বদলে যাওয়া সাঈদ আনোয়ারের জীবন

কিংবদন্তি ক্রিকেটার থেকে দ্বীনের দায়ি

স্পোর্টস ডেস্ক
প্রকাশ : ০৫ মার্চ ২০২৫, ১৩: ০০

পাকিস্তানের ক্রিকেট আকাশে যতগুলো মহাতারকা জ্বলজ্বল করে জ্বলছে, সেখানে সাঈদ আনোয়ার একটি অন্যতম নাম। নব্বই দশকে ওয়ানডে ওপেনিংয়ে কীভাবে আগ্রাসী ব্যাটিং করতে হয়, সেই ধারণাটা পাওয়া গিয়েছিল তার ব্যাট থেকেই। দলকে উড়ন্ত সূচনা এনে দিতেন। তার জাদুকরি টাইমিং আর প্লেসমেন্ট ছিল অবিশ্বাস্য। দর্শনীয় সব শট খেলার কারণেই তার ব্যাটিং দেখা ছিল চোখের আরাম। তাকে শচিন টেন্ডুলকারের সত্যিকারের প্রতিদ্বন্দ্বী ধরা হতো। বোলারদের দাপটের যুগে ওয়ানডে ক্রিকেটে সেঞ্চুরি করাই ছিল দূরের বাতিঘর। আর ১৫০ কিংবা ২০০ ছিল তো ভাবনার বাইরে। সেই সময় ১৯৪ রানের এক মহাকাব্যিক ইনিংস খেলে বিশ্ব রেকর্ড গড়েন সাঈদ আনোয়ার। আর সেটি ছিল চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের বিপক্ষে। শচিন ২০০ রান করার আগে ওয়ানডে ক্রিকেটে এটিই ছিল ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রান সংগ্রহের রেকর্ড। পাকিস্তানের হয়ে টেস্ট (৫৫টি) ও ওয়ানডে (২৪৭) মিলে ৩০২টি ম্যাচ খেলেন সাঈদ আনোয়ার। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন একজন কিংবদন্তি ক্রিকেটার হিসেবেই। পাকিস্তানের অনেক জয় ও রেকর্ডের অংশীদার এই খেলোয়াড়ের জীবনধারা বদলে যায় একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে।

মুলতান টেস্ট, প্রতিপক্ষ বাংলাদেশ। এক ইনিংসে পাকিস্তানের পাঁচ ব্যাটসম্যান সেঞ্চুরি করলেন। ১০১ রানের ইনিংস খেলেন সাঈদ আনোয়ারও। এই ইনিংস খেলার দুই দিন পর অর্থাৎ ২০০১ সালের ৩১ আগস্ট বড় দুঃসংবাদ পান সাঈদ। মারা যায় তার সাড়ে তিন বছরের মেয়ে বিসমাহ। দীর্ঘদিন রোগভোগের পর আদরের মেয়ে দুনিয়া থেকে চলে যাওয়ার ঘটনাটি সাঈদকে এতটাই নাড়া দিয়েছিল যে, সেই যে মুলতান থেকে বাড়ি ফিরলেন, আর টেস্ট ক্রিকেটই জীবনে খেলেননি। অবশ্য এরপর কিছুদিন ওয়ানডে ক্রিকেট খেলা চালিয়ে গেছেন এই কিংবদন্তি খেলোয়াড়। তবে ২০০৩ সালের মার্চের পর আর ক্রিকেটে দেখা যায়নি তাকে। খেলা ছেড়ে ধর্ম-কর্মের জীবন বেছে নেন সাঈদ আনোয়ার। এখন একজন ইসলাম ধর্ম প্রচারক এই ক্রিকেটার। রেখেছেন মুখভর্তি লম্বা দাড়ি। তার চলন, বলন, কথা-বার্তা, আচার-আচরণেও এসে সীমাহীন পরিবর্তন। শরিয়াবিরোধী কোনো অনুষ্ঠানে অংশ নেন না। এমনকি আত্মীয়-স্বজনের বিয়ের অনুষ্ঠানে পুরুষ-নারীর জন্য আলাদা ব্যবস্থা না থাকলে, সেখানেও যান না। ছবি তুলতে পছন্দ করেন না। টেলিভিশনের পর্দায় আসতে চান না। সহজ সরল ইসলামের সাধারণ জীবন পথ ধরেছেন পাকিস্তানের এই ক্রিকেটার।

বিজ্ঞাপন

পাকিস্তান দলের হয়ে খেলার সময়ই নামাজ পড়তেন, রোজা রাখতেন, অন্যদের ধর্মের ব্যাপারে উৎসাহিত করতেন সাঈদ। পাকিস্তান ক্রিকেট দলে নামাজের প্রচলনটা তার মাধ্যমেই হয়েছিল। তার মাধ্যমে সতীর্থরা তখন দারুণ প্রভাবিত হন। যে কারণে চিন্তা-ভাবনা, বেশভূষায়ও ব্যাপক পরিবর্তন আসে মোহাম্মদ ইউসুফদের মতো ক্রিকেটারদের। ২০০০ সালের একটি ঘটনা। সেসময় পাকিস্তান সফরে যায় ইংল্যান্ড ক্রিকেট দল। কিন্তু পাকিস্তান অতটা শক্তিশালী দল ছিল না। মাঠে নামার আগে দলের সবাই অনেক আতঙ্কে ছিলেন। এমন অবস্থায় দলের সবাইকে ডেকে সাঈদ বললেন, ‘ভয় না করে চলো, আমরা নামাজ আদায় করি।’ সবাই নামাজ পড়ে ও দোয়া করে খেলায় নামল। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ জিতল পাকিস্তান। পরে আরো দুটি জয় এসেছে।

সাঈদ আনোয়ারের সামনে বিলাসী জীবনযাপনের অনেক সুযোগ ছিল। তার বাবা ছিলেন নামকরা ইঞ্জিনিয়ার। সাঈদ নিজেও কম্পিউটার সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ডিগ্রি অর্জন করেছেন। উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার সুযোগ থাকলেও ক্রিকেটের কারণে যাওয়া হয়নি তার। তবে খেলোয়াড়ের উদ্দাম জীবনধারাও তাকে প্রভাবিত করতে পারেনি। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটাররা পাশ্চাত্যের অভিজাত জীবনধারার। জয়ের পর মাঠে শ্যাম্পেনের বুদবুদ ছড়ানো, বারে হইহুল্লোড়, নাইট ক্লাবে সময় কাটানোটাও ক্রিকেটের অংশ হয়ে যায় তাদের। চাইলে এই জীবনধারায়ও অভ্যস্ত হতে পারতেন সাঈদ। কিন্তু বিলাসী জীবন তাকে টানেনি। ইসলাম ধর্ম সঠিকভাবে পালন করার জন্য খেলা ছেড়ে দিয়ে আর ক্রিকেটে সম্পৃক্ত থাকেননি। একবার বলেছিলেন খেলা ছাড়ার পর ধারাভাষ্যকার হবেন। কিন্তু সেই মতও বদলে ফেলেন। তাকে পাকিস্তান ক্রিকেটে নির্বাচক হওয়ার প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছিল একবার। কিন্তু ন্যায়বিচার করতে পারবেন না বলে এ দায়িত্ব নেননি। একসময় ক্রিকেটের অন্তঃপ্রাণ হলেও এখন সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে সাঈদের অবস্থান। ২২ গজে ব্যাট হাতে ঝড় তোলা তারকা ক্রিকেটার সময়ের পরিক্রমায় এখন একজন খাঁটি তাবলিগের দায়ি। ক্রিকেটকে ভুলে থাকতেই পছন্দ তার। ইসলামকে ঘিরেই তার সব চিন্তাভাবনা আর ধ্যান-জ্ঞান। দ্বীনের দাওয়াতের জন্য দেশ-দেশান্তরে ছুটে বেড়ান। সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেওয়াটাই তার প্রধান কাজ। দ্বীনের দাওয়াতের কাজে বাংলাদেশে এসেও ঘুরে গেছেন সাঈদ। বিশ্ব ইজতেমার সময়ও বাংলাদেশে আসা হয় তার। বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের দ্বীনের দাওয়াত দেন এই পাকিস্তানি। একবার চট্টগ্রাম গিয়েও দ্বীনের দাওয়াতের কাজ করেছেন। তার সঙ্গে ছিলেন পাকিস্তানের আরেক ক্রিকেটার জুলকারনাইন। আমন্ত্রণ পেয়ে চট্টগ্রামের স্টেডিয়ামে গেলেও ক্রিকেট নিয়ে একটি কথাও বলেননি সাঈদ। সবাইকে শুধু দ্বীনের দাওয়াতটাই দিয়েছেন। ক্রিকেট-জীবনের খ্যাতি, সম্পদের প্রাচুর্য, সুখ-শান্তি, আরাম-আয়েশ সবকিছু একদিকে রেখে সাঈদের কাছে ইসলাম ধর্মটাই আসল, তাবলিগি মেহনতের কাজ করাটাই তার কাছে বেশি মূল্যবান। সাঈদ আনোয়ার একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ইসলামের আলোয় আসার আগে মনে শান্তি ছিল না, রাতে ঘুম আসত না, জোর করে ঘুমানোর চেষ্টা করলেও চোখ খুলে যেত। ওষুধ খেয়েও ঘুমাতে পারতেন না। অবশ্য সাঈদের দ্বীনের দায়ি হয়ে ওঠার পেছনে পাকিস্তানের প্রখ্যাত ইসলামিক স্কলার তারিক জামিলের ভূমিকাও আছে। তার সান্নিধ্যে গিয়ে চিন্তাভাবনায় আরো বেশি পরিবর্তন এসেছে সাঈদের। সব মিলে দুনিয়াবি সব বাদ দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় নিজেকে নিবেদন করেছেন পাকিস্তানের এই ক্রিকেটার। যত দিন বেঁচে থাকবেন সাঈদ- ইসলামের আলো ছড়িয়ে যেতে চান সবার মাঝে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত