জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের স্মৃতিকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে চিরজাগরিত রাখার জন্য ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘর’ স্থাপনের উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রথম দিকে ঢিলেঢালা কাজ হলেও এটি এখন দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি ৬০ শতাংশ এগিয়েছে।
জাদুঘর প্রতিষ্ঠার কাজে সংশ্লিষ্ট আর্কাইভ ও কালেকশন টিম ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আন্দোলনের স্থিরচিত্র, বিভিন্ন স্মারক, নানা উপকরণ, শহীদদের জামা-কাপড়, চিঠি, গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র, ওই সময়ের গণমাধ্যমের বিভিন্ন পেপার কাটিং, অডিও ও ভিডিও সংগ্রহ করছেন।
দেশের বাইরে যারা এই অভ্যুত্থানে ভূমিকা রেখেছেন তাদের কাছ থেকেও বিভিন্ন স্মারক সংগ্রহের কাজ চলছে। অনেকেই বিদেশ থেকেও সাড়া দিয়েছেন। সবাই যাতে ওই জাদুঘরে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে উপকরণ প্রদান করেন-* এ জন্য অন্তর্বর্তী সরকার একটি বিজ্ঞাপনও সম্প্রচারের উদ্যোগ নিয়েছে। কর্তৃপক্ষ বলছে, স্মৃতি জাদুঘর চলতি বছরের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে উদ্বোধনের সম্ভাবনা রয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ওই জাদুঘর উদ্বোধন করবেন। এই জাদুঘর ৩৬ জুলাইয়ের পটভূমি জাতিকে স্মরণ করাতে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে।
গণঅভ্যুত্থানে ভারতে পালিয়ে যাওয়া স্বৈরাচার শেখ হাসিনার বাসভবন ছিল গণভবন। রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে অবস্থিত ওই গণভবন গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতা দখলে নেয়। তখন ওই বাসভবন ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। ছাত্র-জনতা ওই গণভবন দখলে নেওয়ার আগেই গণভবন ত্যাগ করেন হাসিনা। ২০২৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের পঞ্চম বৈঠকে জুলাই গণঅভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেই জাদুঘরটি গণভবনে স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ওই ঐতিহাসিক স্থাপনাটিকে জনগণের স্মৃতিরক্ষার স্থান হিসেবে সংরক্ষণ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘর’হিসেবে রূপান্তর করার পরিকল্পনা করা হয়। এরই অংশ হিসেবে গত ১ জুন শহীদ ওয়াসিম আকরামের গ্রামের বাড়ি কক্সবাজারের পেকুয়া থেকে স্মারক সংগ্রহ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী আমার দেশকে বলেন, ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার কাজ এগিয়ে চলছে। আশা করছি, আগামী ৫ আগস্টের আগেই সেটি উদ্বোধন করা সম্ভব হবে।’
জাদুঘরের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জুলাই গণঅভ্যুত্থান স্মৃতির বিভিন্ন স্মারক সংগ্রহের জন্য আর্কাইভ ও কালেকশন টিম গঠন করা হয়েছে। ওই টিম ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছেন। যারা আন্দোলনে শহীদ হয়েছেন তাদের বিভিন্ন স্মৃতি স্মারক সংগ্রহ করা হচ্ছে। এ ছাড়া সাধারণ জনগণের তথ্যের ভিত্তিতে তারা বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছেন এবং উপকরণগুলো সংগ্রহ করছেন।
সূত্র জানায়, জাদুঘরের স্থান গণভবনের বাইরের স্থান যেভাবে আছে, সেভাবেই রাখা হবে, যাতে এটি অতীতের ঘটনার স্মৃতিস্মারক হয়ে থাকে। নির্যাতিত মানুষের দ্রোহের আগুন কতটা ক্ষোভ সঞ্চারিত হয়েছিল সেটি নতুন প্রজন্মকে মনে করানোর জন্য বাইরের অবস্থা সেভাবেই রাখা হবে। ভাঙা অংশ কোনো ধরনের মেরামত করা হবে না।
সূত্র জানায়, গণভবনের হলরুমে থাকবে চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ছবি সেখানে প্রদর্শন করা হবে। পাশেই বড় পর্দায় ভিডিও প্রদর্শন করা হবে। ইতোমধ্যে ওই ভিডিওর নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। এছাড়া আলাদা গ্যালারিতে শহীদদের বিভিন্ন স্মারক ও গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র দেয়ালে লিপিবদ্ধ করা হবে। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, স্বল্প মূল্যে টিকিট দিয়ে যে কেউ ওই জাদুঘর পরিদর্শন করতে পারবেন।
গত মঙ্গলবার সরেজমিনে প্রস্তাবিত জুলাই গণঅভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘর (গণভবন) ঘুরে দেখা গেছে, ঢোকার দুই গেটে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সদস্যরা প্রহরা দিচ্ছেন। অনেক পথচারীকে গেটের সামনে ছবি তুলতে দেখা গেছে। পশ্চিমদিকে ভাঙা কয়েকটি গাছ পড়ে থাকতে দেখা গেছে। যে সব দেয়াল বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা ভেঙে দিয়েছে সেই দেয়ালে কাঁটাতারের বেড়া লাগানো হয়েছে। কাঁটাতারের বেড়া এমনভাবে লাগানো হয়েছে, যাতে কেউ প্রবেশ করতে না পারে। এ ছাড়া প্রস্তাবিত গণভবনের আশপাশে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরো বাড়ানো হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নিরাপত্তারক্ষী জানান, গণভবন প্রস্তাবিত জাদুঘর ঘোষণা করার পর, এর নিরাপত্তা ব্যবস্থা বাড়ানো হয়েছে। গণভবন এখন সবার আগ্রহের বস্তু। পথচারীরা সড়ক দিয়ে হেঁটে গেলে কেউ থমকে দাঁড়িয়ে গেটে দাঁড়ায়। অনেকেই গেটের সামনে চলে আসে। তাদের সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।