শহীদ পলাশের কবর খননের সময় তিন দফা গুলি

সোহাগ কুমার বিশ্বাস, সিদ্ধিরগঞ্জ থেকে ফিরে
প্রকাশ : ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১৪: ৫২

মতিঝিল শাপলা চত্বরে ২০১৩ সালের ৬ মে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে ক্রাকডাউনে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা আহত শতাধিক মাদরাসা ছাত্র আশ্রয় নেন নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক-সংলগ্ন মাদানীনগর মাদরাসায়। নিহত কয়েক জনের লাশও বহন করে নিয়ে আসেন কেউ কেউ। ভোর ৪টা থেকে আহতরা আসতে শুরু করেন এই মাদরাসায়। সাড়ে ৬টার দিকে তাদের পিছু নিয়ে র‌্যাব ও পুলিশের একটি দলও মাদরাসায় আক্রমণ চালায়। মহাসড়ক থেকে সরাসরি গুলি ও টিয়ারগ্যাস ছুড়তে থাকে ঐতিহ্যবাহী এই দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিকে লক্ষ্য করে।

বিজ্ঞাপন

ফজরের সময় এই মাদরাসার মসজিদে নামাজ পড়তে যান আবু বকর সিদ্দিক পলাশ। মাদরাসার সামনেই বাড়ি তার। বাড়ির পাশে কুমিল্লা মেটাল ইঞ্জিনিয়ারিং নামের একটি ওয়ার্কশপ চালাতেন ২৬ বছর বয়সি পলাশ। বছর খানেক আগে বিয়ে করে ঘর-সংসার আর নিজের ছোট্ট ব্যবসায় মনোনিবেশ করেছিলেন তিনি। নামাজ পড়তে গিয়ে হতাহতদের অসহায়ত্ব দেখে ওই বাজারের সোনারগাঁও ফার্মেসির মালিক গ্রাম চিকিৎসক জহিরুল ইসলামকে আহতদের চিকিৎসার জন্য বাসা থেকে ডেকে মাদরাসায় দিয়ে বাড়িতে ফিরে আসেন পলাশ।

এরই মাঝে মাদরাসায় আক্রমণ করে র‌্যাব, পুলিশ ও বিজিবির যৌথ টিম। মুহুর্মুহু গুলি আর কাঁদানে গ্যাসে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে পুরো এলাকায়। পুলিশি হামলা থেকে বাঁচানোর আকুতি জানিয়ে মাইকিং করতে থাকে মাদরাসার ছাত্ররা। পুলিশের বুলেটের ভয় উপেক্ষা করে এলাকার শত শত মানুষের সঙ্গে রাস্তায় নামেন পলাশও। ৭টা ৪৫ মিনিটের হঠাৎ করেই থেমে যায় গুলির শব্দ। আশপাশে র‌্যাব পুলিশের উপস্থিতিও অদৃশ্য হয়ে যায়। বিষয়টি বুঝতে পলাশের সঙ্গে বেশ কয়েকজন যুবক ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের ওপর যান।

ততক্ষণে বিভিন্ন ভবনে অবস্থান নিয়েছে স্নাইপারের দল। মহাসড়কে উঠতেই অজ্ঞাত স্থান থেকে আসা গুলি লাগে পলাশের বুকের বাম পাশে। মুহূর্তেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। এ সময় পলাশের সঙ্গে ছিলেন আরিফুল ইসলাম। তিনি জানান, কয়েকজন মিলে পরিস্থিতি বুঝতে গলির পথ থেকে মহাসড়কে উঠতেই অজ্ঞাত স্থান থেকে টার্গেট করে ছোড়া গুলিতে আহত হন পলাশ। রক্তাক্ত অবস্থায় পলাশের রাস্তায় পড়ে যাওয়া দেখে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে তাদের মধ্যে। মুহূর্তেই দিগ্বিক ছুটতে থাকেন সবাই। গুলিবিদ্ধ পলাশ তখন মহাসড়কের ওপর পড়ে ছটফট করছিলেন। কিছু সময়ের মধ্যে গুলির শব্দ ফের থেমে গেলে স্থানীয় কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে পলাশকে উদ্ধার করে সিদ্ধিরগঞ্জের একটি হাসপাতালে নিয়ে যান তারা।

সকাল সাড়ে ৮টার কিছু পরে পলাশের শরীরে গুলি লাগার খবর পান তার বড় ভাই ইলিয়াস হোসেন ও মিনার হোসেন। খবর পেয়ে দৌড়ে সেই হাসপাতালে যান তারা। ততক্ষণে মহাসড়কের দেই দিক থেকে ফের আক্রমণ শুরু করে র‌্যাব-পুলিশের যৌথ বাহিনী। সংঘর্ষ উপেক্ষা করে দুই ভাই ছুটে যান হাসপাতালে। ততক্ষণে পলাশের ৩/৪ জন বন্ধুও হাসপাতালে পৌঁছায়। জরুরি বিভাগের এক কোণে ৫/৬টি লাশ পড়ে থাকতে দেখেন তারা। তার পাশেই একটি বেডের ওপর পলাশকে দেখতে পান। হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, পুলিশ হতাহতদের নিয়ে যেতে হাসপাতালের দিকে আসছে। এই ভয়ে দুই ভাইসহ পলাশের বন্ধুরা ৫/৬ জন মিলে ধরাধরি করে আহত পলাশকে নিয়ে আসেন মাদানী নগর মাদরাসায়। মাদরাসার ভেতরে তখন আহত কয়েকশ ছাত্র-জনতার আর্তনাদ।

ভোরে জহিরুল নামের যেই গ্রামচিকিৎসককে পলাশ মাদরাসায় ডেকে এনেছিলেন তিনি তখনো সাধ্যমতো চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। আহত পলাশকে দেখে ছুটে আসেন তিনি। পালস মেপে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেন। বাইরে রক্ত বের না হলেও ভেতরে রক্তক্ষরণ টের পান তিনি। জহিরুলের পরামর্শে পলাশকে ধরে সানারপাড়ের একটি হাসপাতালের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু ক্রমেই পলাশের দেহ ভারী হয়ে উঠছিল। মহাসড়কের ওপর উঠলে দুই চাকার বাদাম বিক্রি করা একটি ভ্যান পরিত্যক্ত অবস্থায় দেখতে পান তারা। সেই ভ্যানে পলাশের নিথর দেহ রেখে হাসপাতালে নিয়ে যান। হাসপাতালের চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। সেখানেও ৮/৯টি লাশের পাশাপাশি আহত অসংখ্য মানুষকে কাতরাতে দেখেন পলাশের ভাই ইলিয়াস।

হাসপাতালের বাইরে তখনো মুহুর্মুহু গুলির শব্দ। পুলিশ নিয়ে যাবে এই শঙ্কায় তড়িঘড়ি করে লাশটি নিয়ে ফের দুই চাকার ভ্যান গাড়িতে তুলে বাড়িতে চলে আসেন তারা। পরে চারপাশে সীমানা প্রাচীরে ঘেরা বাড়ির প্রধান ফটক আটকে বারান্দায় লাশ রেখে সেখানেই ৭/৮ জন মিলে কোনোমতে জানাজা পড়া হয়। অন্যদিকে পলাশের দোকানের কর্মচারী রিয়াজ, হালিম, মানিক স্থানীয় আরও দুজন মিলে বাড়ির পাশের কবরস্থানে কবর খনন করতে থাকেন।

রিয়াজ বর্তমানে মালয়েশিয়া আছেন। মোবাইল ফোনে তিনি জানান, তিনজন মিলে যখন কবর খুড়ছিলেন তখন কবরস্থান লক্ষ্য করে তিন দফায় গুলি চালায় পুলিশ। এ সময় কবরের গর্তে শুয়ে রক্ষা পান তারা। জানাজা শেষে তড়িঘড়ি করে লাশটি মাটিচাপা দেওয়া হয়। পুলিশ লাশ তুলে নিয়ে যেতে পারে এমন আশঙ্কায় কবর দেওয়ার রীতিনীতি মানতে পারেননি স্বজনরা। কোনোমতে মাটিচাপা দিয়ে কবরের মাটি সমান করে ওপরে লতাপাতা বিছিয়ে দেন পরিবারের সদস্যরা।

পলাশের কথা উঠতেই কণ্ঠ ভারী হয়ে ওঠে বৃদ্ধ মা রোকেয়া খাতুনের। কিছু সময়ের মধ্যেই বেরিয়ে আসে বাঁধভাঙা চোখের পানি।

তিনি জানান, সন্তান হত্যার বিচার তো দূরের কথা সন্তানের লাশের পাশে বসে কান্নাও করতে পারেননি তিনি। এক সন্তানের মৃত্যুর পর অন্য সন্তানদের নিরাপত্তা নিয়েও শঙ্কিত ছিলেন এই বৃদ্ধ মা। পলাশের মায়ের সঙ্গে কথা বলার সময় পাশে বসে নীরবে চোখের পানি ফেলছিলেন বড় বোন পারভীন আক্তার।

পলাশের বড় ভাই ইলিয়াস হোসেন জানান, ভাইয়ের মৃত্যুর পর নতুন নির্যাতন নেমে আসে পরিবারের ওপর। ওইদিন রাত থেকেই নিয়মিত পুলিশের কথিত অভিযান শুরু হয় তাদের বাড়িতে। বাধ্য হয়ে বাড়ি ছেড়ে যেতে হয় ইলিয়াস ও তাদের বড় ভাই মিনার হোসেনকে। বাড়িতে কোনো পুরুষ সদস্য থাকতে পারেননি দুই মাস ধরে। পুলিশি হয়রানি এড়াতে অন্য ভাড়াটিয়ারাও বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন। সিদ্ধিরগঞ্জ থানার উপ-পরিদর্শক শওকতের দায়িত্ব ছিল তাদের বাড়ি নজরদারিতে রাখা। দুই মাস পরে তিন দফায় শওকতকে ৫৫ হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে হয়রানি থেকে রেহাই পান তারা।

জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে বাড়ি ফিরে এসে পড়েন নতুন বিড়ম্বনায়। নারায়ণগঞ্জের আলোচিত ৭ খুন মামলার অন্যতম আসামি নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেন তাদের নিয়মিত হুমকি-ধমকি দিতে থাকেন। পুলিশের গুলিতে নিহতের ঘটনা আড়াল করে বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মীরা পলাশকে হত্যা করেছে এই মর্মে এলাকার বিএনপি ও জামায়াত নেতা-কর্মীদের নামে মিথ্যা মামলা করতে চাপ দেয় নূর হোসেন। তাদের কথামতো থানায় মামলা না করলে পলাশের ভাই ইলিয়াস ও মিনারকে মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার হুমকি দেয় সে। নূর হোসেনের ভয়ে ফের এলাকা ছাড়তে হয় তাদের। সে দফায়ও মাসখানেক লুকিয়ে থাকতে হয় দুই ভাইকে।

সানারপাড় বাজারের লিমা ফার্মেসির ফার্মাসিস্ট মোশাররফ হোসেন জানান, ঘুম থেকে উঠতেই কয়েকজন মাদরাসা শিক্ষার্থী তাকে ডাকতে আসেন। বলেন, মাদরাসায় অনেক আহত শিক্ষার্থী আছে তাদের চিকিৎসা দিতে হবে। চিকিৎসাবিদ্যায় নিজের সামান্য জ্ঞান নিয়ে ছুটে যান মাদরাসায়। এ সময় যে ঘরে হতাহতদের রাখা হয়, সেখানে রক্তের ঢেউ খেলছিল। বাইরে গুলির শব্দ আর কাঁদানে গ্যাসের কারণে আতঙ্ক ছড়িয়েছিল পুরো এলাকায়। দুপুর পর্যন্ত সেখান থেকেই চিকিৎসা করার চেষ্টা করেন তিনি। সকাল ৯টার দিকে পলাশকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় নিয়ে আসেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

এলাকার মুরব্বি হিসেবে পরিচিত আব্দুস সাত্তার। পরিবার ও দোকান কর্মচারীদের বাইরে একমাত্র তিনিই পলাশের জানাজায় অংশ নিয়েছিলেন। এই খবর প্রচার হলে তার জীবনে নেমে আসে রাষ্ট্রীয় নির্যাতন। তিনি জানান, পলাশের পরিবারের পুরুষ সদস্যরা পালিয়ে রক্ষা পেলেও তিনি পাননি। জানাজায় অংশ নেওয়ায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের দুটি মামলা হয় তার বিরুদ্ধে। এসব মামলায় কয়েক মাস জেলও খাটতে হয় তাকে। অবশেষে দালাল ধরে পুলিশকে ৩ লাখ টাকা দিয়ে হয়রানির হাত থেকে রক্ষা পেলেও মামলার ঘানি আজও টানতে হচ্ছে।

হেফাজতে ইসলামের সাংগঠনিক সম্পাদক ও মাদানীনগর মাদরাসার শিক্ষক মুফতি বশিরুল্লাহ জানান, আওয়ামী লীগ ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা প্রায়ই বলতেন এত মানুষ মারা গেছে লাশ কোথায়? তাদের সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকার শহীদ পরিবারগুলোর সঙ্গে দেখা করার অনুরোধ জানান তিনি। বলেন, ওই দিন এই এলাকায় পুলিশের গুলিতে পলাশসহ ১৯ জন শহীদ হয়েছিল। একটি পরিবারও তাদের স্বজন হারানোর শোক পালন করতে পারেনি। ধর্মীয় রীতি মেনে দাফন করতে পারেনি কেউ। শহীদ পরিবারের সদস্যদের মামলার আসামি করে এলাকা ছাড়া করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের শিকার হওয়া পরিবারগুলো এখনো ভীত-সন্ত্রস্ত।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়:

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত