ঢাকা কলেজে পাঠকমেলার পাঠচক্রে কবি আল মাহমুদকে স্মরণ

আমিনুল ইসলাম
প্রকাশ : ২৫ জুলাই ২০২৫, ১৬: ১৬

প্রাচ্যের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ ঢাকা কলেজে অনুষ্ঠিত হলো ‘আমার দেশ পাঠকমেলা’র মাসিক সাধারণ সভা ও পাঠচক্র। গত ২০ জুলাই, রোববার বেলা ২টায় বাংলা বিভাগের সেমিনার কক্ষে আয়োজিত পাঠচক্রের বিষয় ছিল—‘বিপ্লব ও জাগরণের কবি আল মাহমুদের স্মরণে আলোচনা’।

আলোচনায় অংশ নেন আমার দেশ পাঠকমেলা ঢাকা কলেজ শাখার সভাপতি মো. সাইফুল ইসলাম অপু, সাধারণ সম্পাদক জিহাদ হোসাইন, সাহিত্য সম্পাদক আহমাদ ছাদিক, পাঠাগার ও পাঠচক্রবিষয়ক সম্পাদক ইউসুফ আব্দুল্লাহ, দপ্তর সম্পাদক হানিফ সরকার, সদস্য আমিনুল ইসলাম, তানজিমুল আবিদ এবং সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে আরো কয়েকজন।

বিজ্ঞাপন

পাঠচক্রের শুরুতে সাইফুল ইসলাম বলেন, কবির জন্ম এক ইসলামি ভাবধারার পরিবেশে মৌড়াইলের মোল্লাবাড়িতে। শৈশব কেটেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। তার আত্মজৈবনিক রচনায় উঠে এসেছে—জগৎপুর, সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড়, তিতাস নদীপাড়, লালমোহন পাঠাগার বা কলকাতায় পুলিশের ভয়ে পালিয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা। আল মাহমুদের কবিতা আমাদের মাটি ও মানুষের আত্মার ভাষায় লেখা। তার সাহিত্যিক উত্থান একটি জনগোষ্ঠীর চেতনাকে সাহসের সঙ্গে উচ্চারণ করেছে। আল মাহমুদের কবিতায় প্রেম যেমন গভীর, তেমনি প্রতিবাদের সুরও স্পষ্ট। তিনি ছিলেন প্রেমিকও, প্রতিবাদীও।

জিহাদ হোসাইন বলেন, আল মাহমুদ ছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের আলোকদ্যুতিময় পথপ্রদর্শক। তিনি সমসাময়িক রাজনৈতিক বাস্তবতা ও সাহিত্যিক দায় এড়িয়ে যাননি। সাহিত্যের মধ্য দিয়েই তিনি উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। আধুনিক বাংলা কবিতায় যখন শহরমুখী দৃষ্টিভঙ্গি প্রাধান্য পাচ্ছিল, তখন আল মাহমুদ গ্রামবাংলার কাদামাটি, নদী, ধানক্ষেত আর খেজুরগাছের শব্দ এনে বাংলা কবিতার শরীরে রক্ত সঞ্চালন করেছেন।

আহমাদ ছাদিক বলেন, নব্বইয়ের দশকে তার কবিতায় ধর্মীয় অনুভব ও ইসলামি উপমার কারণে কেউ কেউ তাকে ভুলভাবে মূল্যায়ন করেন। কেউ তো তাকে ‘রাজাকার’ বলতেও দ্বিধা করেন না। অথচ ইতিহাস বলছে ভিন্ন কথা। তিনি ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী ইত্তেফাক অফিস গুঁড়িয়ে দিলে তিনি সেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে দেশত্যাগ করেন। ভাষা আন্দোলনের সময় ক্লাস নাইনে পড়ার সময়ও তিনি কবিতা লেখার অপরাধে ফেরারি হন। তার জীবন ছিল প্রতিরোধের, কলম ছিল বিপ্লবের। তার কলম কখনো চুপ থাকেনি—যখনই দেশ বা জাতির প্রশ্ন এসেছে, তিনি উচ্চারণ করেছেন প্রতিবাদের ভাষা।

