অসহায়ের পাশে সহায়

ওমর শাহেদ
প্রকাশ : ০১ মার্চ ২০২৫, ০৯: ৫৫

ছোটবেলা থেকেই পরিবারের ভেতরে শিল্পচর্চা দেখে বড় হয়েছি। ফলে ছোট থেকেই আমি শিল্পভাবাপন্ন। এ কারণেই আমার মধ্যে শিল্পী মনের উদ্ভব ঘটেছে। এ ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে কারুশিল্প বিভাগে ভর্তি হয়েছি ভালো একটি মেধাক্রমে। ক্লাসের কাজগুলো যখন করছিলাম, তখন মনে হলো, একজন শিল্পী যদি নিজের ঘরে ছবি আঁকে, তখন তা হয়ে যায় নিতান্তই নিজের। কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছিল, আমি আমার নিজের জন্য ছবি আঁকব না, আমার পরিবার, সমাজ ও দেশের জন্য আঁকব। এ ধারাবাহিকতায় অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় মাত্র ১ হাজার ৫০০ টাকা পুঁজি নিয়ে মার্কেট থেকে কাঁচামাল কিনে লেগে পড়ি ছোট ছোট হ্যান্ডিক্রাফট তৈরির জন্য এবং এই উদ্যোগের নাম দিই ‘মধুমাখা’।

বিজ্ঞাপন

অনেকেই জিজ্ঞেস করেছেন, এই নাম বেছে নেওয়া কেন? আমার জবাব ছিল, একজন শিল্পী তার কাজটি যতটুকু মায়া, মমতা ও ভালোবাসা নিয়ে করেন, তা যখন আরেকজন ক্রেতা তার নিজেকে বা প্রিয় মানুষটিকে উপহার দেওয়ার জন্য বেছে নেবেন, তখন তিনি যাতে শিল্পকর্মটি হাতে নিয়েই উচ্ছ্বসিত হন, সেজন্যই নামটি মধুমাখা রাখা। ছোট পরিসরে শুরু করলেও এরই মধ্যে এই নতুন উদ্যোগ আমার সমাজে ও চারপাশে বেশ ভালো সাড়া ফেলেছে। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও পাড়ি জমিয়েছে মধুমাখার পণ্য। জাপান, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, চীন, রাশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, ব্রিটেনসহ নানা দেশের শিল্পপ্রেমীরা বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য সংগ্রহের জন্য মধুমাখার আশ্রয় নেন। বিভিন্ন উৎসব, লোকশিল্প ও কারুশিল্প প্রদর্শনীতেও মধুমাখার চাবির রিং, গহনা, ডায়েরি, শাড়ি, ক্যালেন্ডার ইত্যাদি শিল্পপণ্য তাক লাগিয়ে দিয়েছে।

প্রতিটি উৎসব থেকে আমার যে আয় হয়, তার একটি অংশ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যয় করি। এর মধ্যে রয়েছে পথশিশুদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করা এবং ঈদ, রোজা, কিংবা অন্য কোনো বিশেষ দিনে তাদের জন্য ভালো খাবারের আয়োজন করা, বন্যার্তদের সাহায্য করা, এতিমখানা ও বৃদ্ধাশ্রমে অনুদান দেওয়া। তবে আমার ইচ্ছা এই উদ্যোগকে আরো দীর্ঘ ও প্রসারিত করব। এজন্য একটি ওপেন ক্যাফে খোলার মাধ্যমে মধুমাখাকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেব, যেখানে একটি প্রান্তে সমাজের নিম্নবিত্ত বেকারদের কারিগরি শিক্ষা দেওয়া হবে এবং অন্যপ্রান্তে তাদের কাজগুলোর ডিসপ্লে করা হবে। এটি হবে একটি বিক্রয় কেন্দ্র। আবার ক্যাফেতে তারা কাজও করতে পারবে।

উদ্দেশ্য যদি কারো সৎ হয়, সেই লক্ষ্য ধরে যদি পরিশ্রম করে, সেক্ষেত্রে সফলতা আসতে বাধ্য। আমি নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করি, পরিবার খুব সাহায্য করেছে আমাকে। আমার এই উদ্যোগে টাকা বা ব্যবসা করা উদ্দেশ্য ছিল না, উদ্দেশ্য ছিল আমাদের সংস্কৃতিকে তুলে ধরা। তারই ধারাবাহিকতায় দেশীয় পণ্য, যেমন গামছা, খাদি কাপড়, মাটি, পিতল, কাঁসা ও সুই-সুতোর কাজ করেছি, যা একান্তই আমাদের নিজস্ব। এ কাজের জন্য ২০২৩ সালে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির উদ্যোগে মেলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ফেয়ার, চিত্রকর্ম প্রদর্শনী ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মেলায় অংশ নিয়েছি। তারা নিজেরা খুঁজে পেয়ে আমাকে ডেকেছেন। আমার কাজগুলো হাতে তৈরি, অথেনটিক ও আমাদের দেশীয় কাজগুলোকে প্রমোট করেছে।

শহীদ মিনার থেকে শাহবাগের আশেপাশে ঘুরলে দেখা যায়, ৭ থেকে ১০ বছরের ছেলেমেয়েরা ভিক্ষাবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত। তাদের দেখে বিবেক তাড়িত হয়েছে আমারও। ৩০টির মতো স্লেট বোর্ড, বই, খাতা, কলম ও আদর্শলিপি কিনে ছুটে গিয়েছিলাম তাদের কাছে, যাতে তাদের বিনা মূল্যে শিক্ষার ব্যবস্থা করা যায়। টানা ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত তাদের হাতেখড়ি দিয়েছিলাম বন্ধুরা মিলে। বর্ণমালা শিখিয়েছি, ছবি আঁকাও। কীভাবে সমাজে কথা বলতে হয়, চলাফেরা করতে হয়, সত্য কথা বলতে হয়, সৎপথে থাকতে হয়, সেসব শেখাতাম। ছবি আঁকা এদিক থেকে কাজে দিয়েছে যে, ছবির মাধ্যমে মনস্তাত্ত্বিক ভাবনাগুলো ফুটে ওঠে। তাদের মধ্যে ভালো বোধ ও সৎপথে চলার গুণাগুণ শেখাতাম।

প্রতিবারই মানুষকে সাহায্য করার কাজগুলো আমি করি। ফেনীতে বন্যার সময় নিজে গিয়ে কাপড় কিনে দিয়েছি। সবার কাছ থেকেও কালেক্ট করেছি। মুড়ি ও ওষুধের ব্যবস্থা করেছি; সেনিটারি ন্যাপকিনের ব্যবস্থা করেছি। নিজে গিয়েও সংগ্রহ করেছি। ঈদের সময় টাকা দিয়ে সাহায্য করেছি। এমন কাজগুলো সমাজের প্রতিভাবান কজনই বা করেন?

গত বছর রোজায় ৩০ জনকে খাবার দিয়েছি। আজিমপুরের সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানায় প্রায় ১০০ জনকে খাবার দিয়েছি। আমার গ্রাম হলো ময়মনসিংহের গফরগাঁও থানার খুরশিদ মহল। সেখানে গ্রামের মসজিদগুলোয় রোজার সময় ইফতার ও সাহরির ব্যবস্থা করেছি। ঈদের সময় চাল, ডাল, সেমাই ও তেল প্যাকেট করে দিয়েছি। গত রোজার ঈদে ৩০ জনের মতো শিশুর জন্য নতুন ঈদের পোশাক কিনে দিয়েছি। নবজাতক থেকে ১০ বছরের শিশুর জন্য পোশাক ছিল ওখানে। নিজেই নিয়ে গিয়ে দিয়েছি, যাতে তাদের সঙ্গে নিজেকে কানেক্ট করতে পারি। এছাড়া গতবারের ঈদে একটি বৃদ্ধাশ্রমে ১০০ জনের মতো মানুষকে ঈদের খাবার দিয়েছি। সেখানে সেমাই, পোলাও ও রোস্ট ছিল।

আমি প্রথম বিভাগে প্রথম প্রতিবছরই কারুশিল্প বিভাগে। এই কাজগুলো আমার পড়ালেখায় বাধা দেয়নি, বরং উল্টোটা করেছে, নতুন করে বাঁচার জন্য পড়ালেখায় উদ্যম জুগিয়েছে। আরেকটি কথা বলার আছে, আমি যখন এ কাজগুলো করেছি, তখন মনে হতো এগুলো খুব সামান্য। তবে পরে প্রাপ্তিটি টের পেয়েছি। এসব কাজ আমি মধুমাখার লাভ থেকে করেছি। যখন কোনো ক্রেতা মধুমাখার পণ্য হাতে নিয়ে চোখে-মুখে আনন্দ আর মুখে চওড়া হাসি দেন, সেগুলোই আমাকে আরো সামনে এগুনোর প্রেরণা জোগায়। আর অসহায়দের যখন সাহায্য করি, তখন নিজের জন্যই করি। বিনিময়ে আসলে আমি কিছুই চাই না। নিঃস্বার্থভাবেই করি। যতটুকুই সাহায্য করি, প্রতিদানে তার চেয়ে বেশি উচ্ছ্বাস নিয়ে ফিরে আসি। এজন্যই বলি—‘আমি কাজ নিয়ে বাঁচতে চাই, মানুষ নিয়ে বাঁচতে চাই, মানুষের জন্য বাঁচতে চাই।’

বিষয়:

শিল্পী
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত