এহতেশামুল হক শাওন, খুলনা ব্যুরো
একদিকে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, অন্যদিকে মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি। এসব পদ ব্যবহার করে তিনি অনিয়ম ও দুর্নীতির শিখরে পৌঁছে গিয়েছিলেন। সাধারণ রাজনীতিবিদ থেকে পরিণত হয়েছিলেন টাকার কুমিরে। পরে থাকতেন সৎ, নীতি ও আদর্শবান মানুষের মুখোশ। শুধু ঘনিষ্ঠরা জানতেন তার অন্ধকার দিকের খবর।
বলছিলাম খুলনা সিটি কর্পোরেশনের (কেসিসি) সাবেক মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেকের কথা। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে তিনিও লাপাত্তা। এরপর আর প্রকাশ্যে না এলেও দলের ও কর্পোরেশনের অনেকের সঙ্গে মাঝেমধ্যে তার যোগাযোগ হয় বলে জানা গেছে। নগর ভবনকে বানিয়েছিলেন দুর্নীতির আখড়া। যদিও তার আমলে ঘটে যাওয়া অনিয়ম তদন্তে কোনো কমিটি হয়নি। তবে তার অপকর্মের সহযোগীরা এখনও রয়েছেন বহাল তবিয়তে।
ঠিকাদারিতে ভাগ্য বদল
বিপুল অর্থের মালিক হওয়ার জন্য কেসিসির ঠিকাদারিকেই বেছে নিয়েছিলেন আব্দুল খালেক। কোন কাজ কে করবে, তাও নির্ধারণ করে দিতেন তিনি। একটি সূত্র জানায়, এজন্য আগেই পাঁচ শতাংশ টাকা পৌঁছে দিতে হতো তাকে। এর বাইরে সব কাজের বিলের চেক লেখার আগেই এক শতাংশ টাকা দিতে হতো চিফ অ্যাকাউনটেন্ট মোস্তাফিজকে। না দিলে চেকে সই করতেন না মেয়র।
জানা যায়, আব্দুল খালেক মেসার্স হোসেন ট্রেডার্স, আজাদ ইঞ্জিনিয়ার্স ও মেসার্স তাজুল ইসলাম নামে তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে প্রায় ৬০ কোটি টাকার কাজ করেছেন গত কয়েক বছরে। ঠিকাদার এইচএম সেলিম (সেলিম হুজুর) এসব কাজ দেখাশোনা করতেন। এর বাইরে পাঁচ শতাংশ কমিশনের ভিত্তিতে আরও প্রায় শতকোটি টাকার উন্নয়নকাজ বড় ঠিকাদারের কাছে বিক্রি করে দেন।
স্থানীয় সরকার আইন, ২০০৯ (সিটি কর্পোরেশন)-এর ধারা ৯(২) অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি মেয়র বা কাউন্সিলর পদে নির্বাচিত হওয়ার অথবা মেয়র বা কাউন্সিলর পদে থাকার যোগ্য হবেন না, যদি তিনি বা তার পরিবারের কোনো সদস্য সংশ্লিষ্ট সিটি কর্পোরেশনের কাজ সম্পাদন বা মালামাল সরবরাহের জন্য ঠিকাদার হন। অথবা তারা এ ধরনের কাজে নিযুক্ত ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের অংশীদার হন বা সিটি কর্পোরেশনের কোনো বিষয়ে তাদের কোনো ধরনের আর্থিক স্বার্থ থাকে। কিন্তু আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বীরদর্পে ঠিকাদারি করেছেন তালুকদার খালেক।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০১২ সালে প্রথমবার বয়রা কলেজের সামনে সড়ক উন্নয়নের কাজ করেন আব্দুল খালেক। তখন তার কাজ দেখাশোনা করতেন তার ভাই জলিল তালুকদার। ২০১৮ সালে দ্বিতীয়বার মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর বেপরোয়া হয়ে ওঠেন আব্দুল খালেক। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে দরপত্র (ওটিএম) আহ্বান হলে কেসিসির প্রকৌশলীদের নির্দেশ দিতেন, নির্দিষ্ট কাজে অন্য বড় ঠিকাদাররা কেউ যাতে দরপত্র জমা না দেয়। আর দিলেও ইজিপির ফাঁকফোকর দিয়ে কাজটি তিনি দিয়ে দিতেন হোসেন ট্রেডার্সকে।