আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান সম্প্রতি ঘুরে এলেন প্রাচীন বাংলার রাজধানী সোনারগাঁ। তার সঙ্গে ছিলেন পাঠকমেলার বন্ধুরা।
মাহমুদুর রহমান প্রথমে মুসলিম শাসনামলে সোনারগাঁয়ে বাংলার প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা শেখ শরফ্ উদ্দীন আবু তাওয়ামার সমাধি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি ও আবু তাওয়ামার ভূগর্ভস্থ ধ্যানঘর দেখতে যান। জ্ঞানতাপস শেখ শরফ্ উদ্দীন আবু তাওয়ামা (রহ.) ১৩ শতকের শেষদিকে সুলতানি বাংলার রাজধানী সোনারগাঁয়ে বাংলার প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এটি শুধু বাংলা নয়, ছিল বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন ও বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়।
এখানে ধর্মতত্ত্ব তথা কোরআন শাস্ত্র, হাদিস শাস্ত্র, দর্শন, ইতিহাস, রসায়ন, ভূগোল, চিকিৎসাসহ সমকালীন জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হতো। অল্পদিনেই এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে দেশ-বিদেশে। হিন্দুস্থান, পাকিস্তান, মধ্য এশিয়া, আফ্রিকা, আরবসহ বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে এখানে ছুটে আসেন হাজারো শিক্ষার্থী। একসময় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১০ হাজার। হাজারো জ্ঞানপিপাসু শিক্ষার্থীর কলরবে মুখরিত ছিল রাজধানী সোনারগাঁয়ের এ বিশ্ববিদ্যালয়টি।
ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়, বর্তমান পরিমাণ অনুযায়ী শত বিঘা লা-খেরাজ সম্পত্তি ছিল সুলতান কর্তৃক অর্পিত বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে। শেখ আবু তাওয়ামার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাংলার প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়টি কালের গহ্বরে হারিয়ে যায়। কিন্তু বাংলার সেই স্বর্ণযুগের উৎকর্ষের সাক্ষী হয়ে আজও টিকে আছে বিশ্ববিদ্যালয়টির বেশ কিছু জরাজীর্ণ ভবন। এর মধ্যে অন্যতম হলো শেখ আবু তাওয়ামার কবর, প্রাচীন মসজিদ এবং দমদমা এলাকাজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু ভবনের ধ্বংসাবশেষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি ভবন বা কুতুবখানা এবং কুতুবখানার বেসমেন্ট বা মাটির নিচের অংশে শেখ আবু তাওয়ামার ধ্যানঘরটি টিকে আছে উৎকর্ষের সাক্ষী হয়ে। কিন্তু সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও নিয়ন্ত্রণের অভাবে বিশ্ববিদ্যালয়টির শেষ নিদর্শনগুলো ধ্বংসের চূড়ান্ত ধাপে উপনীত। বহু ভবন ইতোমধ্যে বেদখল হয়ে গেছে। স্থানীয়রা ব্যবহার করছে। কেউবা এগুলো ভেঙে তার উপরে নির্মাণ করেছে নতুন স্থাপনা।
মাহমুদুর রহমান বাংলার প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিস্তৃত এলাকা পরিদর্শন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা পৃথিবীবিখ্যাত স্কলার শেখ শরফ্ উদ্দীন আবু তাওয়ামা ও তার শিষ্যদের কবর জিয়ারত করেন। এরপর তিনি দমদমা গ্রামের পুরোনো জমিদার বাড়িগুলো ঘুরে দেখেন। এসব বাড়ির কয়েকটি সরকার থেকে লিজ নিয়ে সোনারগাঁও সরকারি কলেজের ছাত্র ও শিক্ষকদের ছাত্রাবাস তৈরি করা হয়েছে। একটি ভবন সরকারের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ইউনিয়ন ভূমি অফিসের কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। বাকিগুলো বেদখলে চলে গেছে।
তারপর তিনি সালতানাত-ই-বাঙ্গালার প্রতিষ্ঠাতা সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের নাতি এবং স্বাধীন বাংলা সালতানাতের তৃতীয় সুলতান গিয়াসউদ্দীন আজম শাহের মাজার জিয়ারতের জন্য শাহ চিল্লাহপুর গ্রামে আসেন। সুলতান গিয়াসউদ্দীন আজম শাহের মাজার কমপ্লেক্সে আরো আছে সালতানাত-ই-বাঙ্গালার কাজিউল কুজাত বা প্রধান বিচারপতি সিরাজুদ্দিনের মাজার। তিনি মাজারের অবৈতনিক কেয়ারটেকার অশীতিপর বৃদ্ধ ওসমান গনির সঙ্গে কথা বলেন। ওসমান গনি মাহমুদুর রহমানের কাছে তার দুঃখের কথা জানিয়ে তার চাকরি সরকারীকরণের জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে মাহমুদুর রহমানকে অনুরোধ জানান।
গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ তার বাবা সুলতান সিকান্দার শাহ ও দাদা সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহর মতোই অত্যন্ত ন্যায়পরায়ণ, জ্ঞানানুরাগী ও সংস্কৃতিমনা সুশাসক ছিলেন। তিনি সুফি-দরবেশদের শ্রদ্ধা করতেন। তার দরবারে বাংলা ও সংস্কৃত ভাষার কবি-সাহিত্যিকরা রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেতেন। গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ তার আদর্শ চরিত্র, শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতা এবং সুশাসনের জন্য যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেন। আইনের প্রতি ছিল তার গভীর শ্রদ্ধা। এই সুলতান নিজে বিদ্বান ও কবি ছিলেন। বাংলা সালতানাতের অফিশিয়াল ভাষা ফারসিতে কবিতা লিখতেন। তৎকালীন পারস্য সাম্রাজ্যের প্রধান কবি হাফিজ শিরাজীর সঙ্গে তার পত্রালাপ ছিল। একবার তিনি হাফিজ শিরাজীর কাছে কবিতার একটি চরণ লিখে পাঠান এবং কবিতাটিকে পূর্ণ করার জন্য কবিকে অনুরোধ জানান। তিনি শিরাজীকে বাংলায় আসার আমন্ত্রণও জানান। কবি শিরাজী দ্বিতীয় চরণটি রচনা করে কবিতাটি পূর্ণ করে পাঠান এবং সঙ্গে তিনি সুলতানের কাছে একটি গজলও লিখে পাঠান। গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ বাংলা সাহিত্যের উন্নতির ক্ষেত্রেও যথেষ্ট অবদান রাখেন। তার পৃষ্ঠপোষকতায় শাহ মুহম্মদ সগীর তার বিখ্যাত কাব্য ‘ইউসুফ-জুলেখা’ রচনা করেন। সম্ভবত সুলতান কৃত্তিবাসকেও বাংলায় রামায়ণ লেখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। পরে আমার দেশ সম্পাদক দমদমা গ্রামে মাওলানা ওবাইদুল কাদের নদভী কাসেমী প্রতিষ্ঠিত মাদরাসাতুশ শরফ আল ইসলামিয়া পরিদর্শন করেন এবং জোহরের নামাজ আদায় করেন। সফরে তার সঙ্গে ছিলেন আমার দেশ-এর পরিচালক শাকিল ওয়াহেদ, সাহিত্য সম্পাদক মুহিম মাহফুজ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা মুকুল খান।
১২ নভেম্বর সোনারগাঁ এলে আমার দেশ পরিবারকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেন সোনারগাঁ প্রতিনিধি ফজলে রাব্বী সোহেল, আমার দেশ পাঠকমেলা সোনারগাঁ শাখার সভাপতি অধ্যাপক কবির মৃধা, সাধারণ সম্পাদক গাজী তানভীর আহাম্মেদ রাজিব ও সাংগঠনিক সম্পাদক আতা রাব্বী জুয়েল।
এ সময় মাহমুদুর রহমান পাঠকমেলার সদস্যদের সমাজ উন্নয়নে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘মানুষের কল্যাণে কাজ করার মাধ্যমে এক ধরনের আত্মতৃপ্তি পাওয়া যায়। সমাজের উন্নয়নে তোমাদের কাজ করতে হবে।’ মাহমুদুর রহমানকে শুভেচ্ছা জানাতে আরো ছিলেন সোনারগাঁও প্রেস ক্লাবের সহসভাপতি মুক্তার হোসেন মোল্লা, সাধারণ সম্পাদক আবু বকর সিদ্দিক, জমিরীয়া শামসুল উলুম মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক মাওলানা তাফাজ্জল হোসেন ফরিদী, আমার দেশ গজারিয়া প্রতিনিধি আমিনুল ইসলাম নয়ন, সোনারগাঁয়ে কর্মরত সাংবাদিক মো. মনির হোসেন, মোকারম মামুন, কামরুল ইসলাম পাপ্পু, আশরাফুল আলম, মো. সালাউদ্দিন, ইমরান হোসেন, শেখ ফরিদ, দীন ইসলাম অনিক, মঈন আল হোসাইন ও আমার দেশ পাঠকমেলা সোনারগাঁ শাখার সদস্য আবিদ হাসান, জহিরুল ইসলাম রাসেল, মো. সজীব, মো. শাহীন ও মো. শাহ কামাল।

