও অভিন্ন, সেহেতু ভারত ও শাহবাগ যেকোনো মূল্যে আওয়ামী লীগকেই ক্ষমতায় রাখতে চেয়েছে। শাহবাগ এই কাজ করার জন্য আওয়ামী লীগের পক্ষে বয়ান তৈরি করেছে, বয়ান বাজারজাত করেছে। ওই বয়ানকে কেউ গ্রহণ করতে না চাইলে শাহবাগ তাকে ‘রাষ্ট্রের শত্রু’ হিসেবে সামাজিকভাবে চিহ্নিত করেছে এবং ‘হত্যাযোগ্য’ করে আওয়ামী লীগের রাষ্ট্রীয় শক্তির হাতে তুলে দিয়েছে। আওয়ামী লীগ তাকে হত্যা করেছে, শাহবাগ ওই হত্যার পক্ষে বয়ান তৈরি করেছে, হত্যাকে জায়েজ করেছে।

৪. শাহবাগ বাংলাদেশের স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির বিপক্ষে কাজ করে। শাহবাগের বয়ান হলো—‘ভারত বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধু।’ তাই পররাষ্ট্রনীতির প্রতিটি স্তরে ভারতের পরামর্শ আমলে নেওয়ার পক্ষে শাহবাগ। শাহবাগ চায় সারা বিশ্ব যেন ভারতের চোখ দিয়ে বাংলাদেশকে দেখে। তাই এখনো ভারত যখন বাংলাদেশের বিষয় আমেরিকার সঙ্গে কথা বলে, শাহবাগ খুশি হয়। বাংলাদেশ যখন চীনের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি করতে চায়, শাহবাগ অখুশি হয়। বাংলাদেশ যখন পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে চায়, শাহবাগ ওই সম্পর্কের মধ্যে ‘জঙ্গি’ খুঁজে পায়।

৫. শাহবাগ চায় না বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হোক। শাহবাগের ভাষায় আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য সবাই স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি। তাই তাদের রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার থাকতে নেই। শাহবাগ মনে করে, যে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হবে, সে নির্বাচন দরকার নেই। এমনকি আওয়ামী লীগের সব অগণতান্ত্রিক ও ফ্যাসিবাদী কর্মকাণ্ডকে শাহবাগ বৈধতা দেয়, কারণ শাহবাগের বয়ান হলো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাটাই ‘গণতন্ত্র’।

৬. বাংলাদেশকে সামরিকভাবে শক্তিশালী করার বিপক্ষে শাহবাগ। ২০০৯ সালে ভারত শাহবাগের রাজনৈতিক শক্তি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর পরিকল্পিতভাবে বিডিআর বিদ্রোহের নামে শক্তিশালী দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে দুর্বল করে দেয়। ওই সেনা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত আওয়ামী লীগের সব কর্মকাণ্ডকে শাহবাগ বৈধতা দেয়। শাহবাগ মনে করে, ভারত মাইন্ড করবে বা ভারতের মনঃক্ষুণ্ণ হবে, এমন কোনো সামরিক সক্ষমতা অর্জন করার দরকার বাংলাদেশের নেই।

এমন আরো নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শাহবাগ ভারতীয় আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য অর্জন করে।

আমাদের করণীয় কী?

১. শাহবাগকে ‘স্থান’ হিসেবে এবং ২০১৩ সালের কেবল একটি ‘আন্দোলন’ হিসেবে দেখা যাবে না। দেখতে হবে ‘শাহবাগি আদর্শ’ হিসেবে, যা মূলত ভারতীয় আধিপত্যবাদের সম্প্রসারণ।

২. পতিত আওয়ামী সরকার, ২০১৩ সালে এবং তার পরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের ক্যাঙ্গারু কোর্টের মাধ্যমে ফাঁসি দিয়েছে, শাপলা চত্বরে আলেমদের হত্যা করেছে, অগণিত মানুষকে খুন করেছে, গুম করেছে, আয়নাঘরে বন্দি করে রেখেছে, ২০২৪ সালে হাজার হাজার মানুষকে পঙ্গু করেছে এবং হত্যা করেছে। হত্যার পরে অনেকের মৃতদেহ পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আর মানবতাবিরোধী এসব অপরাধের সঙ্গে আওয়ামী লীগের পাশাপাশি শাহবাগ জড়িত। তাই এই অপরাধের জন্য শাহবাগের বিচার করতে হবে। বিচার করতে হবে শাহবাগি প্রতিষ্ঠান গণজাগরণ মঞ্চের এবং এর কুশীলবদের।

৩. ভারত-আওয়ামী লীগ-শাহবাগকে এক ও অভিন্নভাবে পাঠ করতে হবে।

৪. আওয়ামী লীগ বাংলাদেশকে ভারতীয় যে খাঁচায় রেখে গেছে, সেই বন্দিত্ব থেকে খাঁচা ভেঙে বাংলাদেশকে বের করতে হবে । ‘ভারত বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধু’ এই ডক্ট্রিন থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের দেশের স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে, সব রাষ্ট্রের সঙ্গে পারস্পরিক স্বার্থ এবং বোঝাপড়ার ভিত্তিতে সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে।

৫. ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ও বিপক্ষের শক্তি’ ফ্যাসিবাদের তৈরি এই বয়ান এবং বিভাজন থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করতে হবে। বর্তমানে যারা বাংলাদেশের নাগরিক, তারা সবাই স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পক্ষের লোক। এ বিষয়ে আর কোনো বিতর্কের অবকাশ নেই। যারা এই বিভাজনকে জিইয়ে রাখবে, তারাই মূলত শাহবাগি।

৬. মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে হবে এবং আওয়ামী লীগের রেখে যাওয়া ধ্বংসস্তূপ থেকে এদেশের প্রতিষ্ঠানকে নতুন করে গড়ে তুলতে হবে।

৭. বাংলাদেশকে সামরিকভাবে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে হবে, যাতে করে কেউই আমাদের সার্বভৌমত্বের ওপরে আঘাত হানতে না পারে। প্রতিটা রাষ্ট্র একে অন্যের বন্ধু ও শত্রু। কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব কোনো চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নয়। তাই আমাদের নিরাপত্তা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করে।

যদি আমরা এগুলো করতে পারি, তাহলে শাহবাগি আদর্শের কালো থাবা রুখে দেওয়া সম্ভব হবে।

সহকারী অধ্যাপক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ

ম্যাকনিজ স্টেট ইউনিভার্সিটি

লুইসিয়ানা, ইউএসএ

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়:

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত