কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে যেন দুটো বড় চ্যাপ্টার একসঙ্গে বন্ধ হয়ে গেল। একদিকে বেগম খালেদা জিয়া—যাকে আমরা দেশনেত্রী বলে ডাকি, যিনি পুরো জীবন গণতন্ত্রের জন্য লড়েছেন, কারাগারে গিয়েছেন, দেশ চালিয়েছেন। তার চলে যাওয়া এসেছে বয়সের নিয়মে, দীর্ঘ অসুস্থতার পর। অন্যদিকে শরীফ ওসমান হাদি—জুলাই বিপ্লবের সেই তরুণ মুখ, যে ছেলেটা রাস্তায় দাঁড়িয়ে নতুন প্রজন্মের স্বপ্নের কথা বলত। তাকে গুলি করে মারা হলো মসজিদ থেকে বের হওয়ার সময়। দুজনের বিদায় এত কাছাকাছি এসে পড়বে, এটা কেউ ভাবেনি। একজনের যাওয়া যেন ধীরে ধীরে সূর্যাস্তের মতো, অন্যজনেরটা হঠাৎ ঝড়ে গাছ উপড়ে ফেলার মতো। এই দুই মৃত্যু যেন বাংলাদেশের রাজনীতির দুই প্রান্তকে একসঙ্গে জুড়ে দিল—অতীতের ঐতিহ্য আর ভবিষ্যতের সম্ভাবনা।
খালেদা জিয়াকে দেখলে মনে হতো তিনি একটা বিশাল গাছ। শিকড় গভীরে গোঁজা, ডালপালা ছড়ানো, ছায়া দিয়েছেন অনেককে। স্বাধীনতার পরের রাজনীতি তিনি না থাকলে এতটা রঙিন হতো কি নাÑসন্দেহ। ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের হত্যার পর যখন বিএনপি নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়ে, তখন তিনি এগিয়ে আসেন। অনেকে বলতেন, রাজনীতি তার জন্য নয়। কিন্তু তিনি দেখিয়ে দিলেন, একজন মহিলা কীভাবে পুরুষতান্ত্রিক রাজনীতির মাঠে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন। এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান, তারপর ১৯৯১-এ প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হওয়া—সবকিছুতেই তার ছাপ স্পষ্ট। তার শাসনকালে দেশে অবকাঠামো গড়ে উঠেছে, অর্থনীতি এগিয়েছে, পোশাকশিল্প বেড়েছে। কিন্তু জীবনের শেষ দিকটা কাটল অসুস্থতা আর একাকিত্বে। দীর্ঘদিন হাসপাতালে, পরিবারের সদস্যরা পাশে থাকতে পারেননি পুরোপুরি। তবু তিনি ছিলেন আমাদের অভিভাবকের মতো। যখন তিনি চলে গেলেন, অনেকের মনে হয়েছে, যেন মা হারিয়ে ফেললাম। তার বিদায়ে শোকটা গভীর, কিন্তু শান্ত—যেন একটা যুগের সমাপ্তি।
আর হাদি? সে তো ছিল একটা বীজ। এখনো ঠিকমতো গজাতে শুরু করেনি, কিন্তু তার মধ্যে গোটা একটা বন লুকিয়ে ছিল। ২০২৪-এর জুলাইয়ে যখন কোটা সংস্কারের দাবি থেকে ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়, তখন হাদি ছিলেন সামনের সারিতে। ধীরে ধীরে আন্দোলনটা স্বৈরাচারবিরোধী হয়ে উঠলে তিনি ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র হয়ে দাঁড়ান। সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁর ভিডিওগুলো দেখলে মনে হতো, এই ছেলে কথা বলে না, আগুন ছড়ায়। তার চোখে ছিল একটা জ্বলজ্বলে স্বপ্ন—একটা ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশের। যখন স্বৈরাচার পড়ে যায়, তখন মনে হয়েছিল হাদির মতো তরুণরা এবার দেশ গড়বে। কিন্তু ঠিক যখন সবাই ভাবছিল সে নতুন কিছু শুরু করবে, তখনই ডিসেম্বরের সেই কালো দিন। মসজিদ থেকে বের হওয়ার সময় মুখোশধারীরা গুলি করে। সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়া হয়; কিন্তু ফিরে আসেনি। তার মৃত্যুতে রাস্তায় আগুন জ্বলে উঠেছে। শোকটা শান্ত নয়, এটা ক্ষোভে ভরা।
দুজনের জীবন দেখলে অদ্ভুত মিল-অমিল চোখে পড়ে। দুজনেই গণতন্ত্রের জন্য লড়েছেন। খালেদা জিয়া লড়েছেন সভা-মিছিলে, সংসদে ও কারাগারে। তার লড়াই ছিল দীর্ঘ, ধৈর্যের ও প্রতিষ্ঠানের ভেতর দিয়ে। হাদি লড়েছে রাস্তায়, সোশ্যাল মিডিয়ায়, বুলেটের সামনে দাঁড়িয়ে। তার লড়াই ছিল তীব্র, ঝড়ের মতো। একজন পুরোনো প্রজন্মের প্রতীক—যিনি স্বাধীনতার পরের রাজনীতি গড়েছেন। অন্যজন নতুন প্রজন্মের আইকন—যিনি ২০২৪-এ স্বৈরাচার উল্টে দিয়েছেন। একজনের বিদায়ে আমরা হারিয়েছি ঐতিহ্যের ধারককে, অন্যজনের শাহাদতে হারিয়েছি বিপ্লবের আগুনকে।
এখন রাজনীতির মাঠটা সত্যিই অচেনা লাগছে। খালেদা জিয়ার না থাকায় বিএনপির নেতৃত্ব এখন তারেক রহমানের কাঁধে। ১৭ বছর নির্বাসনে থেকে ফিরে তিনি দেশে এসেছেন, নমিনেশন জমা দিয়েছেন, জনসভায় লোক আসছে। অনেকে বলছেন, পুরোনো জোটের একমাত্র আলো এখন তিনি। কিন্তু মনে প্রশ্ন জাগে—যে ক্ষোভ থেকে মানুষ তার দিকে তাকাচ্ছে, সেটা কি সত্যিকারের পরিবর্তন এনে দেবে? অতীতে তো সেই ক্ষোভ থেকে আশা জেগেছিল, আবার নিরাশায় ডুবেছে। অন্যদিকে হাদির না থাকায় জুলাই বিপ্লবের চেতনাটাও যেন কাঁপছে। তার হত্যার বিচার না হলে শহীদদের রক্ত বৃথা যাবে। নতুন প্রজন্মের অনেকে এখনো রাস্তায় নামছে, #JusticeForHadi হ্যাশট্যাগে পোস্ট দিচ্ছে। কিন্তু সেই আগুন কতদিন জ্বলবে?
আগামী ফেব্রুয়ারির নির্বাচনটা এখন শুধু ভোটের লড়াই নয়। এটা হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা। কে জিতবে, তার চেয়ে বড় প্রশ্ন—কোন পথে আমরা হাঁটব? পুরোনো জোট যদি ফিরে আসে, তাহলে কি আবার প্রতিহিংসা আর দুর্নীতির চক্র শুরু হবে? নাকি তারেক রহমান নতুন কিছু দেখাতে পারবেন? আর যদি জুলাইয়ের চেতনায় উঠে আসা নতুন শক্তি জিতে, তাহলে কি সত্যিকারের ন্যায়-সমতার বাংলাদেশ গড়া সম্ভব হবে? এই নির্বাচনে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা, চাকরি, শিক্ষা, চিকিৎসা—সবকিছুর ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। হাদির রক্ত আর খালেদা জিয়ার উত্তরাধিকার—দুটোই আমাদের সামনে প্রশ্ন তুলে দাঁড়িয়ে আছে।
শোকের ভাষা আমার জানা নেই। কখনো মনে হয় খালেদা জিয়াকে হারিয়ে আমরা জাতির মা হারিয়েছি। কখনো মনে হয় হাদিকে হারিয়ে হারিয়েছি আমাদের আগামী দিনের সাহসী এক সন্তান। কিন্তু এই শোককে যদি আমরা শক্তিতে বদলে ফেলতে পারি, তাহলে হয়তো তাদের চলে যাওয়া বৃথা যাবে না। জুলাইয়ের শহীদদের স্বপ্ন আর দেশনেত্রীর গণতন্ত্রের লড়াই—দুটোকে একসঙ্গে ধরে রাখতে হবে। রক্ত আর ত্যাগ দিয়ে গড়া এই দেশকে আরো সুন্দর করার দায়িত্ব এখন আমাদের। আমরা যদি চুপ করে বসে থাকি, তাহলে হাদির রক্ত আর খালেদা জিয়ার সংগ্রাম দুটোই বৃথা যাবে। উঠতে হবে। লড়তে হবে। ন্যায়ের জন্য, সমতার জন্য, একটা নতুন বাংলাদেশের জন্য।
তাদের বিদায় আমাদের শিখিয়ে গেল—জীবন কত অনিশ্চিত আর লড়াই কত জরুরি। আজ আমরা শোকে মুহ্যমান, কিন্তু কাল আমরা উঠব আরো শক্তিশালী হয়ে। শহীদ হাদির আগুন আর দেশনেত্রীর ঐতিহ্য আমাদের পথ দেখাবে। শহীদদের সব আত্মত্যাগ আল্লাহ কবুল করে নিন। আমাদের সার্বভৌমিত্ব আর গণতন্ত্র অটুট থাকুক।
লেখক : প্রকৌশলী, ডিফেন্স অ্যানালিস্ট আমেরিকাপ্রবাসী
আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

