মানবসেবায় নিবেদিত জীবন

ওমর শাহেদ
প্রকাশ : ২১ মার্চ ২০২৫, ১২: ৩১

মানুষটির বয়স ৭০ থেকে ৮০ বছর। আকারে ছোটখাটো। এই বয়সেও কর্মক্ষম। মানবসেবা করেন। এই কাজগুলো তার শুরু হয়েছিল প্রথম যৌবনে। এই কাজে তাকে উৎসাহিত করেছেন বাবা হায়দার আলী, মা ইছামতী। আর চাচা হাজী হাবিবুল্লাহ ও চাচী মাছুমা খাতুন নি:সন্তান ছিলেন। তারা উৎসাহের পাশাপাশি তাদের সকল সম্পত্তি তাদের নামে উইল করে দিয়েছেন। প্রথম তাদের চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জের সিরকা গ্রামে বয়স্ক ও শিশুদের কোরআন শিক্ষা কার্যক্রম চালু করেন। তবে এজন্য কোথাও থেকে কোনো পয়সা নেন না হাফেজ মাওলানা মুহাম্মাদ ইব্রাহীম। উপজেলার কয়েকটি মসজিদে ইসলামি সম্মেলনের মাধ্যমে বয়স্ক কোরআন শিক্ষা চালু করেন। এই ধারাবাহিকতায় তার উপজেলায় এতিমখানাও প্রতিষ্ঠিত হয়। এখনো কোরআন শিক্ষা কেন্দ্র চালু আছে ফরিদগঞ্জে। এসব ১৯৮৪-৮৫ সালের কথা। পরে জীবিকার প্রয়োজনে তিনি ঢাকা চলে আসেন। দক্ষিণ বাড্ডা মামুনে নূর জামে জামে মসজিদে যোগদান করেন। এখানেও তিনি বয়স্কদের মধ্যে কোরআন শিক্ষা চালু করেন। নিজের উদ্যোগে বধির, হিজড়া, ভাসমান ছিন্নমূল, অন্ধ, বোবা, হিজড়া ও বেদেদের কোরআন শিক্ষা ও তাদের জন্য সেবামূলক কাজ শুরু করেন। তাদের চুল কেটে দেন, গা পরিষ্কার করান এবং গোছল করান। কারওয়ান বাজার হাসিনা মার্কেট, তেজতুরিবাজার, কামরাঙ্গীরচর, এয়ারপোর্টের পেছনে ও বিক্রমপুরে বেদেদের বাসস্থানে তিনি কোরআন শিক্ষার কার্যক্রম শুরু করেন। প্রতি শুক্রবারে ঢাকার জাতীয় স্টেডিয়ামের পূর্ব ও পশ্চিম গেটে, কমলাপুর রেলস্টেশন, সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে অসহায় ও ছিন্নমূলদের মধ্যে কোরআন শিক্ষা ও বাংলা অক্ষর শেখানোর কার্যক্রম পরিচালনা করেন। পেটের ক্ষুধার কারণে এবং জীবনমান অনুন্নত হওয়ায় তাদের ধরে রাখা কষ্টসাধ্য হয়। এই মানুষগুলোর ৯০ ভাগ নবীজির নাম ও কলেমা তৈয়ব পর্যন্ত জানে না। তারা তাদের মা-বাবা ও আত্মীয়স্বজনের নামটি পর্যন্ত বলতে পারে না। তাদের প্রতি দেশ, জাতি ও সমাজ কোনো দায়িত্ব বহন করে বলে তারা বিশ্বাস করে না। তারা ওজু-গোছল করে না, করার প্রয়োজনও বোধ করে না। তাদের পরিধেয় সামান্য প্যান্ট ও একটি শার্ট বাদে আর কোনো বস্ত্র নেই। কেউই পায়ে জুতা পরে না। শতভাগেরই দেশ, জাতি ও ধর্ম সম্পর্কে সঠিক কোনো ধারণা নেই। শতকরা ৯৫ জনই চিকিৎসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। ১০ শতাংশেরই সুন্নতে খতনা করানো হয় না। তাদের পেশা কোনো জিনিস কুড়ানো এবং সুযোগমতো চুরি করা। কোনো কোনো সময় রাজনৈতিক মিছিল ও সমাবেশে তাদের ব্যবহার করা হয়। তাদের বাসস্থান বস্তি, বাস, লঞ্চ টার্মিনাল, হাট, ঘাট, বাজার, মাজার, সরকারি-বেসরকারি ভবনের বারান্দা, ফুটপাত, পরিত্যক্ত বাড়ি, পার্ক প্রভৃতি স্থান। তারা খায় পরিত্যক্ত খাবার, ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া খাবার, হোটেলের উদ্বৃত্ত খাবার ও দান-দক্ষিণা থেকে পাওয়া খাবার। কোনো কোনো সময় তারা নগদ মূল্যে খাবার কেনে। এসব মানুষের জন্য কাজ করেন তিনি।

বিজ্ঞাপন

হাফেজ মাওলানা ইব্রাহীম দক্ষিণ বাড্ডা মামুনে নূর জামে মসজিদ থেকে অসংখ্য শিক্ষিত ও অশিক্ষিত ছেলেকে কোরআন শিক্ষার মাধ্যমে গড়ে তুলেছেন। সেই মহল্লার একজন দানবীর ব্যক্তি মোহাম্মদ ইউসুফ সাহেব তার সঙ্গে বিভিন্ন কোরআন শিক্ষা কেন্দ্র ও অসহায় শেল্টার পয়েন্টে কলা-রুটি নিয়ে গিয়েছেন। তাদের কোরআন শিক্ষা, সুরা-কারাত ও নামাজ শিক্ষা দিয়েছেন। ভালো কাজের উপদেশ দিয়েছেন। রোজার ঈদে তাদের নতুন কাপড় কিনে দিয়েছেন এবং কোরবানিতে মাংস বিলিয়েছেন। পবিত্র কোরআন শিক্ষা নামের তার এই কাজের মাধ্যমে এতিম ছাত্রছাত্রী ও গরিব-দুঃখীদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করেছেন। তেজকুনি পাড়ার পীরমা জামে মসজিদে শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক মানুষকেও কোরআন শিক্ষা দিয়েছেন। বরিশালের উজির আহমেদ কমপ্লেক্সে এতিম ছাত্র, ছাত্রী ও গরিবদের মাঝে শীতবস্ত্র বিলিয়েছেন। দক্ষিণ বাড্ডার শিমুলতলা জামে মসজিদে শীতবস্ত্র বিলিয়েছেন। কারওয়ানবাজারের আম্বরশাহ শাহী মসজিদে ছাত্রছাত্রী ও গরিব মানুষের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করেছেন। জিয়া উদ্যান কেন্দ্রে ছাত্রছাত্রী, বোবা, অন্ধ ও গরিবদের মাঝে শীতবস্ত্র বিলিয়েছেন। বড় মগবাজার হিজড়া কেন্দ্রের ছাত্রছাত্রীদের মাঝে শীতবস্ত্র বিলিয়েছেন। বয়স্ক ভাসমান, দিনমজুর, প্রতিবন্ধীসহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষকে বছরব্যাপী কোরআন শিক্ষা দিয়েছেন। এখনো বিশেষত রমজান মাসে মাসব্যাপী পবিত্র কোরআন শিক্ষা, দোয়া ও ইফতার মাহফিল করেন। আম্বরশাহ শাহী মসজিদে প্রতিদিন প্রায় এক হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ লোকের ইফতার করানো হয় জনগণের সহযোগিতায়। মসজিদ কমিটির অনুমতিক্রমে পবিত্র কোরআন শিক্ষা কার্যক্রমের পরিচালক হাফেজ ইব্রাহীম এসব পরিচালনা করেন। বিজয় দিবস উপলক্ষে পল্টনের রাস্তায় এতিম ছাত্র, ছাত্রী ও গরিবদের মাঝে তিনি শীতবস্ত্র বিতরণ করেন। বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে বোবা ও অন্ধদের শীতবস্ত্র দিয়েছেন তারা। খিলক্ষেত আবুর টেকে ছাত্রছাত্রীদের মাঝে শীতবস্ত্র বিলিয়েছেন। সব শীতে অসহায়ের পাশে থাকেন। তার লক্ষ্য হলো আল কোরআনের ব্যাপক গবেষণা, প্রচার এবং অসহায়, ছিন্নমূল ও ভাসমান লোকদের নিরক্ষরতা দূরীকরণ। সুধীজনের যেকোনো পরামর্শ সাদরে গ্রহণ করেন। তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা অনুযায়ী চাঁদপুরের গ্রামের বাড়ির এক বিঘা জমি এসব মানুষের শিক্ষা, কর্ম ও উন্নয়নের জন্য ওয়াক্‌ফ করে দেবেন। কারওয়ানবাজারের আম্বর শাহ জামে মসজিদে তার পরিচালিত ইফতার আয়োজনে অংশ নিয়েছেন আমার দেশ সম্পাদক ও প্রকাশক মাহমুদুর রহমান। ১৭ মার্চ তিনি প্রধান অতিথি হিসেবে গিয়েছিলেন। খুব খুশি হয়েছেন। ধনী, গরিব, প্রতিবন্ধীতায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে ইফতারে অংশ নিতে পেরে আমি আনন্দিত। প্রতি বছর আমি এখানে আসবÑবলেছেন তিনি।

বিষয়:

কোরআন
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত