অন্যায়ের ব্যাপারে ইসলাম যেমন আপসহীন, তেমনি অপরাধীর শাস্তি বাস্তবায়নেও প্রতিশ্রুতিশীল। আল্লাহর আদালতে সবাই সমান। ইসলাম পদ-পদবি, বংশ-মর্যাদা, বিত্তবৈভব দিয়ে কাউকে বিচার করে না। অপরাধ প্রমাণিত হলে অপরাধী যেই হোক, সাজা অবশ্যই প্রযোজ্য। হোক সে রাজা বা প্রজা, নারী বা পুরুষ, ধনী বা গরিব, উচ্চ বংশের বা নিচু বংশের। এমনকি একজন রাষ্ট্রপ্রধানও যদি অতি সাধারণ কাউকে হত্যা করে, তাহলে তার থেকেও কিসাস নেওয়া হবে। অপরাধীর একটিই পরিচয়-সে অপরাধী।
জাহেলি যুগে, জাত-বংশ, ধর্ম বা শ্রেণি-বৈষম্যের কারণে দুর্বলরা সর্বদা অন্যায়ের শিকার হতো। কিসাসের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। উঁচু শ্রেণির কেউ অন্যায় করলে তাকে ছেড়ে দেওয়া হতো আর নিম্নশ্রেণির কেউ তা করলে তার ওপর কঠিনভাবে শাস্তি প্রয়োগ করা হতো। উঁচু বংশের বা ধনী কৃতদাসের অপরাধে দুর্বল ব্যক্তি থেকে বদলা নেওয়া হতো। একজনের জন্য একাধিক জীবন বিনিময় করা হতো।
কিন্তু আল-কোরআন এই জুলুমের প্রথাকে চিরতরে বিলুপ্ত করে দিয়ে ঘোষণা করেছে-কিসাস শুধু অপরাধীর কাছ থেকেই গ্রহণযোগ্য, অন্য নিরপরাধীর জীবনকে বিনিময় বানানো যাবে না। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনরা! যাদের (ইচ্ছাকৃত অন্যায়ভাবে) হত্যা করা হয়েছে, তাদের ব্যাপারে তোমাদের প্রতি কিসাসের বিধান ফরজ করা হয়েছে। স্বাধীন ব্যক্তির বদলে স্বাধীন ব্যক্তি, গোলামের বদলে গোলাম, নারীর বদলে নারীকেই হত্যা করা হবে।’ (সুরা বাকারা : ১৭৮)
রাসুলুল্লাহ (সা.) এই নীতিকে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন। বনু মাখজুম গোত্রের এক প্রভাবশালী নারী চুরির অপরাধে গ্রেপ্তার হলে কিছু সাহাবি সুপারিশ করতে চেয়েছিলেন-কারণ গোত্রটি ছিল অত্যন্ত সম্মানিত ও অভিজাত। তখন নবীজি (সা.) দৃঢ়ভাবে বলেছিলেন, ‘তোমাদের পূর্ববর্তীরা যে কারণে ধ্বংস হয়েছেÑতারা অভিজাত কেউ চুরি করলে তাকে ছেড়ে দিত আর দুর্বল কেউ চুরি করলে তার ওপর হদ (চুরির শাস্তি) প্রয়োগ করতো। আল্লাহর কসম, মুহাম্মদের কন্যা ফাতিমা যদি চুরি করত, আমি তার হাতও কেটে দিতাম।’ (বুখারি : ৩৪৭৫)
ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে- উমর (রা.)-এর ছেলে আবদুর রহমান আবু শাহমা মিসরের সেনাবাহিনীতে যুদ্ধরত ছিলেন। এক দিন তিনি নাবিজ বা খেজুর ভিজিয়ে তৈরি করা ‘শরবত’ পান করেন। কিন্তু এ খেজুরের শরবতে মাদকতা এসে গিয়েছিল, ফলে আবু শাহমার মধ্যে মাতলামি আসে। তিনি মিসরের প্রশাসক আমর ইবনুল আস (রা.)-এর কাছে গিয়ে বলেন, ‘আমি মাদকদ্রব্য পান করেছি, কাজেই আমাকে আপনি শরিয়াহ আইন অনুযায়ী মাদক পানের নির্ধারিত শাস্তি (বেত্রাঘাত) প্রদান করুন। আমর (রা.) তাকে গৃহাভ্যন্তরে বেত্রাঘাত করেন। উমর (রা.) তা জানতে পেরে আমরকে (রা.) তিরস্কার করে বলেন, সাধারণ মুসলিম নাগরিককে যেভাবে জনসমক্ষে শাস্তি দেওয়া হয়, আমার ছেলেকেও সেভাবে শাস্তি দেওয়া উচিত ছিল। তারপর আবু শাহমা মদিনা ফিরে গেলে তিনি নিজে আবার তাকে শাস্তি দেন। এর কিছুদিন পর আবু শাহমা ইন্তেকাল করেন। (আল-ইসাবা : ৪৩৮-৪৪৩)
উপরোক্ত দুই ঘটনা থেকে এ কথা দিবালোকের মতো স্পষ্ট-ইসলামি আইনে ক্ষমতা, বংশ ও পদমর্যাদা কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না। অপরাধী সে যেই হোক, শাস্তি তার প্রাপ্য।
পবিত্র আল-কোরআনে আল্লাহতায়ালা অপরাধের শাস্তি প্রদানে শৈথিল্য-অনুকম্পা নিষিদ্ধ করে বলেন, ‘তোমরা যদি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী হও, তবে আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠায় যেন তোমাদের মনে কোনো ধরনের অনুকম্পা না জাগে।’ (সুরা আন-নুর : ২) অর্থাৎ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আবেগ, গোষ্ঠী বা দলপ্রীতি কিংবা সম্পর্কের কোনো আনুকূল্যের সুযোগ নেই।
ইসলাম শুধু শাস্তি প্রয়োগে কঠোরতার কথা বলে না; বরং মানবজীবনের মর্যাদা রক্ষাকে সর্বোচ্চ স্তরে তুলে ধরে। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘কেউ যদি হত্যা অথবা পৃথিবীতে ফ্যাসাদ সৃষ্টির অপরাধ ছাড়া কাউকে হত্যা করে, তবে সে যেন পুরো মানবজাতিকে হত্যা করল।’ (সুরা মায়েদা : ৩২)
কোরআনে অন্যায় হত্যার শাস্তিস্বরূপ কিসাসের বিধান আরোপ করা হয়েছে। কিসাস হলো-জখমের বদলায় অনুরূপ জখম এবং হত্যার বদলায় হত্যা। কোনো ব্যক্তি যদি অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করে, তাহলে কিসাসের বিধান হিসেবে এ অপরাধের কারণে তাকেও হত্যা করা হবে। এটি আল-কোরআনের সুস্পষ্ট বিধান। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘হে মুমিনরা! যাদের (ইচ্ছাকৃত ও অন্যায়ভাবে) হত্যা করা হয়েছে, তাদের ব্যাপারে তোমাদের প্রতি কিসাস(-এর বিধান) ফরজ করা হয়েছে। স্বাধীন ব্যক্তির বদলে স্বাধীন ব্যক্তি, গোলামের বদলে গোলাম, নারীর বদলে নারী (হত্যা করা হবে)।’ (সুরা বাকারা : ১৭৮)
কোনো ব্যক্তি যদি অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করে এবং নিহতের পরিবার কিসাস দাবি করে, তাহলে কিসাসই তার একমাত্র শাস্তি, অন্যকিছু নয়। এ ক্ষেত্রে মুসলিম বিচারকের কর্তব্য-কোরআনের বিধান অনুযায়ী কিসাস কার্যকর করা। এ ক্ষেত্রে অন্য কোনো শাস্তি যেমন যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, আমৃত্যু কারাদণ্ড ইত্যাদি শাস্তি প্রদানের কোনো এখতিয়ারই তার নেই। কেননা আল্লাহতায়ালা কিসাসের বিধানকেই ফরজ করেছেন এবং কিসাসের বিধান বর্ণনা করার পর আল্লাহতায়ালা সুস্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন, ‘আর যারা আল্লাহর নাজিলকৃত বিধান অনুসারে বিচার করে না, তারা জালেম।’ (সুরা মায়েদা : ৪৫)
ইসলামি আইনের মূল ভিত্তি হলো-ইনসাফ বা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, অপরাধ দমন এবং মজলুমকে সুরক্ষা দেওয়া। সুতরাং, যখন একজন স্বৈরাচারী বহু মানুষের রক্তের দায় বহন করে, তখন দ্রুত তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা রাষ্ট্রের ওপর কর্তব্য হয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে খুনিকে রেহাই দেওয়া কিংবা রাষ্ট্রীয় প্রটোকলে নিরাপত্তা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বরং তার উপযুক্ত বিচার কার্যকর করা রাষ্ট্রের আইনি, নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব। অন্যথায় কোরআনের ঘোষণা অনুযায়ী-স্বৈরাচার খুনির দোসররাও হবে জালিমদের কাতারে শামিল।
লেখক : সিনিয়র শিক্ষক, জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা, ঢাকা