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, হোসেন ট্রেডার্সের নামে আব্দুল খালেক ১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে বিআইডিসি সড়কের একাংশ, তিন কোটি ২৯ লাখ টাকা ব্যয়ে রূপসা বেড়িবাঁধ সড়ক উন্নয়ন, তিন কোটি ৫৫ লাখ টাকা ব্যয়ে কে ডি ঘোষ রোড, তিন কোটি ৩৭ লাখ টাকা ব্যয়ে পুরাতন যশোর রোড, তিন কোটি ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে সিমেট্রি রোড, চার কোটি ৫২ লাখ টাকা ব্যয়ে নিরালা আবাসিক এলাকার পাঁচটি সড়ক উন্নয়নসহ ১৭টি সড়কের ঠিকাদারি করেছেন। এছাড়া আজাদ ইঞ্জিনিয়ার্সের নামে দুই কোটি ৫১ লাখ টাকায় মুন্সিপাড়া তৃতীয় গলি, দুই কোটি ৩৫ লাখ টাকা ব্যয়ে গগণ বাবু রোড উন্নয়ন এবং তাজুল ইসলামের নামে নতুন বাজার সড়কসহ আরও সাতটি কাজ করেছেন।
উন্নয়ন কাজ মনের মতো বণ্টন
দরপত্রে অংশ নিতে ঠিকাদারি লাইসেন্স প্রয়োজন হয়। কিন্তু লাইসেন্স ছাড়াই আওয়ামী লীগ নেতাদের অন্যের নামে ঠিকাদারি কাজ দিতেন কেসিসির সাবেক এই মেয়র। জানা যায়, এ পদ্ধতিতে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এমডিএ বাবুল রানাকে তিন কোটি ৭৪ লাখ টাকার নিরালার ৮টি সড়ক উন্নয়ন, পাঁচ কোটি ৩৫ লাখ টাকা ব্যয়ে টিবি ক্রস রোড এবং বানরগাতি সড়কের কাজ দেওয়া হয়েছে। মেসার্স তাজুল ইসলাম নামের প্রতিষ্ঠানের কাজগুলো করেছেন যুবলীগ নেতা তাজুল ইসলাম। বিনিময়ে বাবুল রানাকে নগদ টাকা টাকা দিয়েছেন তিনি।
আরও জানা যায়, একইভাবে পাঁচ কোটি এক লাখ টাকা ব্যয়ে খালিশপুর ১৮ নম্বর রোড উন্নয়নের কাজ দেওয়া হয়েছে খালিশপুর থানার ৯টি ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের। শাহীদ এন্টারপ্রাইজের নামে দেওয়া কাজটি ৪০ লাখ টাকায় কিনে নেন তাজুল ইসলাম। ওই টাকা ৯ ওয়ার্ডের নেতারা ভাগ করে নেন। একইভাবে বিভিন্ন ওয়ার্ডের কাউন্সিলর, আওয়ামী লীগ নেতা ও ১৪ দলের কয়েকজন নেতাকে কাজ ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। কোনো ধরনের পুঁজি বিনিয়োগ বা অর্থ ব্যয় ছাড়াই শুধু মুখের কথায় লাখ লাখ টাকা তুলে নিয়েছেন মেয়রের ঘনিষ্ঠজনরা।
নগর ভবন থেকেই নিয়ন্ত্রণ করতেন রামপাল ও মোংলা
বাগেরহাট-৩ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন আব্দুল খালেক। কেসিসি মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর আসনটিতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তার স্ত্রী হাবিবুন নাহার। কিন্তু আব্দুল খালেকই রামপাল ও মোংলা উপজেলার সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। জানা যায়, সভা-সমাবেশে অংশ নিতে রামপালে গেলে আব্দুল খালেক ব্যবহার করতেন কেসিসির গাড়ি ও জ্বালানি। নগর ভবনে বসেই ওই দুই উপজেলার সব ঠিকাদারি কাজ ভাগবাঁটোয়ারা, টিআর বরাদ্দ, উন্নয়নকাজ কীভাবে হবে নির্দেশ দিতেন। প্রায়ই কর্মকর্তাদের ডেকে আনতেন নগর ভবনে। ওই এলাকার মাছের ঘেরগুলো ছিল সাবেক মেয়রের লোকদের নিয়ন্ত্রণে। এ এলাকায় আন্তর্জাতিক নৌ-রুট ঘষিয়াখালী চ্যানেলের টোল আদায়ের কাজ করতেন খুলনার যুবলীগ সভাপতি শফিকুর রহমান পলাশ ও সরকারি সিটি কলেজের সাবেক ভিপি ফয়েজুল ইসলাম টিটো। প্রতি মাসে এখান থেকে মেয়রের ভাগের কোটি টাকা পৌঁছে যেত।
রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের সিঅ্যান্ডএফ, ঠিকাদারি, সরবরাহ থেকে শুরু করে অনেক কাজের সঙ্গেই সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন আব্দুল খালেকের আত্মীয়রা। সবার কাছ থেকে কমিশন পেতেন প্রতিটি কাজে। তবে শেষের দুবছর স্থানীয় এমপি ও শেখ হেলালের পুত্র শেখ তন্ময় রামপাল-মোংলায় খালেকের সাম্রাজ্যে হানা দিয়ে ভাগ বসাতে সক্ষম হন।
১৫ বছরে বিপুল সম্পদের মালিক আব্দুল খালেক
২০০৮ সালে আব্দুল খালেকের বার্ষিক আয় ছিল মাত্র এক লাখ ৪০ হাজার টাকা। তার কাছে নগদ টাকা ছিল মাত্র ৫৭ হাজার ৫৫০ টাকা। সম্পদ বলতে ছিল ব্যাংকে জমা ১৬ লাখ ৯৮ হাজার টাকা, সঞ্চয়পত্র ও স্থায়ী আমানতে ২৮ লাখ টাকা। তবে গত ১৫ বছরে ফুলে-ফেঁপে উঠেছে খালেকের সম্পদ।
২০২৩ সালের হলফনামা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বর্তমানে খালেকের আয় বছরে ২৮ লাখ ১৫ হাজার ৭০২ টাকা। তার কাছে নগদ টাকা আছে চার কোটি ৭৯ লাখ টাকা। চারটি ব্যাংকে তার জমা রয়েছে এক কোটি ১৮ হাজার টাকা। এর বাইরে ৩.২১ একর কৃষিজমি, তিন কাঠা অকৃষি জমি, রাজউকের পূর্বাচলে একটি, কেডিএর ময়ূরী আবাসিকে একটি ও গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের মুজগুন্নি আবাসিকে প্লট রয়েছে।
আব্দুল খালেকের বিরুদ্ধে পাঁচ মামলা
গত ৫ আগস্টের পর আব্দুল খালেকের বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে দুটি হত্যা মামলা, একটি হত্যাচেষ্টা মামলা, একটি বিএনপি অফিস ভাঙচুর ও একটি চাঁদাবাজির। তবে কেসিসিতে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি তদন্তে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা
গত ৫ আগস্ট থেকে আব্দুল খালেক আত্মগোপনে রয়েছেন। নগরের গগণ বাবু সড়কে তার ছয়তলা বাড়ি ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। বাড়িটি এখন পরিত্যক্ত। উত্তাল সময়ে তিনি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে ছিলেন বলে জানিয়েছে নির্ভরযোগ্য সূত্র। সূত্রটি জানিয়েছে, এখনও তিনি দেশের ভেতরেই আছেন। ভিন্ন নম্বর দিয়ে কেসিসির একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলছেন।
আব্দুল খালেকের ঘনিষ্ঠ ঠিকাদারদের অনেকেরই মোবাইল ফোন বন্ধ রয়েছে। বিশেষ করে যারা সরাসরি আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তার প্রধানতম সহযোগী ছিলেন এইচএম সেলিম। তিনি বলেন, মেয়র আমার লাইসেন্স ব্যবহার করতেন। আওয়ামী লীগের অন্য নেতারাও করতেন। প্রতিবেশী হওয়ায় তার কথা আমাকে রাখতে হতো।
এদিকে সেলিমসহ সাবেক মেয়রের সহযোগী অনেক ঠিকাদারই এখনও বহাল তবিয়তে কাজ করছেন কেসিসিতে। এখন তাদের লাইসেন্স ব্যবহার করে বিএনপির কয়েকজন নেতা কাজ নেওয়ার জোর চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে জানা গেছে।
যোগাযোগ করা হলে কেসিসির প্রধান প্রকৌশলী মশিউজ্জামান খান এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।
কেসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা লস্কর তাজুল ইসলাম বলেন, অনিয়মের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে কয়েকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
কেসিসিতে সংঘটিত অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্তে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে খুলনা জেলা আইনজীবী সমিতির অ্যাডহক কমিটির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট নুরুল হাসান রুবা আমার দেশকে বলেন, চার মাস পরও এ বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ না নেওয়া হতাশাজনক। তবে পদক্ষেপ কে নেবে? আগেও যারা ছিল, এখনও তারাই ওখানে কাজ করছেন। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে পদক্ষেপ না নিলে এভাবেই ফ্যাসিবাদের দোসররা পার পেয়ে যাবে।
একদিকে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, অন্যদিকে মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি। এসব পদ ব্যবহার করে তিনি অনিয়ম ও দুর্নীতির শিখরে পৌঁছে গিয়েছিলেন। সাধারণ রাজনীতিবিদ থেকে পরিণত হয়েছিলেন টাকার কুমিরে। পরে থাকতেন সৎ, নীতি ও আদর্শবান মানুষের মুখোশ। শুধু ঘনিষ্ঠরা জানতেন তার অন্ধকার দিকের খবর।
বলছিলাম খুলনা সিটি কর্পোরেশনের (কেসিসি) সাবেক মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেকের কথা। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে তিনিও লাপাত্তা। এরপর আর প্রকাশ্যে না এলেও দলের ও কর্পোরেশনের অনেকের সঙ্গে মাঝেমধ্যে তার যোগাযোগ হয় বলে জানা গেছে। নগর ভবনকে বানিয়েছিলেন দুর্নীতির আখড়া। যদিও তার আমলে ঘটে যাওয়া অনিয়ম তদন্তে কোনো কমিটি হয়নি। তবে তার অপকর্মের সহযোগীরা এখনও রয়েছেন বহাল তবিয়তে।
ঠিকাদারিতে ভাগ্য বদল
বিপুল অর্থের মালিক হওয়ার জন্য কেসিসির ঠিকাদারিকেই বেছে নিয়েছিলেন আব্দুল খালেক। কোন কাজ কে করবে, তাও নির্ধারণ করে দিতেন তিনি। একটি সূত্র জানায়, এজন্য আগেই পাঁচ শতাংশ টাকা পৌঁছে দিতে হতো তাকে। এর বাইরে সব কাজের বিলের চেক লেখার আগেই এক শতাংশ টাকা দিতে হতো চিফ অ্যাকাউনটেন্ট মোস্তাফিজকে। না দিলে চেকে সই করতেন না মেয়র।
জানা যায়, আব্দুল খালেক মেসার্স হোসেন ট্রেডার্স, আজাদ ইঞ্জিনিয়ার্স ও মেসার্স তাজুল ইসলাম নামে তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে প্রায় ৬০ কোটি টাকার কাজ করেছেন গত কয়েক বছরে। ঠিকাদার এইচএম সেলিম (সেলিম হুজুর) এসব কাজ দেখাশোনা করতেন। এর বাইরে পাঁচ শতাংশ কমিশনের ভিত্তিতে আরও প্রায় শতকোটি টাকার উন্নয়নকাজ বড় ঠিকাদারের কাছে বিক্রি করে দেন।
স্থানীয় সরকার আইন, ২০০৯ (সিটি কর্পোরেশন)-এর ধারা ৯(২) অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি মেয়র বা কাউন্সিলর পদে নির্বাচিত হওয়ার অথবা মেয়র বা কাউন্সিলর পদে থাকার যোগ্য হবেন না, যদি তিনি বা তার পরিবারের কোনো সদস্য সংশ্লিষ্ট সিটি কর্পোরেশনের কাজ সম্পাদন বা মালামাল সরবরাহের জন্য ঠিকাদার হন। অথবা তারা এ ধরনের কাজে নিযুক্ত ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের অংশীদার হন বা সিটি কর্পোরেশনের কোনো বিষয়ে তাদের কোনো ধরনের আর্থিক স্বার্থ থাকে। কিন্তু আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বীরদর্পে ঠিকাদারি করেছেন তালুকদার খালেক।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০১২ সালে প্রথমবার বয়রা কলেজের সামনে সড়ক উন্নয়নের কাজ করেন আব্দুল খালেক। তখন তার কাজ দেখাশোনা করতেন তার ভাই জলিল তালুকদার। ২০১৮ সালে দ্বিতীয়বার মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর বেপরোয়া হয়ে ওঠেন আব্দুল খালেক। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে দরপত্র (ওটিএম) আহ্বান হলে কেসিসির প্রকৌশলীদের নির্দেশ দিতেন, নির্দিষ্ট কাজে অন্য বড় ঠিকাদাররা কেউ যাতে দরপত্র জমা না দেয়। আর দিলেও ইজিপির ফাঁকফোকর দিয়ে কাজটি তিনি দিয়ে দিতেন হোসেন ট্রেডার্সকে।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, হোসেন ট্রেডার্সের নামে আব্দুল খালেক ১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে বিআইডিসি সড়কের একাংশ, তিন কোটি ২৯ লাখ টাকা ব্যয়ে রূপসা বেড়িবাঁধ সড়ক উন্নয়ন, তিন কোটি ৫৫ লাখ টাকা ব্যয়ে কে ডি ঘোষ রোড, তিন কোটি ৩৭ লাখ টাকা ব্যয়ে পুরাতন যশোর রোড, তিন কোটি ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে সিমেট্রি রোড, চার কোটি ৫২ লাখ টাকা ব্যয়ে নিরালা আবাসিক এলাকার পাঁচটি সড়ক উন্নয়নসহ ১৭টি সড়কের ঠিকাদারি করেছেন। এছাড়া আজাদ ইঞ্জিনিয়ার্সের নামে দুই কোটি ৫১ লাখ টাকায় মুন্সিপাড়া তৃতীয় গলি, দুই কোটি ৩৫ লাখ টাকা ব্যয়ে গগণ বাবু রোড উন্নয়ন এবং তাজুল ইসলামের নামে নতুন বাজার সড়কসহ আরও সাতটি কাজ করেছেন।
উন্নয়ন কাজ মনের মতো বণ্টন
দরপত্রে অংশ নিতে ঠিকাদারি লাইসেন্স প্রয়োজন হয়। কিন্তু লাইসেন্স ছাড়াই আওয়ামী লীগ নেতাদের অন্যের নামে ঠিকাদারি কাজ দিতেন কেসিসির সাবেক এই মেয়র। জানা যায়, এ পদ্ধতিতে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এমডিএ বাবুল রানাকে তিন কোটি ৭৪ লাখ টাকার নিরালার ৮টি সড়ক উন্নয়ন, পাঁচ কোটি ৩৫ লাখ টাকা ব্যয়ে টিবি ক্রস রোড এবং বানরগাতি সড়কের কাজ দেওয়া হয়েছে। মেসার্স তাজুল ইসলাম নামের প্রতিষ্ঠানের কাজগুলো করেছেন যুবলীগ নেতা তাজুল ইসলাম। বিনিময়ে বাবুল রানাকে নগদ টাকা টাকা দিয়েছেন তিনি।
আরও জানা যায়, একইভাবে পাঁচ কোটি এক লাখ টাকা ব্যয়ে খালিশপুর ১৮ নম্বর রোড উন্নয়নের কাজ দেওয়া হয়েছে খালিশপুর থানার ৯টি ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের। শাহীদ এন্টারপ্রাইজের নামে দেওয়া কাজটি ৪০ লাখ টাকায় কিনে নেন তাজুল ইসলাম। ওই টাকা ৯ ওয়ার্ডের নেতারা ভাগ করে নেন। একইভাবে বিভিন্ন ওয়ার্ডের কাউন্সিলর, আওয়ামী লীগ নেতা ও ১৪ দলের কয়েকজন নেতাকে কাজ ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। কোনো ধরনের পুঁজি বিনিয়োগ বা অর্থ ব্যয় ছাড়াই শুধু মুখের কথায় লাখ লাখ টাকা তুলে নিয়েছেন মেয়রের ঘনিষ্ঠজনরা।
নগর ভবন থেকেই নিয়ন্ত্রণ করতেন রামপাল ও মোংলা
বাগেরহাট-৩ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন আব্দুল খালেক। কেসিসি মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর আসনটিতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তার স্ত্রী হাবিবুন নাহার। কিন্তু আব্দুল খালেকই রামপাল ও মোংলা উপজেলার সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। জানা যায়, সভা-সমাবেশে অংশ নিতে রামপালে গেলে আব্দুল খালেক ব্যবহার করতেন কেসিসির গাড়ি ও জ্বালানি। নগর ভবনে বসেই ওই দুই উপজেলার সব ঠিকাদারি কাজ ভাগবাঁটোয়ারা, টিআর বরাদ্দ, উন্নয়নকাজ কীভাবে হবে নির্দেশ দিতেন। প্রায়ই কর্মকর্তাদের ডেকে আনতেন নগর ভবনে। ওই এলাকার মাছের ঘেরগুলো ছিল সাবেক মেয়রের লোকদের নিয়ন্ত্রণে। এ এলাকায় আন্তর্জাতিক নৌ-রুট ঘষিয়াখালী চ্যানেলের টোল আদায়ের কাজ করতেন খুলনার যুবলীগ সভাপতি শফিকুর রহমান পলাশ ও সরকারি সিটি কলেজের সাবেক ভিপি ফয়েজুল ইসলাম টিটো। প্রতি মাসে এখান থেকে মেয়রের ভাগের কোটি টাকা পৌঁছে যেত।
রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের সিঅ্যান্ডএফ, ঠিকাদারি, সরবরাহ থেকে শুরু করে অনেক কাজের সঙ্গেই সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন আব্দুল খালেকের আত্মীয়রা। সবার কাছ থেকে কমিশন পেতেন প্রতিটি কাজে। তবে শেষের দুবছর স্থানীয় এমপি ও শেখ হেলালের পুত্র শেখ তন্ময় রামপাল-মোংলায় খালেকের সাম্রাজ্যে হানা দিয়ে ভাগ বসাতে সক্ষম হন।
১৫ বছরে বিপুল সম্পদের মালিক আব্দুল খালেক
২০০৮ সালে আব্দুল খালেকের বার্ষিক আয় ছিল মাত্র এক লাখ ৪০ হাজার টাকা। তার কাছে নগদ টাকা ছিল মাত্র ৫৭ হাজার ৫৫০ টাকা। সম্পদ বলতে ছিল ব্যাংকে জমা ১৬ লাখ ৯৮ হাজার টাকা, সঞ্চয়পত্র ও স্থায়ী আমানতে ২৮ লাখ টাকা। তবে গত ১৫ বছরে ফুলে-ফেঁপে উঠেছে খালেকের সম্পদ।
২০২৩ সালের হলফনামা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বর্তমানে খালেকের আয় বছরে ২৮ লাখ ১৫ হাজার ৭০২ টাকা। তার কাছে নগদ টাকা আছে চার কোটি ৭৯ লাখ টাকা। চারটি ব্যাংকে তার জমা রয়েছে এক কোটি ১৮ হাজার টাকা। এর বাইরে ৩.২১ একর কৃষিজমি, তিন কাঠা অকৃষি জমি, রাজউকের পূর্বাচলে একটি, কেডিএর ময়ূরী আবাসিকে একটি ও গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের মুজগুন্নি আবাসিকে প্লট রয়েছে।
আব্দুল খালেকের বিরুদ্ধে পাঁচ মামলা
গত ৫ আগস্টের পর আব্দুল খালেকের বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে দুটি হত্যা মামলা, একটি হত্যাচেষ্টা মামলা, একটি বিএনপি অফিস ভাঙচুর ও একটি চাঁদাবাজির। তবে কেসিসিতে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি তদন্তে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা
গত ৫ আগস্ট থেকে আব্দুল খালেক আত্মগোপনে রয়েছেন। নগরের গগণ বাবু সড়কে তার ছয়তলা বাড়ি ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। বাড়িটি এখন পরিত্যক্ত। উত্তাল সময়ে তিনি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে ছিলেন বলে জানিয়েছে নির্ভরযোগ্য সূত্র। সূত্রটি জানিয়েছে, এখনও তিনি দেশের ভেতরেই আছেন। ভিন্ন নম্বর দিয়ে কেসিসির একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলছেন।
আব্দুল খালেকের ঘনিষ্ঠ ঠিকাদারদের অনেকেরই মোবাইল ফোন বন্ধ রয়েছে। বিশেষ করে যারা সরাসরি আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তার প্রধানতম সহযোগী ছিলেন এইচএম সেলিম। তিনি বলেন, মেয়র আমার লাইসেন্স ব্যবহার করতেন। আওয়ামী লীগের অন্য নেতারাও করতেন। প্রতিবেশী হওয়ায় তার কথা আমাকে রাখতে হতো।
এদিকে সেলিমসহ সাবেক মেয়রের সহযোগী অনেক ঠিকাদারই এখনও বহাল তবিয়তে কাজ করছেন কেসিসিতে। এখন তাদের লাইসেন্স ব্যবহার করে বিএনপির কয়েকজন নেতা কাজ নেওয়ার জোর চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে জানা গেছে।
যোগাযোগ করা হলে কেসিসির প্রধান প্রকৌশলী মশিউজ্জামান খান এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।
কেসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা লস্কর তাজুল ইসলাম বলেন, অনিয়মের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে কয়েকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
কেসিসিতে সংঘটিত অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্তে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে খুলনা জেলা আইনজীবী সমিতির অ্যাডহক কমিটির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট নুরুল হাসান রুবা আমার দেশকে বলেন, চার মাস পরও এ বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ না নেওয়া হতাশাজনক। তবে পদক্ষেপ কে নেবে? আগেও যারা ছিল, এখনও তারাই ওখানে কাজ করছেন। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে পদক্ষেপ না নিলে এভাবেই ফ্যাসিবাদের দোসররা পার পেয়ে যাবে।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে বিভিন্ন মেরূকরণ। এ নির্বাচনে কোন দল ক্ষমতায় আসবে, কোন দল কার সঙ্গে সমঝোতা বা জোট করে ভোট করবেÑএসব বিষয় নিয়ে আলোচনা ও তৎপরতাও জোরদার হচ্ছে। বিশেষ করে ইসলামি দলগুলোকে নিয়ে সাধারণ ভোটারদের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট মহলে বিশেষ আগ্রহ তৈরি হয়েছে।
৬ ঘণ্টা আগেনীলের দেশখ্যাত নীলফামারী দীর্ঘদিন শোষণ করেছিল ইংরেজরা। তাদের স্থানীয় নিপীড়ক নীলকরদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিলেন উত্তরের এই জেলার চাষিরা। ২০০ বছর পর সেই নিষ্ঠুর ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করেন আওয়ামী ‘কসাই’খ্যাত আসাদুজ্জামান নূর।
১১ ঘণ্টা আগেআগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনায় জেলা প্রশাসকদেরই (ডিসি) রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ হিসেবে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকার দুজন বিভাগীয় কমিশনার এবং ৬৪ জন ডিসিসহ ৬৬ জন রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ করা হবে।
১ দিন আগেবছরের প্রায় ১০ মাস পার হলেও মাধ্যমিক স্তরের বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপানোর কাজ শুরু হয়নি। এমনকি পাঠ্যবইয়ের কনটেন্টও পুরোপুরি প্রস্তুত হয়নি; এখনো চলছে পরিবর্তন-পরিমার্জনের কাজ। এছাড়া ক্রয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদনও মেলেনি এখনো।
১ দিন আগে