শেখ হাসিনার আশীর্বাদে দুর্নীতির শিখরে শিখর

আরিফুর রহমান
প্রকাশ : ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ১১: ০০

ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চেরাগে ঘষা দিলে বেরিয়ে আসে মতিউর রহমান-বেনজীর-আছাদুজ্জামান মিয়া- সাইফুজ্জামান শিখর-ওবায়দুল কাদেরের মতো শতশত ব্যক্তি। যারা অন্যের উপকার করতে নয়, বরং অন্যের সম্পদ লুট করে নিজেদের সম্পদের পাহাড় গড়েছেন।

শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে গর্বের সঙ্গে বলেছিলেন, তার পিয়নেরও ৪০০ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। পিয়ন নাকি হেলিকপ্টার ছাড়া চলাফেরা করে না। ৩০০ টাকার বালিশের দাম ৬ হাজার টাকা হওয়ার পরেও চোরের বিচার করেনি হাসিনা সরকার। তার ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসন এ দেশের প্রতিটি সরকারি দপ্তরের নিচতলা থেকে ওপরতলা পর্যন্ত চোরের ফ্যাক্টরিতে পরিণত করেছিল।

বিজ্ঞাপন

এই তালিকায় তার নিজের দপ্তরের চোরগুলো ছিল শীর্ষপর্যায়ে। তার দপ্তরে সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) সাইফুজ্জামান শিখর ছিলেন শীর্ষদের একজন। দেশের টাকা চুরি করে হয়েছেন হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক।

অনুসন্ধানকালে জানা গেছে, শিখর ‘এপিএস’ হওয়ার পরে তার আপন মামাতো ভাই সানাই শাওনকে তার বাড়িতে ব্যক্তিগত কর্মচারী হিসেবে রাখেন। বাসা দেখাশোনা ও বাজার করার দায়িত্ব ছিল তার। যেসব সম্পত্তি বর্তমানে তার তত্ত্বাবধানে রয়েছে তার সব কিছুর মালিক শিখর।

একসময় প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের টাকা দিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার খরচ চলত শিখরের। প্রধানমন্ত্রীর ‘এপিএস’ পদে চাকরি পাওয়ার পর জাদুর কাঠির মতো রাতারাতি হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন তিনি। গণভবনে ‘এপিএস’র রুমে বসেই ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট, খালিদ ভূইয়া, জিকে শামীম, লিয়াকত শিকদার সংশ্লিষ্ট বিভাগের অফিসারদের সেখানে ডেকে নিয়ে টেন্ডার ভাগাভাগি করাই ছিল শিখরের কাজ।

ক্ষমতা থাকাকালীন হাসিনা সরকার ঢাকায় গ্রেপ্তারকৃত অনলাইন ক্যাসিনোর মালিক সেলিম প্রধানের সঙ্গে শিখরের প্রতিনিধি হিসেবে ‘সানাই শাওন’ ব্যক্তিগত ব্যবসা পরিচালনা করেছে। বর্তমানে শিখর যে বাড়িতে বসবাস করে এটাও এক হিন্দু পরিবারের কাছ থেকে জোর করে দখল করা। বাড়ির মালিক ছিলেন কালীপদ ঘোষ নামে একজন ড্রাইভার। তাকে পরিবার পরিজনসহ বেনাপোল বর্ডার দিয়ে ভারতে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

অনুসন্ধানকালে জানা গেছে, শিবরামপুর নিজ মামাবাড়ি পৌরসভার মধ্যে ২০ বিঘা জমির ওপরে বাগানবাড়ি তৈরি, আলিধানীতে ২০ বিঘা ধানি জমি, কাটাখালী, নড়িহাটি, বাশকোটা, টেংগাখালী, মালন্দ, মৃগিডাংগা, বাগডাংগা মৌজায় শত বিঘা ফসলি জমি ক্রয় করেছেন। শালিখার শতখালী এ আর (আসাদুজ্জামান-রশিদ) জুটমিল করেছেন ৫০ বিঘা জমির ওপর।

নড়াইলে নিজ শ্যালকের তত্ত্বাবধানে ২০০ বিঘা জমি ও ইটভাটা, মানিকগঞ্জে ১০০ বিঘা জমি খরিদ করেছে। চট্টগ্রামে চকরিয়ায় ১০০ বিঘা জমিতে মাছের ঘের রয়েছে। গাজীপুরের মেয়র জাহাঙ্গীরের সঙ্গে অংশীদারত্বে রয়েছে জুটমিল এবং ঝুটের ব্যবসা। রাজশাহীতে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় (বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়) ও মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম রয়েছে।

রয়েছে খুলনার অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিলের মধ্যে ২০ বিঘা জমি। সাভারের হেমায়েতপুরে একটি হাউজিং কোম্পানির জমিতে ১০তলা বাড়ি। ময়মনসিংহের ভালুকায় সোয়েটার ফ্যাক্টরি। এছাড়াও বিদেশে বহু দেশের সঙ্গে তার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা-বাণিজ্য রয়েছে যার দেখাশোনা করে সানাই শাওন।

জানা গেছে, স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ আমলে মাগুরায় শিখর এবং তার ভাইদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রশাসন, ব্যবসা, দলীয় কর্মকাণ্ড, টেন্ডার, দখলদারি সব কিছুই তিনি ও তার ভাইদের হুকুমে চলত। সব টেন্ডার শিখরের নির্দেশেই সিদ্ধান্ত হতো।

তাছাড়া গাজীপুরে ২০ বিঘা জমি, ফরিদপুরে একটি ইন্ডাস্ট্রি, সাভারে একটি ৬ তলা বাড়ি, মাগুরা শহরে ৪ তলা বাড়ি, মাগুরার শিবরামপুরে ১২ বিঘা জমির ওপর বাগানবাড়ি, ভাইদের নামে দুটি ইটভাটা, মাগুরা শহরের ভায়না মোড়ে একটি আবাসিক হোটেল, পেট্রোলপাম্প, ছায়াবাণী সিনেমা হলের সামনে একবিঘা জমি রয়েছে। এগুলো তার মামাতো ভাইয়ের মাধ্যমে দেখভাল করেন।

শিখরের বদৌলতে কোটিপতি যারা

শিখরের বদৌলতে কোটিপতি হয়েছেন অনেকে। তারা হলেন, মীর সুমন, শেখ রেজাউল, মীর রুবেল, তুহিন কাউন্সিলর, খোকন ঠাকুর, অ্যাডভোকেট শাকিল, মুহিত চেয়ারম্যান, রফিক চেয়ারম্যান, ঠিকাদার মুক্তি, ঠিকাদার দুলু, মামাতো ভাই সানাই শাওন, ছোট ভাই হিসাম, মেজো ভাই সাচ্চু, পৌর কাউন্সিলর মাকুল, যুবলীগ নেতা মোল্লা মাজেদুল।

শিখরের বাড়ির কাজের লোক ইমরান (ক্যাশিয়ার) এখন কোটিপতি। তার বাড়ি মহাম্মদপুর উপজেলার রাজাপুর গ্রামে। মাগুরা শহরের খানপাড়ায় ২টি বাড়ি কিনেছে ১ কোটি ৬০ লাখ টাকায়, ‘নিজনান্দুয়ালীতে’ একটি বাড়ি করেছে ৭০ লাখ টাকায়। গ্রামে ২০ বিঘা জমি কিনেছে, সেখানেও রয়েছে ৩ তলা বাড়ি। সে ১৫ বছর ধরে শিখরের বাসার কাজ করেছে।

শিখর আমেরিকায় তার মামাত বোন, দুলাভাই ও মামাত ভাই শাওন সানাইয়ের মাধ্যমে টাকা পাচার করে তিনটি বাড়ি ক্রয় করেছেন। নিউইয়র্ক, ভার্জিনিয়া ও ব্রাসেলসে এই তিনটি বাড়ি অবস্থিত। এই টাকা পাচারে সহযোগিতা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রে ছাত্রলীগের সভাপতি জাহিদ হাসান। তিনি শাওন সানাইয়ের ডান হাত। উল্লিখিত মোল্লা মাজেদুল তিনটি বাড়ি ও ২০ বিঘা জমির মালিক।

কী বলছে টিআইবি ও দুদক

এসব বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান আমার দেশকে বলেন, কোনো দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিদের ছাড় দেওয়া যাবে না। ক্ষমতার অপব্যবহার করে যেসব ব্যক্তি অবৈধ সম্পদ গড়েছেন তা বাজেয়াপ্ত করা অতি জরুরি।

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন আমার দেশকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ক্ষমতাকে পুঁজি করে অবৈধভাবে যারা সম্পদ গড়েছেন তাদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। প্রতিটি সম্পদের হিসাব দিতে হবে। কারণ, এই সম্পদ দেশের জনগণের। সুতরাং দুর্নীতি করলে কোনো ছাড় পাবে না।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত