শাহজালাল বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল

১৪ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ

কবিতা
প্রকাশ : ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ১০: ১৬
ছবি: সংগৃহীত

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনালের নির্মাণ ব্যয় নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। এই মেগা প্রকল্পে কমপক্ষে ১৪ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে।

দুর্নীতির কারণে থার্ড টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক এ কে এম মাকসুদুল ইসলামের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। প্রাথমিক তদন্তেই তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির তথ্য পাওয়া গেছে এবং আরও ফেঁসে যাচ্ছেন সাবেক মন্ত্রী-সচিবসহ নেপথ্যের রাঘববোয়ালরাও।

বিজ্ঞাপন

থার্ড টার্মিনাল প্রকল্পে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে নকশা পরিবর্তন করে। এতে প্রায় ৯০০ কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। জানা গেছে, প্রকল্প কাজ সাড়ে ৬ শতাংশ শেষ হওয়ার পর রহস্যজনকভাবে আবার নকশা পরিবর্তন করা হয়।

গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিষয়টি আমলে নিয়ে দুর্নীতি তদন্তে কমিটি গঠন করে । গত রোববার জারি করা এক অফিস আদেশে মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই প্রকল্প পরিচালকের নিয়োগ বাতিল করেছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। প্রাথমিক তদন্তেই দুর্নীতির গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এতে সাবেক মন্ত্রী-সচিবসহ নেপথ্যের কুশীলবরা ফেঁসে যাচ্ছেন বলে সূত্রের তথ্য।

বেবিচক সূত্র জানায়, মাকসুদুল ইসলাম ২০২১ সালের ৩০ ডিসেম্বর বেবিচক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পদ থেকে অবসরে যান। অবসরে যাওয়ার পর পরই তাকে থার্ড টার্মিনালের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের জন্য ডিও লেটার দেন তৎকালীন বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী। নিয়োগও পেয়ে যান তিনি।

জানা গেছে, প্রকল্পটি জাপানি কোম্পানির তত্ত্বাবধানে হলেও পুরো প্রকল্পের কেনাকাটা ও সরঞ্জাম সংযোজনের অলিখিত নেতৃত্বে ছিলেন সাবেক বিমান প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী ও বেবিচকসংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী। তার ডান হাত হিসেবে সবকিছু সামলাতেন প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মাকসুদুল ইসলাম।

ঘুষ ছাড়া কোনো ফাইলে স্বাক্ষর করেননি প্রকল্প পরিচালক। তাকে ঘুষ দিতে হয়েছে ডলারে এবং দেশের বাইরে। এসব নিয়ে প্রকল্প পরিচালকের দূরত্ব তৈরি হয় জাপানি ঠিকাদারের সঙ্গে। কাজও বন্ধ ছিল দীর্ঘদিন ।

কাজের শুরুর দিকে প্রকল্প পরিচালকসহ সিন্ডিকেটের সহায়তায় চীন, দক্ষিণ কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আনা নিম্নমানের প্রায় ২০-২৫টি পণ্য ফেরত পাঠানো হয়। পরবর্তী সময়ে ওই পণ্যগুলো ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে আনা হয়। এতে প্রকল্প পরিচালকসহ সিন্ডিকেটের কমিশন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে দীর্ঘদিন এসব পণ্য বন্দর থেকে ছাড়াননি তিনি।

প্রকল্পের কেনাকাটা নিয়ে বড় ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে। শুরুর দিকে দক্ষিণ কোরিয়া, চিনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে অসংখ্য নিম্নমানের ইকুইপমেন্ট ও পণ্য কিনে আনা হয়েছিল।

এদিকে কাজ শেষ না করে পতিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দিয়ে তড়িঘড়ি করে প্রকল্পটির উদ্বোধন করান। এতে অর্ধশত কোটি টাকা অযৌক্তিক খরচ হয়েছে বলেও অভিযোগ আছে।

জানা যায়, জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থা জাইকার অর্থায়নে টার্মিনালের নির্মাণ ব্যয় হচ্ছে ২১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। অ্যাভিয়েশন কনসোর্টিয়ামের মাধ্যমে জাপানের মিৎসুবিশি ও ফুজিটা এবং কোরিয়ার স্যামসন এ তিনটি প্রতিষ্ঠান থার্ড টার্মিনাল ভবন নির্মাণকাজ করছে। থার্ড টার্মিনালের নকশা করেছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন স্থপতি রোহানি বাহারিন।

