শতবর্ষী পিয়ার আলী জামে মসজিদ

হাফেজ মিজানুর রহমান
প্রকাশ : ০৭ নভেম্বর ২০২৫, ১০: ০৪

বাংলাদেশের গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মাওনা ইউনিয়নের কেওয়া পশ্চিমখণ্ড গ্রামে অবস্থিত পিয়ার আলী জামে মসজিদ, শুধু একটি ইবাদতের স্থান নয়; এটি বহন করে চলেছে এক গৌরবময় ইতিহাস ও ঐতিহ্য। ১৯১০ সালে প্রতিষ্ঠিত এই মসজিদটি, স্থানীয়ভাবে যা মাওনা বাজার কেন্দ্রীয় মসজিদ নামেও সুপরিচিত, শতাব্দী পেরিয়ে আজও টিকে আছে এক আলোকবর্তিকা হিসেবে। এটি শুধু ধর্মপ্রাণ মানুষের মিলনক্ষেত্র নয়, বরং অঞ্চলের সামাজিক ও আধ্যাত্মিক জীবনে এর প্রভাব অনস্বীকার্য। এর প্রতিষ্ঠা ও প্রসার এর দানশীল প্রতিষ্ঠাতা পিয়ার আলী মাদবরের মহৎ কর্মের সাক্ষ্য দেয়।

বিজ্ঞাপন

দানবীর পিয়ার আলী মাদবর : এক কিংবদন্তি প্রতিষ্ঠাতা

এই মসজিদের ইতিহাসের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে এলাকার অন্যতম দানবীর ও সমাজসেবক পিয়ার আলী মাদবরের নাম। তিনিই এই মসজিদের জমিদাতা। ১৯১০ সালে তাঁরই উদারতায় ও দূরদর্শিতায় এই বৃহৎ জনকল্যাণমূলক কাজটি সম্পন্ন হয়। ‘মাদবর’ শব্দটি তার সামাজিক প্রতিপত্তি ও নেতৃত্বকেই ইঙ্গিত করে। তাঁর দানশীলতা শুধু মসজিদ প্রতিষ্ঠাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; মাওনা অঞ্চলের শিক্ষা ও জনকল্যাণমূলক কাজেও তাঁর অবদান চিরস্মরণীয়। উদাহরণস্বরূপ, তাঁরই উদারপ্রাণ উত্তরসূরিদের সহযোগিতায় তাঁর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পিয়ার আলী কলেজ (বর্তমানে পিয়ার আলী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ), যা অঞ্চলের শিক্ষাব্যবস্থায় এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। এটি প্রমাণ করে, পিয়ার আলী মাদবরের স্বপ্ন ছিল সুদূরপ্রসারী—ধর্মীয় চেতনার পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষায় সমাজকে আলোকিত করা। তাঁর এই মহানুভবতা আজও তাঁকে শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত রেখেছে।

কেওয়া পশ্চিমখণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু : মাওনা বাজারের কেন্দ্রীয় মসজিদ

পিয়ার আলী জামে মসজিদটি মাওনা ইউনিয়নের কেওয়া পশ্চিমখণ্ডে এমন এক জায়গায় অবস্থিত, যা এখন মাওনা বাজারের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এটি সহজেই মাওনা বাজার কেন্দ্রীয় মসজিদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। মাওনা বাজার হলো শ্রীপুর উপজেলার অন্যতম প্রধান বাণিজ্যিক ও জনসমাগমের স্থান। বাজারের কেন্দ্রস্থলে হওয়ায় মসজিদটি শুধু কেওয়া পশ্চিমখণ্ড বা মাওনা ইউনিয়নের মানুষের জন্যই নয়, বরং বাজারের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা ব্যবসায়ী, পথচারী এবং দূর-দূরান্তের মুসল্লিদের জন্যও ইবাদতের এক গুরুত্বপূর্ণ এবং সুবিধাজনক আশ্রয়স্থল। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, জুমার নামাজ এবং পবিত্র রমজান মাসে তারাবির নামাজ আদায়ের জন্য এই মসজিদে সর্বদাই উপচে পড়া ভিড় লক্ষ করা যায়। এটি প্রমাণ করে যে, মসজিদটি তার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যকে সফলভাবে পূরণ করে চলেছে এবং কেন্দ্রীয় অবস্থানে থাকার কারণে এর জনগুরুত্ব বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে।

সামাজিক ও আধ্যাত্মিক প্রভাব : এক নিরবচ্ছিন্ন ধারা

পিয়ার আলী জামে মসজিদ শুধু নামাজ আদায়ের স্থান নয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এটি এই অঞ্চলের সামাজিক ও আধ্যাত্মিক জীবনের কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে আসছে।

শিক্ষার কেন্দ্র : অতীতে মসজিদগুলো প্রায়ই প্রাথমিক শিক্ষার কেন্দ্র বা মক্তব হিসেবে ব্যবহৃত হতো। পিয়ার আলী জামে মসজিদও তেমনই ভূমিকা পালন করেছে, যেখানে শিশুরা কোরআন শিক্ষা ও প্রাথমিক ধর্মীয় জ্ঞান লাভ করে।

আলোচনা ও পরামর্শের স্থান : ধর্মীয় আলোচনা, ওয়াজ মাহফিল এবং স্থানীয় বিভিন্ন বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার সমাধানে প্রবীণদের বৈঠক—এই মসজিদের মাধ্যমেই অনুষ্ঠিত হয়। এটি ঐক্য ও সংহতির প্রতীক হিসেবে কাজ করে।

প্রতিটি জুমার নামাজ বা ঈদের জামাতে হাজারো মানুষের সমাবেশ এই মসজিদের গুরুত্ব ও আবেদনকে আরো মহিমান্বিত করে তোলে। বর্তমান ইমাম মুফতি রাকিব বিন জালালের নেতৃত্বে মসজিদটি অতীত ও বর্তমানের মধ্যে এক শক্তিশালী সেতুবন্ধ রচনা করেছে, যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম আল্লাহর ইবাদতে একত্র হচ্ছে এবং সামাজিক বন্ধন আরো দৃঢ় হচ্ছে। কালের যাত্রাপথে এই মসজিদ মাওনা অঞ্চলের ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে থাকবে, যা ভবিষ্যতেও মানুষকে ধর্ম, শিক্ষা ও জনকল্যাণের পথে অনুপ্রাণিত করে যাবে।

লেখক : ইমাম, মসজিদ আল-আনাস (রা.) জিজান, সৌদি আরব

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত