সরকারি স্থাপনায় রোলার স্কেটিংয়ের বিদ্যুৎ ব্যবসা!

এম. এম. মাসুক
প্রকাশ : ২৭ আগস্ট ২০২৫, ০৯: ০০
রোলার স্কেটিং কমপ্লেক্স

গুলিস্তানমুখী জাতীয় স্টেডিয়ামের এক কিংবা দুই নম্বর গেট দিয়ে কিছুটা সামনে এগোলেই চোখে পড়বে সুবিশাল জাতীয় রোলার স্কেটিং কমপ্লেক্স। ২০১৭ সালে দুই বিঘা জমির ওপর প্রায় ১১ কোটি টাকা ব্যয়ে ৭০ দিনের পাইলট প্রকল্প হিসেবে এই ক্রীড়া স্থাপনাটি নির্মাণ করা হয়। এই রোলার স্কেটিং কমপ্লেক্সের ছাদে বিদ্যুৎ উৎপাদনের স্থাপন করা হয় সোলার প্যানেল। এখান থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়। তবে এই বিদ্যুৎ বিক্রির অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা হয় না! এ নিয়ে বড় ধরনের অনিয়মের অভিযোগ করেছে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি)।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেডের (ডিপিডিসি) কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করে যে পরিমাণ অর্থ আসে হয়, তা শুরু থেকেই সরাসরি চলে যাচ্ছে রোলার স্কেটিং ফেডারেশনের অ্যাকাউন্টে। অথচ নিয়ম অনুযায়ী সরকারি ক্রীড়া স্থাপনা থেকে অর্জিত আয় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি) পাওয়ার কথা। যুক্তি হলো, দেশের সব সরকারি ক্রীড়া স্থাপনার অভিভাবক সংস্থা এনএসসি। কিন্তু ক্রীড়া পরিষদের স্থাপনায় ব্যবসা করছে রোলার স্কেটিং ফেডারেশন!


এত দিন ধরে সরকারি বিদ্যুৎ বিক্রির অর্থ রোলার স্কেটিংয়ে গেলেও নীরব ভূমিকায় ছিল এনএসসি। সম্প্রতি এ ব্যাপারে রোলার স্কেটিং ফেডারেশন ও ডিপিডিসিকে তলব করে ক্রীড়া পরিষদ। কিন্তু উভয় পক্ষ থেকে কোনো সাড়া না পাওয়ায় বাধ্য হয়ে ডিপিডিসিকে নিজেদের সরকারি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ জমার দেওয়ার জন্য এনএসসি আনুষ্ঠানিক চিঠি দিয়েছে।

এনএসসির সহকারী পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) শফিকুল ইসলাম স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, ২০১৮ সালে ২০০ কিলোওয়াট পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন সোলার প্যানেলটি স্থাপন করা হয়। এখান থেকে বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়ে থাকে। আনুমানিক ১৮ হাজার ইউনিটের বিপরীতে প্রতি ইউনিট ৯.৯৩ টাকা করে মাসে প্রায় এক লাখ ৭৫ হাজার টাকা রোলার স্কেটিং ফেডারেশনকে দেয় ডিপিডিসি। এ পর্যন্ত প্রায় দেড় কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। এই পুরো অর্থ এনএসসির অনুকূলে জমা হওয়ার কথা।

এ বিষয়টি খতিয়ে দেখতে একটি অনুসন্ধান চালায় এনএসসি। জাতীয় স্টেডিয়ামের প্রশাসক কামরুল ইসলাম ও এনএসসির সহকারী পরিচালক (যান্ত্রিক) জাহিদ হোসেনের প্রায় দেড় মাসের তদন্তের পর এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয় এনএসসি।


কামরুল ইসলাম আমার দেশকে বলেন, ‘সোলারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে তারা নতুন একটি আইডিয়া সেট করেছে। কিন্তু ডিপিডিসি থেকে পাওয়া টাকাটা তারাই নিয়ে নেয় এনএসসির অনুমতি ছাড়া।’


জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আমরা অনুসন্ধান করেছি এবং সবকিছু জেনেছি। তারা তো আমাদের কাগজপত্র দিতে রাজি না। তারা বলছেন, অফিসিয়ালি চাইতে। তাই আমরা অফিসিয়াল চাইছি। স্যারেরা চিঠি দিয়েছেন এখান থেকে আয়ের টাকা-পয়সা আমাদের দেওয়ার জন্য।’ প্রশ্ন হতে পারে এতদিন কেন এনএসসি বিষয়টি তদারকি করল না? এখানে সরকারি প্রভাবই বেশি কাজ করেছে। কেননা রোলার স্কেটিং ফেডারেশনের তৎকালীন সভাপতি ছিলেন স্বৈরাচার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ। তার প্রভাব দেখিয়েই ডিপিডিপির সঙ্গে চুক্তি করেছেন রোলার স্কেটিং ফেডারেশন। তখন এনএসসির সচিবের দায়িত্বে ছিলেন অশোক কুমার বিশ্বাস ছিলেন দর্শকের ভূমিকায়।