থার্ড টার্মিনালের কাজ বিক্রি করে কমিশনবাণিজ্য করা হয়েছে প্রকল্পের তিনটি বড় কাজ নির্ধারিত ঠিকাদারের পরিবর্তে অন্য প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগ আছে সাবেক প্রকল্প পরিচালকের বিরুদ্ধে।

কাজগুলো থার্ড টার্মিনালের অংশ হলেও প্রকল্প পরিচালক সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য গোপনে চুক্তিবহির্ভূত অন্য ঠিকাদারকে কার্যাদেশ দেয়। সরকারকে গচ্চা দিতে হয় কমপক্ষে ১০ কোটি টাকা।

অ্যাভিয়েশন অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সেক্রেটারি জেনারেল ও নভোএয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মফিজুর রহমান বলেন, গাড়ি পার্কিং ছাড়াই ২০১৬ সালের দিকে থার্ড টার্মিনালের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়।

তিনি বলেন, টার্মিনালের সঙ্গে একই সময়ে কাজ শুরু হওয়া বেঙ্গালুরুর ক্যাম্পাগাউড়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ২০২২ সালেই চালু হয়েছে। কোনো ধরনের ব্যয়বৃদ্ধি ছাড়াই ওই বিমানবন্দর তৈরিতে ৫ হাজার কোটি রুপি খরচ হয়েছে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। ওই বিমানবন্দরটি আয়তনে ঢাকার থার্ড টার্মিনালের চেয়ে ২৩ শতাংশ বড়।

সিভিল অ্যাভিয়েশন সূত্র জানিয়েছে, থার্ড টার্মিনালের মোট কাজের ৯০ শতাংশই সম্পন্ন হয়েছে। শুধু যন্ত্রপাতি স্থাপনের কাজ বাকি। থার্ড টার্মিনাল পুরোপুরি চালু হতে আরও এক বছর সময় লাগবে। এখানে থাকছে ৩৭টি অ্যাপ্রোন পার্কিং।

অর্থাৎ একসঙ্গে ৩৭টি উড়োজাহাজ পার্ক করা যাবে। শাহজালাল বিমানবন্দরে বর্তমানে চারটি ট্যাক্সিওয়ে আছে। নতুন করে আরও দুটি হাই স্পিড ট্যাক্সিওয়ে যোগ হচ্ছে। রানওয়েতে উড়োজাহাজকে যাতে বেশি সময় থাকতে না হয়, সে জন্য নতুন দুটি ট্যাক্সিওয়ে তৈরি করা হচ্ছে। এ ছাড়া পণ্য আমদানি ও রপ্তানির জন্য দুটি ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। আরও থাকবে গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য তিনতলা ভবন। এখানে থাকবে ২৬টি বোর্ডিং ব্রিজ।

সিভিল অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, প্রাথমিকভাবে থার্ড টার্মিনালেই স্মার্ট অ্যাভিয়েশনের সব সুবিধা নিশ্চিত করা হচ্ছে। যেমনÑএয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট, স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাপনা, অটোমেটেড রেভিনিউ ম্যানেজমেন্ট, অ্যাডভান্সড প্যাসেঞ্জার ইনফরমেশন সিস্টেম, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মতো সব ধরনের ব্যবস্থা।

এয়ার এস্ট্রার সিইও ইমরান আসিফ আমার দেশকে জানান, থার্ড টার্মিনাল পুরোপুরি চালু হলে দ্বিতীয় রানওয়ে না থাকার কারণে এয়ারক্র্যাফট ডাইভারশন করতে গেলে সমস্যায় পড়তে হবে। তাই চট্টগ্রাম এয়ারপোর্টের রানওয়েকে বিকল্প হিসেবে প্রস্তুত রাখতে হবে।

উল্লেখ্য, দেশের বিমানবন্দরের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ প্রকল্প হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সম্প্রসারিত তৃতীয় প্রকল্প, যা থার্ড টার্মিনাল হিসেবেই বেশি পরিচিত।

বর্তমানে প্রধান বিমানবন্দর শাহজালালে দুটি টার্মিনাল রয়েছে। এই দুটি টার্মিনাল এক লাখ বর্গমিটার জায়গার ওপর। আর থার্ড টার্মিনালে রয়েছে, ২ লাখ ৩০ হাজার বর্গমিটার এলাকা। ২০১৭ সালে থার্ড টার্মিনাল নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেয় সরকার।

নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর। ব্যয় ধরা হয় প্রায় ২১ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাপানি সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) ঋণ হিসেবে দিচ্ছে ১৬ হাজার ১৪১ কোটি টাকা। আর বাকি টাকার জোগান দিচ্ছে সরকার।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত