আমেরিকার অস্ত্র কূটনীতির ফাঁদে মধ্যপ্রাচ্য

মিডল ইস্ট মনিটর ডেস্ক
প্রকাশ : ০৩ জুন ২০২৫, ০৯: ৪৮
আপডেট : ০৩ জুন ২০২৫, ০৯: ৪৯

যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বৃহত্তম অস্ত্র উৎপাদনকারী দেশ। ফলে সমরাস্ত্র শিল্পের ওপর ভর করে দেশটির অর্থনীতি যেমন ফুলে-ফেঁপে উঠছে, তেমনি অস্ত্রবাণিজ্যকে ব্যবহার করে বিশ্বে নিজের ভূরাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তিও বাড়িয়েছে দেশটি। মধ্যপ্রাচ্যের তিনটি দেশে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক সফরে আবার তা প্রমাণিত হলো। এ সফরকালে সৌদি আরবের সঙ্গে ১৪২ বিলিয়ন, কাতারের সঙ্গে ১ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের সমরাস্ত্র বিক্রির চুক্তি করেছেন ট্রাম্প। এই তিন দেশের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের মোট অস্ত্র বিক্রির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলারের।

অন্যভাবে বলতে গেলে, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে এই তিন দেশের সম্মিলিত বিনিয়োগের পরিমাণ এটা। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে দেশটির সমরাস্ত্র শিল্পের অবদান কতটা, তা এই বিশাল অঙ্কের চুক্তি থেকে সহজেই অনুধাবন করা যায়। অন্যদিকে, এভাবে সমরাস্ত্র বিক্রির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যের মতো সংঘাতপ্রবণ এলাকাগুলোকে সামরিকীকরণের মাধ্যমে বিশ্ব শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। আবার একই সঙ্গে, অত্যাধুনিক প্রযুক্তির এসব সমরাস্ত্র বিভিন্ন দেশের কাছে বিপুল পরিমাণে বিক্রির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্র প্রতিযোগিতা ও আঞ্চলিক সংঘাতকে উসকে দিচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রযুক্তির এসব অস্ত্র বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কর্তৃত্ববাদী শাসকদের ক্ষমতাকে সংহত ও দীর্ঘস্থায়ী করতে সহায়ক ভূমিকা রাখার পাশাপাশি আইনি কাঠামোভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ার কারণে বিশ্বে শুধু উত্তেজনাই বাড়ছে না, বেআইনি নানা ধরনের সংঘাতে অত্যাধুনিক সামরিক প্রযুক্তির অপব্যবহারের আশঙ্কাও বাড়িয়ে দিচ্ছে। উপসাগরীয় অঞ্চলের তিনটি দেশে বিশাল অঙ্কের সমরাস্ত্র বিক্রির চুক্তি থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠছে, অস্ত্র বিক্রির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি স্বল্প মেয়াদে লাভবান হবে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে বিশ্ব নিরাপত্তার জন্য হুমকি তৈরি করবে।

সমরাস্ত্র শিল্প যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় অর্থনীতির অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। এই শিল্পে যেমন লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি আয়ের বড় একটা অংশও আসছে এই খাত থেকে। ২০২৩ সালে বিশ্বে অস্ত্র রপ্তানির ৪৩ শতাংশই সরবরাহ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এ বছর তাদের অস্ত্র গেছে বিশ্বের ১০৭টি দেশে। বৃহত্তম দুই অস্ত্র নির্মাতা কোম্পানি লকহিড মার্টিন ও বোয়িং দেশটির জিডিপি কর্মসংস্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। একই সঙ্গে বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আধিপত্য বজায় রাখার অর্থায়নেও বড় ভূমিকা রাখে সমরাস্ত্র বিক্রি। গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর আমেরিকান প্রগ্রেসের তথ্য অনুযায়ী, উপসাগরীয় তিনটি দেশ বিশেষ করে সৌদি আরবের সঙ্গে ১৪২ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র চুক্তি সরাসরি মার্কিন প্রতিরক্ষা শিল্পকে সমর্থন জোগাবে এবং দেশটির সামরিকায়নকৃত পররাষ্ট্রনীতিকে আরো জোরদার করবে।

তবে অর্থনীতির এই মডেলের একটা কালো বা অন্ধকার দিকও আছে। কারণ সমরাস্ত্র রপ্তানির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা অনেক সময়ই নীতিনৈতিকতার বিবেচনাকে চাপা দিয়ে রাখে। বিশ্বের অনেক দেশের অগণতান্ত্রিক সরকারগুলোর কাছে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বিক্রি এর বড় প্রমাণ। আল-জাজিরার বিভিন্ন প্রতিবেদনে সৌদি আরবের মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতির নানা চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। বিশেষ করে, ২০১৮ সালে তুরস্কে সৌদি কন্স্যুলেটে নির্বাসিত ভিন্নমতাবলম্বী সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ডের পর এ ধরনের একটি দেশে সমরাস্ত্র বিক্রির নৈতিক বৈধতা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে।

নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কাতার ও আরব আমিরাতের কাছে অস্ত্র বিক্রি নিয়েও মার্কিন কংগ্রেসে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। বলা হয়েছে, এই অস্ত্র চুক্তিতে দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঝুঁকি আছে। সমরাস্ত্র বিক্রির ওপর অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা একটি দুষ্টচক্র তৈরি করেছে, অর্থাৎ প্রতিরক্ষা শিল্পের মুনাফা নিশ্চিত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে অস্ত্রের চাহিদা বাড়াতে হবে। বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করার বিনিময়েই শুধু যুক্তরাষ্ট্রের এই কৌশল বাস্তবায়ন করা হয়।

নীতিনৈতিককতা ও বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্র তার অর্থের প্রয়োজনকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে অস্ত্র ব্যবসাকে চাঙা রাখে। মধ্যপ্রাচ্যের তিনটি দেশে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক সফরে বিশাল অঙ্কের সমরাস্ত্র চুক্তি স্বাক্ষর যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইকোনমি ফার্স্ট’ নীতিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার কৌশলকেই প্রতিফলিত করে। ট্রাম্প এই চুক্তিকে বড় ধরনের অর্থনৈতিক বিজয় হিসেবে চিত্রিত করে বলেছেন, এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা শিল্পে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বিনিয়োগ দুটিই বাড়বে। একই সঙ্গে এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের বাড়বে ভূরাজনৈতিক প্রভাব। ট্রাম্প এ সফরে সৌদি আরবকে এ অঞ্চলে ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান মিত্র হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, সমরাস্ত্র চুক্তির মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে ভারসাম্য ফিরে আসবে। কিন্তু বাস্তবতা হলোÑগাজা ও ইয়েমেনের মতো সমস্যা যেখানে কূটনীতির মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব, সেখানে কূটনীতি বাদ দিয়ে অর্থনৈতিক স্বার্থ ও সমরাস্ত্রকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে।

উপসাগরীয় অঞ্চলে আমেরিকান অস্ত্রের প্রবাহ পুরো মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা ও বিশ্বের নিরাপত্তাকে বড় ধরনের হুমকির মুখে ফেলবে। সৌদি আরবে আমেরিকার ১৪২ বিলিয়ন ডলারের আধুনিক প্রযুক্তির অস্ত্র আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে দেশটির বৈরিতাকে বাড়িয়ে দেওয়ার আশঙ্কা তৈরি করতে পারে। এর আগে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের সঙ্গে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোটের আট বছরের যুদ্ধকালে নির্বিচার বিমান হামলায় ইয়েমেনে বহু সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছে। এ জন্য সৌদি আরবকে আন্তর্জাতিক সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। সৌদি আরবের হাতে নতুন করে আধুনিক সমরাস্ত্র এলে তা ইয়েমেন সংঘাতকে আবার উসকে দিয়ে সংঘাতকে দীর্ঘস্থায়ী করতে পারে।

অন্যদিকে, আরব আমিরাতের সঙ্গে ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন এবং কাতারের ১ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র চুক্তিতে চিনোক হেলিকপ্টার, ড্রোন, এফ-১৬ যুদ্ধ বিমানের যন্ত্রাংশ দেশ দুটির সামরিক সক্ষমতাকে বাড়াবে ঠিকই, কিন্তু তা একই সঙ্গে ভঙ্গুর ভূরাজনৈতিক ভারসাম্যকে নষ্ট করবে। পাঁচ লাখ এনভিআইডিআইএ চিপসসহ যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে বিশ্বের বৃহত্তম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ক্যাম্পাস গড়ে তোলার উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে আরব আমিরাত। এগুলো দিয়ে দেশের সব মানুষের ওপর নজরদারি করার পাশাপাশি এই প্রযুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের হাতে চলে যাওয়ারও আশঙ্কা আছে। সব মিলিয়ে তিনটি দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এই বিশাল অস্ত্র চুক্তি পুরো মধ্যপ্রাচ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতাকে জোরদার করবে। এতে আঞ্চলিক উত্তেজনা বাড়বে, যা একসময় প্রকাশ্য সংঘাতে রূপ নিতে পারে। ফলে এই অঞ্চলে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিবেশ দীর্ঘ মেয়াদে বিনষ্ট হওয়া ঝুঁকি বাড়বে।

উপসাগরীয় তিন দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এবারের অস্ত্র চুক্তি দেশটির সমরাস্ত্র বিক্রির কূটনীতির বৃহত্তর কৌশলেরই অংশ। উদাহরণস্বরূপ, ট্রাম্প প্রথম মেয়াদে প্রেসিডেন্ট থাকার সময় ২০১৭ সালে সৌদি আরবের কাছে ১১০ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রির চুক্তি করেন। যুক্তরাষ্ট্র এভাবেই তার প্রতিরক্ষা শিল্পের ওপর ভর করে দেশের অর্থনীতিকে চাঙা করার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতিতে নিজের প্রভাব বজায় রাখছে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, এটা তারা করছে আন্তর্জাতিক শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়ে, যা খুবই উদ্বেগজনক। দ্য স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (সিপরি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র রপ্তানি ধারাবাহিকভাবে বিশ্বে অস্ত্রবাণিজ্যকে শক্তিশালী করছে। কিন্তু এর ফলে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে সশস্ত্র সংঘাতের মাত্রাও বেড়ে চলেছে।

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রের প্রধান গন্তব্য হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য। আমেরিকান অস্ত্র কীভাবে ইয়েমেন, সিরিয়া ও লিবিয়ায় সংঘাতকে দীর্ঘায়িত করেছে, তা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তাদের এক প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, দীর্ঘমেয়াদি সংঘাতে এসব দেশে বেসামরিক প্রাণহানি বৃদ্ধির পাশাপাশি সাধারণ মানুষ সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। সব মিলিয়ে বেড়েছে আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা। মধ্যপ্রাচ্যের তিন দেশের সঙ্গে ট্রাম্পের এবারের বিশাল অঙ্কের অস্ত্র চুক্তি এ অঞ্চলে সংঘাতের চক্র ও অস্থিশীলতাকে আরো বাড়িয়ে দেবে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত