জাহিলি যুগে আরব দেশে কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবর দেওয়া হতো, কারণ কন্যাসন্তান জন্মদান করা ছিল তাদের জন্য সামাজিকভাবে অমর্যাদাকর। বাবা তার ঔরসজাত কন্যার নিষ্পাপ মুখ দেখতেও রাজি ছিল না। শুধু আরবে নয়, সারা দুনিয়ায় বিশেষত চীনা, গ্রিসীয়, রোমান ও ভারতীয় সমাজে প্রচণ্ড ধরনের লিঙ্গবৈষম্য ছিল। নারীদের অপবিত্র মনে করা হতো। এমনকি মানুষরূপেও গণ্য করা হতো না। সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র ও যৌন তৃপ্তি সাধনের অনুষঙ্গীই ছিল নারী। প্রাচীন ইউরোপীয় সমাজে নারী ছিল সব পাপের মূল (Root of all evil), নরকের দরজা (Door of the Hell) অথবা শয়তানের মুখপাত্র (Organ of Devil) প্রাচীন ভারতীয় সমাজে স্বামীর মৃত্যুর পর নারীর বেঁচে থাকার অধিকার ছিল না। স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় আত্মাহুতি দেওয়া ছিল তার সামাজিক ও ধর্মীয় কর্তব্য। (সা’ঈদ আল-আফগানি, আল-ইসলাম ওয়াল মারাআত, পৃষ্ঠা : ১৯; মুহাম্মদ রশীদ রেজা, হুকুকুন নিসা ফিল ইসলাম ওয়া হিজুহুন্না মিনাল ইসলাহিল মুহাম্মদি আল-আম, পৃষ্ঠা : ৬২)
ইসলাম পুত্রসন্তান ও কন্যাসন্তানের মধ্যে কোনো পার্থক্য নিরূপণ করাকে পাপ হিসেবে বিবেচনা করে। সন্তানমাত্রই পরিবারের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ও আদরের ধন। প্রাচীন সমাজব্যবস্থায় যেহেতু কন্যাসন্তানের জন্মকে ঘৃণার চোখে দেখা হতো। এ অবস্থা পরিবর্তনের জন্য মহানবী (সা.) কন্যাশিশু লালনকে উৎসাহিত করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) সমাজ থেকে কন্যাসন্তান জীবন্ত সমাহিত করার মতো বর্বর রীতি উচ্ছেদ করেন সফলতার সঙ্গে। তিনি নিজে কন্যাসন্তানদের সঙ্গে সমতা ও হৃদ্যতাপূর্ণ আচরণ করেছেন সারাজীবন, অন্যদেরও কন্যাদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছেন তাগিদপূর্ণ ভাষায়।
যে ব্যক্তি তিনটি মেয়ে অথবা তিনটি বোন লালনপালন করবে, সুশিক্ষায় শিক্ষিত করবে, উপযুক্ত পাত্রে বিয়ে দেবে, রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়ে বলেন, ‘সে ও আমি দুই আঙুলের মতো পাশাপাশি জান্নাতে প্রবেশ করব।’ (সহিহ ইবনে হিব্বান : ৪৪৭) তিনি আরো বলেন, ‘কারো কন্যাসন্তান থাকলে সে যেন তাকে জীবন্ত কবর না দেয়; তার অমর্যাদা না করে এবং পুত্রসন্তানের চেয়ে কম আদর না করে, তাহলে আল্লাহ তাকে বেহেশতে স্থান দেবেন।’ (মুসনাদ আহমদ : ২১০৪)
ইসলাম অধিকার, মর্যাদা ও পরকালীন পুরস্কারের দিক দিয়ে নারী-পুরুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য নিরূপণ করে না। মহানবী (সা.) ন্যায় ও মানবতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় যে বৈপ্লবিক অবদান রাখেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নারীর সামাজিক মর্যাদাদান। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ক্রমান্বয়ে মাতৃতান্ত্রিক সমাজের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ইতিহাসে এই প্রথম মায়েরা সামাজিক স্বীকৃতি লাভ করে। প্রাক-ইসলামি যুগে পৃথিবীর কোথাও নারীর সামাজিক মর্যাদা ছিল না। তারা ছিল অবহেলার পাত্র ও সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র। তাদের অপবিত্র মনে করা হতো। সমাজে যাতে নারী জাতির সম্মান ও মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়, তার জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সমাজের অর্ধেকাংশ নারীকে অবহেলা করলে সামাজিক সুবিচার সুদূর পরাহত হবে, এ চেতনা আল্লাহর রাসুলের মধ্যে ছিল পুরোপুরি কার্যকর।
রাসুলুল্লাহ (সা.) নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে ঘোষণা দেন, ‘সাবধান! তোমরা নারীদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো, কেননা তারা তোমাদের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। সাবধান! তোমাদের স্ত্রীর ওপর তোমাদের যেমন অধিকার রয়েছে, তেমনি তোমাদের ওপরও রয়েছে তাদের অনুরূপ অধিকার। পুরুষ তার পরিবার-পরিজনের রক্ষক এবং স্ত্রী তার স্বামীর গৃহের এবং সন্তানদের রক্ষণাবেক্ষণকারী।’ (তিরমিজি : ১১৬৩)
বিয়ে, বিধবা বিয়ে, খুলআ তালাক, স্ত্রীলোকের মৃত বাবা, মৃত স্বামীর সম্পত্তি ভোগের অধিকার প্রভৃতি বিধান দ্বারা রাসুলুল্লাহ (সা.) ন্যায়-ইনসাফ নিশ্চিত করে পারিবারিক ও সামাজিক কাঠামো গড়ে তোলেন, যা অপরাপর যেকোনো সামাজিক কাঠামোর চেয়ে ছিল উন্নততর।
৬৩২ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ ফেব্রুয়ারি বিদায় হজ উপলক্ষে আরাফাত ময়দানে ১ লাখ ১৪ হাজার সাহাবির সামনে মহানবী (সা.) যে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন, তা মানবিক আদর্শ প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। সমবেত জনগণের উদ্দেশে তিনি সেখানে নারী অধিকার সম্পর্কেও নির্দেশনা দিয়ে বলেন, ‘হে জনগণ! তোমাদের নারীদের ওপর তোমাদের হক রয়েছে এবং তোমাদের ওপরেও রয়েছে তাদের হক।
নারীদের ওপর তোমাদের হক এই যে, তারা তোমাদের ছাড়া অন্য কাউকেও তোমাদের বিছানাগুলো মাড়াতে দেবে না। তোমাদের ঘরে এমন কাউকেও প্রবেশের অনুমতি দেবে না, যাদের তোমরা অপছন্দ করো। যদি তারা অবাধ্য হয়, তবে তাদের উপদেশ দেবে; বিছানায় তাদের পরিত্যাগ করবে এবং (প্রয়োজনে) তাদের শাসন করবে, যখম সৃষ্টিকারী শাসন নয়। তোমাদের কাছে তাদের অবশ্যই কিছু অধিকার রয়েছে। তারা যদি এসব বৈরী কর্মকাণ্ড পরিত্যাগ করে এবং আনুগত্য প্রকাশ করে, তাহলে সংগত পরিমাণে তাদের খোরপোষপ্রাপ্ত হবে। নারীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করে চলবে; কেননা তোমরা তাদের গ্রহণ করেছো আল্লাহর আমানতের মাধ্যমে এবং তাদের লজ্জাস্থান তোমরা হালাল করেছো আল্লাহর কালিমার সাহায্যে। নারীদের সঙ্গে সদাচরণ করবে।’ (সহিহ ইবনে খুজায়মা : ২৮০৯)
লেখক : উপদেষ্টা, ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়

