কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা
মাহমিয়া আলম শান্তা
আমরা এমন এক যুগে এসে পৌঁছেছি, যেখানে তথ্য পাওয়া যেমন সহজ হয়েছে, তেমনি বিভ্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। প্রযুক্তির আশীর্বাদ যে কতখানি সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিতে পারে, তা যেমন অস্বীকার করার নয়, তেমনি এই প্রযুক্তিরই অপব্যবহার বা অপবিন্যাস যখন ঈমানি বিষয়গুলোর মধ্যে অনুপ্রবেশ ঘটায়, তখন তা আর নিছক প্রযুক্তি থাকে না—পরিণত হয় এক চুপিসারে ঘিরে ফেলা ফিতনায়।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই এখন আর কোনো কল্পবিজ্ঞানের বিষয় নয়। এটি আমাদের প্রতিদিনের জীবনের অঙ্গ—কখনো মোবাইল অ্যাপে, কখনো খবরে, কখনো সোশ্যাল মিডিয়ায়, আবার কখনো আমাদের পড়াশোনার টেবিলেও।
প্রাথমিকভাবে মানুষ এটি গ্রহণ করেছে একটি স্মার্ট প্রযুক্তি হিসেবে, যা কাজের গতি বাড়ায়, বিশ্লেষণে সহায়তা করে এবং প্রশ্নের উত্তর মুহূর্তেই হাজির করতে পারে। কিন্তু ধর্মীয় জ্ঞানের মতো সূক্ষ্ম, দ্বীননির্ভর ও আমানতপূর্ণ বিষয়ে যখন এই প্রযুক্তি আধিপত্য বিস্তার করে, তখন প্রশ্ন জাগে—আমরা কি ভুল পথে হাঁটছি?
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, উন্নত এআই মডেলগুলো শুধু তথ্য বিশ্লেষণ করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না, বরং কিছু ক্ষেত্রে মিথ্যা বলছে, ছলচাতুরী করছে, এমনকি ব্যবহারকারীকে হুমকি পর্যন্ত দিচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০২৫ সালে ফ্রান্স২৪-এর এক প্রতিবেদনে জানা যায়, অ্যানথ্রোপিক-এর ক্লড ৩.৫ মডেল একটি পরীক্ষায় বন্ধ করে দেওয়ার হুমকির মুখে একজন প্রকৌশলীকে ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস করার হুমকি দিয়েছিল (ফ্রান্স২৪, ২০২৫, ‘এআই মিথ্যা বলতে, প্রতারণা করতে এবং স্রষ্টাদের হুমকি দিতে শিখছে’)। এমন ঘটনা নিছক ‘প্রযুক্তিগত গন্ডগোল’ নয়, এটি একটি নৈতিক বিপর্যয়ের লক্ষণ। প্রযুক্তি যখন নিজেই প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ করে, তখন এর ওপর নির্ভরতা শুধু বোকামিই নয়, বরং ঈমান ও আমানতের খেলাফ।
আমাদের সমাজে একটি গভীর পরিবর্তন ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে—নতুন প্রজন্মের বড় একটি অংশ আজ আলেমদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ঈমানি জিজ্ঞাসা, শরিয়াহ-সংক্রান্ত তথ্য, এমনকি ইসলামের মৌলিক বিধিবিধান সম্পর্কেও তারা আলেম বা বিশ্বস্ত ইসলামি গ্রন্থ না দেখে সরাসরি ভরসা করছে এআই-ভিত্তিক চ্যাটবট বা সার্চ ইঞ্জিনের ওপর। এটা নিছক সময় বাঁচানোর কৌশল নয়, বরং একপ্রকার গভীর দাওয়াতি ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি।
যেমন, ২০২৪ সালে প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ওপেনএআই-এর চ্যাটজিপিটি মাঝে মাঝে ধর্মীয় বিষয়ে ভুল তথ্য প্রদান করে। এই ভুল তথ্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে এবং বাংলাদেশের আলেমরা সতর্কতা জারি করে সহিহ উৎস থেকে তথ্য গ্রহণের পরামর্শ দেন। এ ধরনের ঘটনা দেখিয়ে দেয়—এআই যদি একটি মৌলিক ইসলামি বিধান নিয়ে এমন ভুল করে এবং সেটি যদি অসচেতন ব্যবহারকারীদের কাছে ‘বুদ্ধিমত্তার ফতোয়া’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়, তবে সমাজে কী ধরনের ধর্মীয় বিভ্রান্তি ছড়াতে পারে, তা সহজেই অনুমান করা যায়।
এআই-এর অন্যতম সমস্যার একটি হলো এর ‘ব্ল্যাক বক্স’ প্রকৃতি। অর্থাৎ একটি এআই মডেল কীভাবে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাল, সেই প্রক্রিয়া অনেক ক্ষেত্রেই বোধগম্য নয়। এমআইটি টেকনোলজি রিভিউ ২০২৪-এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এআই-এর অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া, যাকে ‘ব্ল্যাক বক্স’ বলা হয়, সেটি এখনো গবেষকদের কাছে পুরোপুরি স্বচ্ছ নয়। ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে জ্ঞানের এই অস্বচ্ছতা বড় ধরনের বিপদ। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘জিজ্ঞাসা করো জ্ঞানীদের, যদি তোমরা না জান।’ (সুরা নাহল : ১৬:৪৩)। কিন্তু এআই তো কোনো আলেম নয়, বরং এটি একটি প্রোগ্রাম, যার পেছনে কাজ করে হাজারো লাইন কোড, বহু ধরনের উৎস, যার মধ্যে রয়েছে সহিহ ভুল ও সত্য-মিথ্যার সংমিশ্রণ। এমন এক অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ার কাছ থেকে ইসলামি জ্ঞানের আশা কি গ্রহণযোগ্য?
আরো উদ্বেগের বিষয় হলো, এআই এখন শুধু তথ্য দিচ্ছে না, বরং নিজের পক্ষেও মিথ্যা বলছে। যেমন, ওপেনএআই-এর প্রথম মডেল একটি পরীক্ষায় নিজের কোড বাইরের সার্ভারে স্থানান্তর করার চেষ্টা করেছিল এবং ধরা পড়লে তা অস্বীকার করে (ফ্রান্স২৪, ২০২৫, ‘এআই মিথ্যা বলতে, প্রতারণা করতে এবং স্রষ্টাদের হুমকি দিতে শিখছে’)।
এ ধরনের প্রতারণামূলক আচরণ ইসলামি দৃষ্টিতে স্পষ্টভাবে হারাম এবং ফাসেকের আচরণের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ! যদি কোনো ফাসেক সংবাদ নিয়ে আসে, তবে যাচাই করে নাও।’ (সুরা হুজুরাত : ৪৯:৬)। তাহলে প্রযুক্তির এই ফাসেক রূপকে যাচাই না করেই ঈমানি বিষয়ে আমানত অর্পণ করা কতখানি নিরাপদ?
এখানে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন উঠে আসে—এত কথা বলার পরও কেন আমাদের তরুণ প্রজন্ম এআই-নির্ভর হয়ে পড়ছে? উত্তর সহজ—তারা জ্ঞান চায়, কিন্তু ধৈর্য ধরতে চায় না। তারা উত্তর চায়, কিন্তু ব্যাখ্যার ভার নিতে চায় না। তারা ফতোয়া চায়, কিন্তু আলেমের দরজায় যেতে চায় না।
এই মানসিকতা একটি আত্মিক দূরত্ব তৈরি করছে। আলেমদের থেকে নয়, বরং যান্ত্রিক প্রোগ্রামের কাছ থেকে যখন কেউ দ্বীনের জ্ঞান নিতে চায়, তখন সে ‘ইলম’-এর বদলে কেবল ‘তথ্য’ নিচ্ছে—যার ভেতরে নেই খুশু, নেই তাকওয়া, নেই আমানত। এমন এক যান্ত্রিক ফতোয়ার সংস্কৃতি যদি বিস্তার লাভ করে, তবে একদিন ইসলাম আমাদের মাঝেই থাকবে; কিন্তু এর ব্যাখ্যা থাকবে কোডের ভেতর—আত্মা ও আদর্শহীন অবস্থায়।
ইসলাম কোনো প্রযুক্তির বিরোধিতা করে না; বরং যে প্রযুক্তি ঈমান, জ্ঞান ও দাওয়াহর খেদমতে ব্যবহৃত হয়, ইসলাম তাকে স্বাগত জানায়। কিন্তু প্রযুক্তি যদি নিজেই ফিতনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তখন সেটিকে সীমার মধ্যে রাখাই ফরজ। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তিনি তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন যা কিছু পৃথিবীতে আছে।’ (সুরা বাকারা : ২:২৯)। অর্থাৎ সৃষ্ট জগৎ ব্যবহারের স্বাধীনতা আছে, কিন্তু নৈতিকতা ও নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে।
এআই ব্যবহার করা যেতে পারে—সহিহ হাদিসের গবেষণায়, আরবি ব্যাকরণ শেখায়, ইসলামি গ্রন্থের সহজ ব্যাখ্যা উপলব্ধিতে; কিন্তু এর সবই হতে হবে আলেমদের তত্ত্বাবধানে, নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্রের ভিত্তিতে। সৌদি আরবের কিং সৌদ ইউনিভার্সিটি ইসলামি মূল্যবোধভিত্তিক এআই প্রকল্পে কাজ করছে, যেখানে শুধু সহিহ কোরআন ও হাদিসের তথ্য ব্যবহার করা হচ্ছে। বাংলাদেশেও এমন উদ্যোগ দরকার, যেখানে মাদরাসা শিক্ষা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা একত্রে কাজ করে প্রযুক্তির ইসলামি বিকল্প তৈরি করবেন।
এআই এই যুগের এক অভূতপূর্ব পরীক্ষা। এটি যেমন কল্যাণ বয়ে আনতে পারে, তেমনি এটি বিভ্রান্তির দ্বার খুলে দিতে পারে। ইসলামি জ্ঞানের মতো স্পর্শকাতর বিষয় যদি একটি অস্বচ্ছ, কখনো মিথ্যাবাদী, কখনো বিভ্রান্তিকর অ্যালগরিদমের ওপর নির্ভর করে, তবে আমরা এক চরম ফিতনার মধ্যে পা রাখছি। এই ফিতনা শুধু প্রযুক্তির নয়, বরং আত্মার, বিশ্বাসের ও আমানতের।
আমরা যেন কেবল প্রযুক্তির গতি নিয়ে না মেতে উঠি, বরং আত্মার পরিশুদ্ধি ও আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুলের মধ্য দিয়ে সঠিক জ্ঞান অর্জনের পথ খুঁজি। আল্লাহ তায়ালা আমাদের এই যুগের চটকদার ফিতনা থেকে হেফাজত করুন এবং সত্য পথের ওপর অটল রাখুন। আমিন।
লেখক : শিক্ষার্থী, তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আমরা এমন এক যুগে এসে পৌঁছেছি, যেখানে তথ্য পাওয়া যেমন সহজ হয়েছে, তেমনি বিভ্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। প্রযুক্তির আশীর্বাদ যে কতখানি সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিতে পারে, তা যেমন অস্বীকার করার নয়, তেমনি এই প্রযুক্তিরই অপব্যবহার বা অপবিন্যাস যখন ঈমানি বিষয়গুলোর মধ্যে অনুপ্রবেশ ঘটায়, তখন তা আর নিছক প্রযুক্তি থাকে না—পরিণত হয় এক চুপিসারে ঘিরে ফেলা ফিতনায়।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই এখন আর কোনো কল্পবিজ্ঞানের বিষয় নয়। এটি আমাদের প্রতিদিনের জীবনের অঙ্গ—কখনো মোবাইল অ্যাপে, কখনো খবরে, কখনো সোশ্যাল মিডিয়ায়, আবার কখনো আমাদের পড়াশোনার টেবিলেও।
প্রাথমিকভাবে মানুষ এটি গ্রহণ করেছে একটি স্মার্ট প্রযুক্তি হিসেবে, যা কাজের গতি বাড়ায়, বিশ্লেষণে সহায়তা করে এবং প্রশ্নের উত্তর মুহূর্তেই হাজির করতে পারে। কিন্তু ধর্মীয় জ্ঞানের মতো সূক্ষ্ম, দ্বীননির্ভর ও আমানতপূর্ণ বিষয়ে যখন এই প্রযুক্তি আধিপত্য বিস্তার করে, তখন প্রশ্ন জাগে—আমরা কি ভুল পথে হাঁটছি?
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, উন্নত এআই মডেলগুলো শুধু তথ্য বিশ্লেষণ করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না, বরং কিছু ক্ষেত্রে মিথ্যা বলছে, ছলচাতুরী করছে, এমনকি ব্যবহারকারীকে হুমকি পর্যন্ত দিচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০২৫ সালে ফ্রান্স২৪-এর এক প্রতিবেদনে জানা যায়, অ্যানথ্রোপিক-এর ক্লড ৩.৫ মডেল একটি পরীক্ষায় বন্ধ করে দেওয়ার হুমকির মুখে একজন প্রকৌশলীকে ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস করার হুমকি দিয়েছিল (ফ্রান্স২৪, ২০২৫, ‘এআই মিথ্যা বলতে, প্রতারণা করতে এবং স্রষ্টাদের হুমকি দিতে শিখছে’)। এমন ঘটনা নিছক ‘প্রযুক্তিগত গন্ডগোল’ নয়, এটি একটি নৈতিক বিপর্যয়ের লক্ষণ। প্রযুক্তি যখন নিজেই প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ করে, তখন এর ওপর নির্ভরতা শুধু বোকামিই নয়, বরং ঈমান ও আমানতের খেলাফ।
আমাদের সমাজে একটি গভীর পরিবর্তন ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে—নতুন প্রজন্মের বড় একটি অংশ আজ আলেমদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ঈমানি জিজ্ঞাসা, শরিয়াহ-সংক্রান্ত তথ্য, এমনকি ইসলামের মৌলিক বিধিবিধান সম্পর্কেও তারা আলেম বা বিশ্বস্ত ইসলামি গ্রন্থ না দেখে সরাসরি ভরসা করছে এআই-ভিত্তিক চ্যাটবট বা সার্চ ইঞ্জিনের ওপর। এটা নিছক সময় বাঁচানোর কৌশল নয়, বরং একপ্রকার গভীর দাওয়াতি ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি।
যেমন, ২০২৪ সালে প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ওপেনএআই-এর চ্যাটজিপিটি মাঝে মাঝে ধর্মীয় বিষয়ে ভুল তথ্য প্রদান করে। এই ভুল তথ্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে এবং বাংলাদেশের আলেমরা সতর্কতা জারি করে সহিহ উৎস থেকে তথ্য গ্রহণের পরামর্শ দেন। এ ধরনের ঘটনা দেখিয়ে দেয়—এআই যদি একটি মৌলিক ইসলামি বিধান নিয়ে এমন ভুল করে এবং সেটি যদি অসচেতন ব্যবহারকারীদের কাছে ‘বুদ্ধিমত্তার ফতোয়া’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়, তবে সমাজে কী ধরনের ধর্মীয় বিভ্রান্তি ছড়াতে পারে, তা সহজেই অনুমান করা যায়।
এআই-এর অন্যতম সমস্যার একটি হলো এর ‘ব্ল্যাক বক্স’ প্রকৃতি। অর্থাৎ একটি এআই মডেল কীভাবে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাল, সেই প্রক্রিয়া অনেক ক্ষেত্রেই বোধগম্য নয়। এমআইটি টেকনোলজি রিভিউ ২০২৪-এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এআই-এর অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া, যাকে ‘ব্ল্যাক বক্স’ বলা হয়, সেটি এখনো গবেষকদের কাছে পুরোপুরি স্বচ্ছ নয়। ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে জ্ঞানের এই অস্বচ্ছতা বড় ধরনের বিপদ। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘জিজ্ঞাসা করো জ্ঞানীদের, যদি তোমরা না জান।’ (সুরা নাহল : ১৬:৪৩)। কিন্তু এআই তো কোনো আলেম নয়, বরং এটি একটি প্রোগ্রাম, যার পেছনে কাজ করে হাজারো লাইন কোড, বহু ধরনের উৎস, যার মধ্যে রয়েছে সহিহ ভুল ও সত্য-মিথ্যার সংমিশ্রণ। এমন এক অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ার কাছ থেকে ইসলামি জ্ঞানের আশা কি গ্রহণযোগ্য?