আমিনুল ইসলাম কবির ‘কবিতা এমন’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন, যেখানে ফুটে ওঠে বাংলার প্রকৃতি, ফুল, পাখি ও গ্রামীণ সমাজচিত্র। কবি গ্রামীণ মুসলিম বাঙালির জীবনকথা আধুনিক ব্যঞ্জনায় রূপ দিয়েছেন। তিনি বলেন, আল মাহমুদের কবিতা শুধু প্রকৃতির নয়, তার গভীর দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক দিকও আছে। তার কবিতায় কোরআনিক রেফারেন্স থেকে শুরু করে গ্রামীণ জীবনের সরল দৃশ্য—সবই এক স্রোতে মিশে যায়।

তানজিমুল আবিদ বলেন, আল মাহমুদের কথাসাহিত্য ও প্রবন্ধে রয়েছে স্বপ্নের স্বদেশ নির্মাণের লক্ষ্যে জাতিকে উদ্বুদ্ধ করার প্রয়াস। তিনি শুধু কবিতায় নয়, গদ্যেও জাতির দায়ভার তুলে ধরেছেন। তিনি আরো বলেন, কবির ‘দ্বিতীয় ভাঙন’, ‘যখন গলির ধারে দাঁড়িয়ে থাকি’ কিংবা প্রবন্ধগুলোয় যেমন থাকে দেশপ্রেম, তেমনি রাজনৈতিক অন্তর্দৃষ্টি। আল মাহমুদ একজন ‘সাহিত্যিক ভবিষ্যৎদ্রষ্টা’, যিনি জাতির হৃদয়ের গভীর স্পন্দন বুঝতেন।

ইউসুফ আব্দুল্লাহ বলেন, আল মাহমুদের কবিতা পাঠ আমাদের শুধু কাব্যরস দেয় না, দেয় জাতীয় চেতনার শিক্ষা। তার সাহিত্যচর্চা মানে নিজের শেকড়কে চিনে নেওয়া। তিনি তার লেখনীতে প্রমাণ করেছেন—সাহিত্যে গ্রামীণতা কোনো প্রতিবন্ধক নয়, বরং তা-ই হতে পারে মূলশক্তি। তার কবিতা পড়লে বোঝা যায়, কীভাবে শব্দ, ইতিহাস আর অনুভব একসঙ্গে মিশে যায়। তার ধর্মীয় চেতনার পাঠও সাহসী ও বাস্তবতাপূর্ণ।

আলোচনায় উঠে আসে তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থগুলো—সোনালী কাবিন, কালের কলস, পাখির কাছে ফুলের কাছে, লোক লোকান্তর প্রভৃতি। তার লেখায় যেমন মাটি, নদী ও কৃষক সমাজের ছবি, তেমনি রয়েছে ইতিহাস, ঐতিহ্য, নগরজীবনের দ্বন্দ্ব ও আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধান।

আলোচনার শেষে বক্তারা বলেন, আল মাহমুদকে শুধু একটি চোখে দেখলে হবে না; প্রেম, প্রকৃতি, রাজনীতি, ধর্ম—সবই ছিল তার কবিতায় এবং সেই কবিতা ছিল সাহসিকতায় পূর্ণ। আল মাহমুদের সাহিত্যচর্চা আমাদের জাতীয় ও সাংস্কৃতিক জাগরণে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তার সাহিত্য নতুন প্রজন্মকে দেশপ্রেমে ভীষণভাবে উজ্জীবিত করতে পারে। এজন্য নিয়মিত পাঠ, বিশ্লেষণ ও পাঠচক্রে আলোচনার মাধ্যমে তার কাজকে জীবন্ত রাখার আহ্বান জানানো হয়।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত