আল্লাহ্ তাঁর সৃষ্ট মানবজাতির মধ্য থেকে কিছু ব্যক্তিকে তাঁর বাণী প্রচারের জন্য মনোনীত করেছেন। তাঁরাই হচ্ছেন নবী ও রাসুল। রাসুলদের মর্যাদা নবীদের ওপরে। রাসুলদের মধ্য থেকে পাঁচজনকে সবিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। তাঁদের বলা হয় উলুল আজম (সবরকারী)। ঈসা (আ.) এমন রাসুলদের একজন। কোরআনে এসেছে-যখন আমি নবীদের কাছ থেকে, আপনার কাছ থেকে এবং নূহ, ইব্রাহীম, মুসা ও মরিয়ম-তনয় ঈসার কাছ থেকে অঙ্গীকার নিলাম। তাদের কাছ থেকে সুদৃঢ় অঙ্গীকার নিলাম।’ (সুরা আহজাব : ৭)
আল্লাহ্ আদমকে সৃষ্টি করেছেন বাবা-মা ছাড়া। হাওয়াকে সৃষ্টি করেছেন আদমের পাঁজরের হাড় থেকে। সব আদমসন্তানকে সৃষ্টি করেন বাবা-মায়ের মাধ্যমে। আর নবী ঈসা (আ.)-কে সৃষ্টি করেছেন শুধু মায়ের মাধ্যমে। তাঁর মা হচ্ছেন মারিয়াম (আ.)। একজন সতী-সাধ্বী ও পূত-পবিত্র নারী। কোরআনে কারিমে তাঁকে মুমিনদের আদর্শ হিসেবে পেশ করা হয়েছে। আল্লাহ্ তায়ালা বলেন, ‘আর উপমা পেশ করেছেন মরিয়ম বিনতে ইমরানের; যিনি তাঁর লজ্জাস্থানকে হেফাজত করেছেন। আমি এর মধ্যে আমার রুহ থেকে ফুঁকে দিলাম। তিনি ছিলেন তার প্রতিপালকের বাণী ও কিতাবগুলোর প্রতি বিশ্বাসী। তিনি ছিলেন ইবাদতগুজারদের দলভুক্ত।’ (সুরা তাহরিম : ৬৬)। সম্মানার্থে আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর সৃষ্টি এ রুহকে নিজের দিকে সম্বোধিত করে ‘আমার রুহ’ বলেছেন।
আল্লাহ্ তাঁর এ মহান নবীর জন্মদাত্রী হিসেবে এ মহীয়সী নারীকে মনোনীত করেন। বাবার মাধ্যম ব্যতীত শুধু মায়ের মাধ্যমে এ নবীকে দুনিয়াতে পাঠাতে চান তাঁর মহান ক্ষমতা ও কুদরত দেখানোর জন্য। সে প্রসঙ্গে কোরআন বলছে-(স্মরণ করো) যখন ফেরেশতারা বললেন, ‘হে মারিয়াম! নিশ্চয় আল্লাহ নিজের পক্ষ থেকে তোমাকে একটি কালেমা (দ্বারা সৃষ্ট সন্তানে)-এর সুসংবাদ দিচ্ছেন, যার নাম হবে মসিহ, ঈসা বিন মারিয়াম। তিনি হবেন ইহকাল ও পরকালে সম্মানিত এবং নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দাদের অন্যতম। তিনি দোলনায় থাকা অবস্থায় ও পরিণত বয়সে মানুষের সঙ্গে কথা বলবেন এবং তিনি হবেন পুণ্যবানদের একজন।’ তিনি বললেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! কেমন করে আমার সন্তান হবে? অথচ কোনো পুরুষ আমাকে স্পর্শ করেননি।’ তিনি (আল্লাহ) বললেন, “এভাবেই আল্লাহ যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। তিনি যখন কিছু (সৃষ্টি) করার সিদ্ধান্ত নেন তখন বলেন, ‘কুন’ (হও), আর তখনই তা হয়ে যায়।” (সুরা আলে ইমরান : ৪৫-৪৭)
তাঁর অলৌকিক এ জন্মগ্রহণে যখন সমাজের লোকেরা মধ্যে তাঁর মায়ের প্রতি অপবাদ আরোপের উপক্রম হলো, তখন আল্লাহ্ নবজাতক শিশুর মুখে ভাষা ফুটিয়ে দিলেন। ওই শিশু নিজ মায়ের পবিত্রতা ঘোষণা করলেন। এভাবে আল্লাহ্ তায়ালা মোজেজার মাধ্যমে তাঁর মায়ের পবিত্রতা সাব্যস্ত করলেন। আল্লাহ্ তায়ালা বলেন, ‘হে হারুন-ভাগিনী, তোমার বাবা অসৎ ব্যক্তি ছিলেন না এবং তোমার মাও ব্যভিচারিণী ছিলেন না।’ তখন তিনি হাত দিয়ে সন্তানের দিকে ইশারা করলেন। তাঁরা বললেন, ‘আমরা কোলের শিশুর সঙ্গে কীভাবে কথা বলব?’ সন্তান বললেন, ‘আমি আল্লাহর বান্দা। তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন এবং আমাকে নবী বানিয়েছেন।’ (সুরা মারিয়াম: ২৮-৩০)। এ নবজাতক শিশুর সর্বপ্রথম বক্তব্য ছিল-‘আমি আল্লাহ্র বান্দা।’ এর দ্বারা আল্লাহ্র পুত্র হওয়ার দাবিকে নাকচ করে দেওয়া হয়।
তদুপরি ইহুদি ও খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীরা ঈসা (আ.)-এর এ ব্যাপারে মতভেদ করে। তাদের মধ্যে কেউ বলে, ‘তিনি আল্লাহ্র সন্তান।’ কেউ বলে, ‘তিনি তিনজনের তৃতীয় জন।’ কেউ বলে, ‘তিনিই আল্লাহ্।’ কেউ বলে, ‘তিনি আল্লাহ্র বান্দা ও রাসুল।’ তাদের শেষোক্ত অভিমতটিই সঠিক। কোরআন এটাকে সাব্যস্ত করেছে। আল্লাহ্ তায়ালা বলেন, “এই হলো মারিয়াম-তনয় ঈসা (এর বৃত্তান্ত)। (আমি বললাম) সত্য কথা; যে বিষয়ে তারা মতভেদ করছে। সন্তান গ্রহণ করা আল্লাহর জন্য সমীচীন নয়। তিনি পবিত্র হোন। তিনি যখন কিছু সৃষ্টি করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন বলেন, ‘কুন’ (হও); তখন তা হয়ে যায়। নিশ্চয় আল্লাহ আমার প্রতিপালক ও তোমাদের প্রতিপালক। সুতরাং তোমরা তাঁর উপাসনা করো। এটাই হলো সরল পথ। অতঃপর তাদের দলগুলো নিজেদের মধ্যে মতানৈক্য করল। সুতরাং মহাদিবস আগমনকালে কাফেরদের জন্য রয়েছে শাস্তি।” (সুরা মারিয়াম : ৩৪-৩৭)
আল্লাহ্ তায়ালা আরো বলেন, “তারা বলে, ‘রহমান’ সন্তান গ্রহণ করেছেন! তোমরা তো এক জঘন্য কথার অবতারণা করেছ। এ কথার কারণে আকাশমণ্ডলী যেন চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে, পৃথিবী যেন ফেটে যাবে এবং পর্বতগুলো যেন ধসে পড়বে। যেহেতু তারা ‘রহমান’-এর প্রতি সন্তান আরোপ করেছে। অথচ ‘রহমান’-এর জন্য সন্তান গ্রহণ করা সমীচীন নয়। আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে এমন কেউ নেই, যে রহমানের কাছে দাস হিসেবে উপস্থিত হবে না।” (সুরা মারিয়াম : ৮৮-৯৩)
আল্লাহ্ তায়ালা ঈসা (আ.)-এর ওপর ইঞ্জিল কিতাব নাজিল করেছেন। তাঁকে অনন্য কিছু মোজেজা দান করেছেন। তিনি মাটি দিয়ে পাখির আকৃতি বানিয়ে সেটাতে ফুঁ দিলে পাখি হয়ে যেত। তিনি জন্মান্ধকে সুস্থ করতে পারতেন। কুষ্ঠ রোগীকে ভালো করতে পারতেন। মৃত মানুষকে আল্লাহ্র ইচ্ছায় জীবিত করতে পারতেন। কেউ তার ঘরে কী খেয়েছে এবং পরে খাওয়ার জন্য কী সংরক্ষিত রেখেছে, সে সম্পর্কে অবহিত করতে পারতেন। এ সম্পর্কে সুরা আলে ইমরানে বিস্তারিত বর্ণনা এসেছে।
এ মোজেজাগুলো দিয়ে তিনি মানুষকে এক আল্লাহ্র ইবাদতের দিকে আহ্বান করেছেন। আল্লাহ্র সঙ্গে কাউকে অংশীদার সাব্যস্ত করা থেকে বারণ করেছেন। তিনি তার উম্মতকে নিজের উপাসনা করা কিংবা তার মা মারিয়াম (আ.)-এর উপাসনার দিকে আহ্বান করেননি। সে প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তায়ালা বলেন, ‘যখন আল্লাহ বললেন-হে ঈসা ইবনে মরিয়ম! তুমি কি লোকদের বলেছ যে, আল্লাহকে ছেড়ে আমাকে ও আমার মাকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করো? ঈসা বলবেন, আপনি পবিত্র হোন! যা বলার কোনো অধিকার আমার নেই তা আমি কীভাবে বলি? যদি আমি বলতাম, তবে তো আপনি অবশ্যই সেটা জানতেন। আমার মনে কী আছে তা আপনি জানেন, আপনার মনে কী আছে তা আমি জানি না। নিশ্চয় আপনিই গায়েবি বিষয়ে জ্ঞানবান।’ (সুরা মায়িদা : ১১৬)
তার উম্মতের একদল পথভ্রষ্ট তাঁকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিলে আল্লাহ্ তাঁকে তাদের থেকে আড়াল করে আসমানে উঠিয়ে নিয়ে যান। কেউ তাকে শূলে চড়াতে সক্ষম হয়নি। কিয়ামতের আগে তিনি শেষ নবীর উম্মত হিসেবে বায়তুল মোকাদ্দাসে নাজিল হবেন।
তিনি তাঁর পূর্ববর্তী নবীগণ ও কিতাবসমূহকে সত্যায়ন করেছেন এবং শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর আগমনের সুসংবাদ বার্তা দিয়ে গেছেন। সে সম্পর্কে কোরআন বলে, ‘স্মরণ করুন, যখন মরিয়ম-তনয় ঈসা বললেন, ‘হে বনী ইসরাইল! আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর প্রেরিত রাসুল, আমার পূর্ববর্তী তওরাতের সত্যায়নকারী এবং আমি এমন একজন রাসুলের সুসংবাদদাতা, যিনি আমার পরে আগমন করবেন। তাঁর নাম আহমদ। অতঃপর যখন তিনি সুস্পষ্ট প্রমাণাদি নিয়ে আগমন করলেন, তখন তারা বলল, এ তো এক প্রকাশ্য জাদু।’ (সুরা সফ্ফ : ৬)
তাই ইঞ্জিলের অনুসারীদের উচিত তাদের নবীর এ সুসংবাদকে বিশ্বাস করে আখেরি নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপরও ঈমান আনা ও তাঁর শরিয়তকে মেনে চলা। যেমনিভাবে মুসলমানরা সব নবীর প্রতি ঈমান আনে। মুসলমানদের ঈমানের অপরিহার্য রুকন বা স্তম্ভ হচ্ছে, সব রাসুলের প্রতি সমানভাবে ঈমান আনা। আল্লাহ্ই তাওফিকদাতা।
লেখক : এমফিল গবেষক, কিং সউদ বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদি আরব
আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