আরো উদ্বেগের বিষয় হলো, এআই এখন শুধু তথ্য দিচ্ছে না, বরং নিজের পক্ষেও মিথ্যা বলছে। যেমন, ওপেনএআই-এর প্রথম মডেল একটি পরীক্ষায় নিজের কোড বাইরের সার্ভারে স্থানান্তর করার চেষ্টা করেছিল এবং ধরা পড়লে তা অস্বীকার করে (ফ্রান্স২৪, ২০২৫, ‘এআই মিথ্যা বলতে, প্রতারণা করতে এবং স্রষ্টাদের হুমকি দিতে শিখছে’)।
এ ধরনের প্রতারণামূলক আচরণ ইসলামি দৃষ্টিতে স্পষ্টভাবে হারাম এবং ফাসেকের আচরণের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ! যদি কোনো ফাসেক সংবাদ নিয়ে আসে, তবে যাচাই করে নাও।’ (সুরা হুজুরাত : ৪৯:৬)। তাহলে প্রযুক্তির এই ফাসেক রূপকে যাচাই না করেই ঈমানি বিষয়ে আমানত অর্পণ করা কতখানি নিরাপদ?
এখানে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন উঠে আসে—এত কথা বলার পরও কেন আমাদের তরুণ প্রজন্ম এআই-নির্ভর হয়ে পড়ছে? উত্তর সহজ—তারা জ্ঞান চায়, কিন্তু ধৈর্য ধরতে চায় না। তারা উত্তর চায়, কিন্তু ব্যাখ্যার ভার নিতে চায় না। তারা ফতোয়া চায়, কিন্তু আলেমের দরজায় যেতে চায় না।
এই মানসিকতা একটি আত্মিক দূরত্ব তৈরি করছে। আলেমদের থেকে নয়, বরং যান্ত্রিক প্রোগ্রামের কাছ থেকে যখন কেউ দ্বীনের জ্ঞান নিতে চায়, তখন সে ‘ইলম’-এর বদলে কেবল ‘তথ্য’ নিচ্ছে—যার ভেতরে নেই খুশু, নেই তাকওয়া, নেই আমানত। এমন এক যান্ত্রিক ফতোয়ার সংস্কৃতি যদি বিস্তার লাভ করে, তবে একদিন ইসলাম আমাদের মাঝেই থাকবে; কিন্তু এর ব্যাখ্যা থাকবে কোডের ভেতর—আত্মা ও আদর্শহীন অবস্থায়।
ইসলাম কোনো প্রযুক্তির বিরোধিতা করে না; বরং যে প্রযুক্তি ঈমান, জ্ঞান ও দাওয়াহর খেদমতে ব্যবহৃত হয়, ইসলাম তাকে স্বাগত জানায়। কিন্তু প্রযুক্তি যদি নিজেই ফিতনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তখন সেটিকে সীমার মধ্যে রাখাই ফরজ। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তিনি তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন যা কিছু পৃথিবীতে আছে।’ (সুরা বাকারা : ২:২৯)। অর্থাৎ সৃষ্ট জগৎ ব্যবহারের স্বাধীনতা আছে, কিন্তু নৈতিকতা ও নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে।
এআই ব্যবহার করা যেতে পারে—সহিহ হাদিসের গবেষণায়, আরবি ব্যাকরণ শেখায়, ইসলামি গ্রন্থের সহজ ব্যাখ্যা উপলব্ধিতে; কিন্তু এর সবই হতে হবে আলেমদের তত্ত্বাবধানে, নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্রের ভিত্তিতে। সৌদি আরবের কিং সৌদ ইউনিভার্সিটি ইসলামি মূল্যবোধভিত্তিক এআই প্রকল্পে কাজ করছে, যেখানে শুধু সহিহ কোরআন ও হাদিসের তথ্য ব্যবহার করা হচ্ছে। বাংলাদেশেও এমন উদ্যোগ দরকার, যেখানে মাদরাসা শিক্ষা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা একত্রে কাজ করে প্রযুক্তির ইসলামি বিকল্প তৈরি করবেন।
এআই এই যুগের এক অভূতপূর্ব পরীক্ষা। এটি যেমন কল্যাণ বয়ে আনতে পারে, তেমনি এটি বিভ্রান্তির দ্বার খুলে দিতে পারে। ইসলামি জ্ঞানের মতো স্পর্শকাতর বিষয় যদি একটি অস্বচ্ছ, কখনো মিথ্যাবাদী, কখনো বিভ্রান্তিকর অ্যালগরিদমের ওপর নির্ভর করে, তবে আমরা এক চরম ফিতনার মধ্যে পা রাখছি। এই ফিতনা শুধু প্রযুক্তির নয়, বরং আত্মার, বিশ্বাসের ও আমানতের।
আমরা যেন কেবল প্রযুক্তির গতি নিয়ে না মেতে উঠি, বরং আত্মার পরিশুদ্ধি ও আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুলের মধ্য দিয়ে সঠিক জ্ঞান অর্জনের পথ খুঁজি। আল্লাহ তায়ালা আমাদের এই যুগের চটকদার ফিতনা থেকে হেফাজত করুন এবং সত্য পথের ওপর অটল রাখুন। আমিন।
লেখক : শিক্ষার্থী, তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মক্কার মসজিদুল হারামের অন্যতম পবিত্র স্থান হাতিম। কাবার মূল কাঠামোর অংশ হিসেবে বিবেচিত এ স্থানটি মুসল্লিদের জন্য অত্যন্ত সম্মানিত ও নামাজ আদায়ের আকাঙ্ক্ষিত জায়গা। এখানে শৃঙ্খলাপূর্ণ উপায়ে ইবাদত নিশ্চিত করতে পুরুষ ও নারী উভয়ের জন্য আলাদা সময় নির্ধারণ করেছে কর্তৃপক্ষ।
১ দিন আগেখাদ্যগ্রহণ যেমন ক্ষুধা মেটানোর জন্য অপরিহার্য, প্রাত্যহিক জীবনের অংশ হিসেবে খাদ্যগ্রহণের ক্ষেত্রে উত্তম সংস্কৃতি ও শিষ্টাচার অনুসরণ করাও গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ যা খায়, যেভাবে খায়—তা তার চরিত্র, নীতি ও রুচির পরিচয় বহন করে। তাই ইসলাম আমাদের খাওয়ার উত্তম সংস্কৃতি ও শিষ্টাচার শিখিয়েছে।
২ দিন আগেসম্প্রতি ইসলামি আলোচক আমীর হামজা আল্লাহর রাসুল (সা.)–কে ‘সাংবাদিক’ বলেছেন। তিনি যুক্তি দিয়েছেন, যেহেতু নবী (সা.) ছিলেন আল্লাহর বার্তাবাহক, তাই রূপক অর্থে তাঁকে সাংবাদিক বলা যেতে পারে। কিন্তু বাস্তবে এই তুলনা ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে বিভ্রান্তিকর এবং রাসুলের মর্যাদার পরিপন্থী।
৫ দিন আগেআমাদের সমাজে বেশ পরিচিত দুটি শব্দ হলো অলি-আওলিয়া। বাঙালি মুসলমান সমাজে সাধারণত মুসলমানদের একটি বিশেষ শ্রেণিকে অলি-আওলিয়া মনে করা হয়। অলি-আওলিয়াদের বিশেষ মর্যাদা ও ক্ষমতা আছে এমন বিশ্বাসও সাধারণ মুসলমানদের রয়েছে।
৫ দিন আগে