রোলার স্কেটিং ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসিফুল হাসান দাবি করেন, নানা জায়গা থেকে স্পন্সর ও অনুদানের মাধ্যমে সোলার প্যানেলটি স্থাপন করেছে ফেডারেশন। এখানে এনএসসির কোনো বিনিয়োগ নেই। তবে এজন্য এনএসসির কি অনুমতি দিয়েছিল? আসিফুল হাসান বলেন, ‘ক্রীড়া পরিষদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেই সোলার প্যানেল বসানো হয়। ডিপিডিসির সঙ্গে চুক্তিসহ সবকিছুর এনএসসির সচিবের মাধ্যমেই হয়েছে।’

একই কথা বললেন রোলার স্কেটিং ফেডারেশনের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক লুৎফুর রহমান। তার মতে, এনএসসি বড়জোর সোলার প্যানেল স্থাপনায় থাকার কারণে ভাড়া দাবি করতে পারে। তিনি বলেন, ‘মাত্র দুই মাস হলো আমরা ফেডারেশনের দায়িত্বে এসেছি। ক্রীড়া পরিষদ যে চিঠিটা দিয়েছিল, সেটি আমি ডিপিডিসিকে ফরোয়ার্ড করে দিয়েছি। সোলার প্যানেল স্থাপনের টাকাটা তো ক্রীড়া পরিষদ দেয়নি কিংবা সরকার দেয়নি। ফেডারেশন দিয়েছে। আমার মনে হয়, ক্রীড়া পরিষদের সঙ্গে বৈঠক করে ডিপিডিসি ও ফেডারেশনের মধ্যে চুক্তি হয়েছে।’

তবে এনএসসির দাবি, কোনো অনুমতি নেওয়া হয়নি। এমনকি সোলার প্যানেল বসানোর পেছনেও রোলার স্কেটিং ফেডারেশন কোনো বিনিয়োগ করেনি।

এ প্রসঙ্গে এনএসসির সহকারী পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এই সোলার প্যানেল আসলে ডিপিডিসিই স্থাপন করে দেয়। তারা আমাদের আরো ক্রীড়া স্থাপনায় এই রকম সোলার প্যানেল স্থাপনের জন্য চিঠি দিয়েছিল। কিন্তু আমরা এখন নিজেরাই সোলার প্যানেল স্থাপন করছি। কারণ, সরকারি বাধ্যবাধকতা আছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘ডিপিডিসি ক্রীড়া স্থাপনার মালিক হিসেবে রোলার স্কেটিং ফেডারেশনের সঙ্গে চুক্তি করেছে। কিন্তু আমাদের সঙ্গে করেনি। এখান থেকে প্রাপ্ত অর্থ এনএসসি পাওয়ার কথা।’


কীভাবে রোলার স্কেটিংয়ের সঙ্গে চুক্তি করল ডিপিডিসি? এ প্রসঙ্গে ডিপিডিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জহিরুল করিম বলেন, ‘রোলার স্কেটিং সেই সময়ে ডিপিডিসিকে প্রস্তাব দিয়েছিল যে, আমরা এখানে একটা সোলার সিস্টেম বসাব। এই সোলারের বিদ্যুৎ আমরা ডিপিডিসির কাছে বিক্রি করতে চাই। এই প্রস্তাবনাটা ডিপিডিসি বোর্ড ও রোলার স্কেটিং ফেডারেশনের কর্তৃপক্ষ বসে সমঝোতায় যায় যে, কত টাকা ধরে বিদ্যুৎ ডিপিডিসি কিনবে। দুই থেকে তিন মাস পরপর একটা যৌথ রিডিং নেওয়া হয়, সেই রেট অনুযায়ী টাকা রোলার স্কেটিংয়ের অ্যাকাউন্টে জমা দেওয়া হোক।’


তিনি আরো বলেন, ‘আমরাও চাচ্ছি যে, এই খাতের অর্থ জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে জমা হোক। এনএসসিকে আমরা বলেছি, ডিপিডিসির বোর্ড আছে, সেখানে বিষয়টি আমরা উপস্থাপন করব।’

বিষয়:

এনএসসি
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত