জাতীয় পার্টির বিচার কেন নয়

মাহতাব মুহাম্মদ
প্রকাশ : ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৩: ০৭

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে জাতীয় পার্টি (জাপা) এক অদ্ভুত চরিত্র। পতিত ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের দেড় যুগের দুঃশাসনের সময়ে গুম-খুন, লুটপাট ও ভারতের তাঁবেদারি করার প্রধান সহযোগী ছিল জাতীয় পার্টি। এই দলটির অব্যাহত সমর্থনের কারণেই আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী শাসন দীর্ঘায়িত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল।

তথাকথিত উন্নয়নের নামে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান দখলে নিয়ে ব্যাপক লুটপাট করে অর্থনীতিকে ধ্বংস করার প্রধান সহযোগী হচ্ছে জাতীয় পার্টি। ফলে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হলে জাতীয় পার্টির কার্যক্রম নিষিদ্ধ ও দলটির নেতারা কেন বিচারের আওতায় আসবেন না?

বিজ্ঞাপন

স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তার ক্ষমতা দখলকে বৈধতা দিতে ও দীর্ঘায়িত করতে ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকেই বিতর্ক আর সমালোচনার কেন্দ্রে ছিল জাতীয় পার্টি। দলটির বিরুদ্ধে রয়েছে গুরুতর কিছু অভিযোগ। প্রথমত, জাতীয় পার্টির শাসনামলে ভোটপ্রক্রিয়া ছিল বারবার প্রশ্নবিদ্ধ। ১৯৮৬ সালের নির্বাচন কারচুপির অভিযোগে বিতর্কিত হয়ে পড়ে। ১৯৮৮ সালের নির্বাচনও ছিল একতরফা, যেখানে প্রায় সব বিরোধী দল নির্বাচন বর্জন করে। তারপরও এরশাদ একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা করেন। পরে শেখ হাসিনা জাতীয় পার্টির কাছ থেকেই একতরফা নির্বাচন করার দীক্ষা নিয়েছিলেন।

দ্বিতীয়ত, জাতীয় পার্টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে যুক্ত। ১৯৮৭ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে দেশ ছিল উত্তাল। সেই বছরের ১০ নভেম্বর রাজপথে দেখা মেলে নূর হোসেন নামে এক টগবগে প্রতিবাদী যুবকের। তার বুকে-পিঠে লেখা-‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক।’ পুলিশ গুলি করে হত্যা করে নূর হোসেনকে। এ যেন ২০২৪-এর জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আবু সাঈদকে হাসিনার পুলিশ বাহিনীর হত্যার জেরক্স কপি। এরপর ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামে লালদিঘী মাঠে জনসভার আগের মিছিলে পুলিশের গুলিতে ২৪ জন নিহত হন। ঘটনাটি ‘চট্টগ্রাম গণহত্যা’ নামে পরিচিত।

পরে হাসিনা নিজেও তার ১৫ বছরের শাসনামলে গৃহপালিত বাহিনী দিয়ে এর চেয়েও ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছেন। শুধু জুলাই গণঅভ্যুত্থানেই হাসিনা প্রায় ১৪০০ জন মানুষ হত্যা করেছে। পুলিশ বাহিনী দিয়ে হত্যাযজ্ঞ ঘটানোর অপকর্মটা বোধ হয় হাসিনা জাতীয় পার্টির নেতৃত্বাধীন এরশাদ সরকারের কাছ থেকে শিখেছেন, যদিও শেখ মুজিবের শাসনামলেও রক্ষীবাহিনী ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। সেখান থেকেও হাসিনা হত্যাকাণ্ড চালানো শিখে থাকতে পারেন। এভাবে হাসিনার মতোই জাতীয় পার্টির শাসনামলে রাজনৈতিক বিরোধিতা দমন ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। তখন আন্দোলন দমনে পুলিশ ও সেনাবাহিনী ব্যবহার করা হতো, ঠিক যেমনটা হাসিনা করতেন। তখন গুলি চালানো ও কারফিউ জারি ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। এতে ১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ সালের আন্দোলনে বহু মানুষ নিহত হন। এই দমননীতি রাষ্ট্রযন্ত্রকে স্থায়ীভাবে নিরপেক্ষতা হারাতে বাধ্য করে।

তৃতীয়ত, জাতীয় পার্টির নেতৃত্বাধীন এরশাদ সরকারের আমলে দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। সরকারি চাকরিতে ঘুস, স্বজনপ্রীতি ও রাজনৈতিক অনুগতদের প্রাধান্য ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করে। উন্নয়ন প্রকল্পগুলো দুর্নীতির কবলে পড়ে। প্রশাসন নিরপেক্ষতা হারিয়ে শাসকের হাতিয়ার হয়ে ওঠে। এভাবে প্রাতিষ্ঠানিক অবক্ষয় স্থায়ী রূপ পেতে থাকে। সে সময় জাতীয় পার্টির স্বৈরশাসনের কারণে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বৈরাচারী রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত হতো। মানবাধিকার লঙ্ঘন ও প্রহসনের নির্বাচনের কারণে বিদেশি সহযোগিতা এবং কূটনৈতিক সমর্থন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এত কিছু করার পরও দল হিসেবে জাতীয় পার্টির কোনো বিচার হয়নি।

এরশাদকে যদিও দুর্নীতির কয়েকটি মামলায় দণ্ডিত করা হয়েছিল, তবে এই বিচার ছিল ব্যক্তিগত দুর্নীতি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। রাষ্ট্রক্ষমতা অবৈধভাবে দখল করা, হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে আন্দোলন দমন, মানবাধিকার লঙ্ঘন, নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করার কোনো বিচার হয়নি। দল হিসেবে জাতীয় পার্টি এ ক্ষেত্রে এক ধরনের দায়মুক্তি পেয়েছে। এ তো গেল জাতীয় পার্টির অপকর্মের সংক্ষিপ্ত নমুনা। হাসিনা সরকারের স্বৈরশাসনে জাতীয় পার্টি যেভাবে মদত জুগিয়েছে, তা দেশের ইতিহাসে বিরল।

২০১৪ সালে যখন সব প্রধান দল আওয়ামী লীগের পাতানো নির্বাচন বর্জন করে, তখন জাতীয় পার্টি জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে বেঈমানি করে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত করে নির্বাচনে যায়। পরিহাসের বিষয়, সেই নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে একদিকে সরকারে মন্ত্রিত্ব দেওয়া হয়, অন্যদিকে বিরোধী দলের আসনও দখল করে তারা। এভাবে বিরোধী দলে থেকেও সরকারের মন্ত্রী হওয়ার মতো হাস্যকর ও জঘন্য নজির কোনো গণতান্ত্রিক দেশে নেই। গণতন্ত্রে বিরোধী দল মানে সরকারের সমালোচক ও বিকল্প শক্তি। কিন্তু জাতীয় পার্টি হয়ে উঠেছিল গৃহপালিত বিরোধী দল। এটি একদিকে যেমন হাসিনার স্বৈরশাসনকে দীর্ঘায়িত করেছে, তেমনি রাজনৈতিক আদর্শের অবক্ষয় ঘটিয়েছে।

গণতান্ত্রিক দেশে প্রকৃত বিরোধী দল না থাকলে সরকার ক্রমাগত স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে, কারণ তখন সরকারের সিদ্ধান্ত ও ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করার মতো কেউ থাকে না। জাতীয় পার্টিও ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে এবং গৃহপালিত বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করে হাসিনাকে স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে। হাসিনার করা গুম-খুন-দুর্নীতিসহ সব কুকর্মকে নীরবে সমর্থন দিয়েছে, সহযোগিতা করেছে। ফলে হাসিনার কুকর্মের দায়ভার জাতীয় পার্টি এড়াতে পারে না। তাছাড়া জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের মতোই ভারতীয় আধিপত্যবাদকে সমর্থন করেছে। ২০২৩ সালের ২৩ আগস্ট ভারতে তিন দিনের সফর শেষে দেশে ফিরে জাপার চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেছিলেন, ‘খোলামেলা আলোচনা হয়েছে, ভারতের অনুমতি ছাড়া বলা যাবে না।’

একটি দল কতটা ভারতের অধীন হলে ভারতের অনুমতি ছাড়া কথাই বলতে পারে না, সেটি বুঝতে রকেট বিজ্ঞান জানার প্রয়োজন নেই। সব মিলিয়ে জাতীয় পার্টির কারণে সংসদ অকার্যকর হয়েছে, গণতন্ত্র দুর্বল হয়েছে, নির্বাচনব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসন আরো শক্ত ভিত্তি পেয়েছে এবং তার সরকারের গুম-খুন-দুর্নীতি-দমন-পীড়নের সময়কাল দীর্ঘায়িত হয়েছে। সংগত কারণেই প্রশ্ন ওঠে, যদি মানবাধিকার লঙ্ঘন ও ফ্যাসিবাদী আচরণের কারণে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা যায়, তবে একই অপরাধে জাতীয় পার্টির বিচার কেন নয়?

লেখক : প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ

ইকবাল সিদ্দিকী কলেজ, গাজীপুর

mahtabmuhammad25@gmail.com

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত