চট্টগ্রামের বাকলিয়া, বায়েজিদ, রাউজান ও চান্দগাঁও এলাকার সাধারণ মানুষ এখন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। স্থানীয়রা বলছেন, এগুলো এখন ‘নো গো জোন’, যেখানে সাধারণ মানুষ রাতের বেলায় বের হতে ভয় পান। গত দেড় বছরে কমপক্ষে ২২টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, রাজনৈতিক ছত্রছায়া ও প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তায় অপরাধীরা সেখানে গড়ে তুলেছে নিরাপদ আশ্রয়।
পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) ও থানা পুলিশের পৃথক তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরে চট্টগ্রামের চারটি এলাকায় খুন যেন নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে রাউজানই এখন সবচেয়ে ভয়ংকর ‘হটস্পট’। উপজেলাটিতে দলীয় আধিপত্য ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে গত দেড় বছরে খুনের শিকার হয়েছেন ১৪ জন। অধিকাংশ ঘটনার সঙ্গে স্থানীয় সন্ত্রাসী আজিজ গ্রুপ, রায়হান গ্রুপ ও বিএনপি ঘেঁষা একাধিক বাহিনীর নাম উঠে এসেছে পুলিশের তালিকায়।
চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম সান্তু আমার দেশকে বলেন, রাউজানে সাতটি সন্ত্রাসী গ্রুপ সক্রিয়। আমরা তাদের ওপর নজর রাখছি, প্রতিদিন অভিযান চালিয়ে অস্ত্র উদ্ধার করা হচ্ছে। কোনো ছাড় দেওয়া হচ্ছে না।
রাউজান থানার তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে ১৭টি খুন সংঘটিত হয়েছে। এর মধ্যে ১৪টি ছিল সরাসরি রাজনৈতিক বিরোধকেন্দ্রিক। সবশেষ রাজনৈতিক বিরোধে যুবদলকর্মী আলমগীর আলম নিহত হন। তার আগে ৭ অক্টোবর
হাটহাজারীর মদুনাঘাটে বিএনপিকর্মী আবদুল হাকিমকে (৫২) গুলি করে হত্যা করা হয়।
রাউজানের খামারবাড়ি থেকে ফেরার পথে চলন্ত গাড়িতে ওঁৎ পেতে থাকা অস্ত্রধারীরা গুলি করে তাকে হত্যা করে। ঘটনাস্থল জনবহুল হলেও হামলাকারীরা নির্বিঘ্নে পালিয়ে যায়। এখন পর্যন্ত এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি।
থানা সূত্র জানায়, আর অনেকে রাজনৈতিক টার্গেট কিলিংয়ের তালিকায় রয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন বিএনপির কমর উদ্দিন, ইব্রাহিম, মানিক আবদুল্লাহ, মুহাম্মদ সেলিম, দিদারুল আলম ও স্থানীয় ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলম।
অন্যদিকে বাকলিয়া ও বায়েজিদ—এ দুই এলাকাই এখন সশস্ত্র নেটওয়ার্কের নিয়ন্ত্রণ, প্রতিশোধ ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সহিংস লড়াইয়ের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছে। বাকলিয়া এলাকায় গত এক বছরে অন্তত তিনটি খুন হয়েছে, যার মধ্যে দুটি ছিল পূর্বপরিকল্পিত ও প্রকাশ্য সড়কে সংঘটিত। ২৯ মার্চ রাতে রাজাখালী এলাকায় মোটরসাইকেলে আসা সন্ত্রাসীরা প্রাইভেটকারে গুলি চালিয়ে বখতেয়ার হোসেন মানিক ও মো. আব্দুল্লাহকে হত্যা করে। অভিযোগ পাওয়া গেছে, হামলার নির্দেশ দেয় চট্টগ্রামের আলোচিত সন্ত্রাসী সাজ্জাদ আলী খান ওরফে বড় সাজ্জাদ, আর তার সহযোগিতায় কারাগারে থাকা ছোট সাজ্জাদ ও রাউজানের সন্ত্রাসী রায়হান আলম পুরো অপারেশন পরিচালনা করে।
এরপর ২৮ অক্টোবর রাত ২টার দিকে বাকলিয়া এক্সেস রোডের বগার বিলমুখ এলাকায় প্রকাশ্যে গোলাগুলিতে নিহত হন ছাত্রদল নেতা মো. সাজ্জাদ। তিনি নগর যুবদলের বিলুপ্ত কমিটির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক (বহিষ্কৃত) এমদাদুল হক বাদশার অনুসারী ছিলেন। স্থানীয়রা জানান, রাতের নীরবতা ভেঙে প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে গুলির শব্দ শোনা যায়; তখন কেউ ঘর থেকে বের হওয়ার সাহস পাননি।
বায়েজিদে পাহাড় সংলগ্ন মহল্লাগুলোতে সশস্ত্র গ্রুপগুলোর আধিপত্য নিয়ে তিনটি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। রাতে মোটরসাইকেল বহরসহ অস্ত্রধারী যুবকরা ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে। একাধিক ভাইরাল ভিডিওতে দেখা গেছে, তরুণরা হাতে বিদেশি অস্ত্র নিয়ে ‘এলাকা দখলের’ ঘোষণা দিচ্ছে এবং প্রতিপক্ষকে সতর্ক করছে। সর্বশেষ গত ৫ নভেম্বর বায়েজিদের চালিতাতলী এলাকায় বিএনপির প্রার্থী এরশাদ উল্লাহর নির্বাচনি প্রচারে প্রকাশ্যে পিস্তল ঠেকিয়ে সরওয়ার বাবলাকে হত্যা করা হয়।
চান্দগাঁওয়ে গত এক বছরে দুজনকে হত্যা করা হলেও অস্ত্র প্রদর্শন ও মাদক কারবারের বিস্তার সবচেয়ে বেশি। এখানে শহিদুল ইসলাম বুইস্যা গ্রুপ সক্রিয়। ২০২৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর পাঠানিয়াগোদায় একটি স্পোর্টস জোনের নতুন টার্ফ উদ্বোধনের সময় সংঘর্ষে জুবায়ের উদ্দিন বাবু নিহত হন। এছাড়া চলতি বছরের ৬ সেপ্টেম্বর আকিব নামে এক প্রবাসীকে বাসার কাছে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
এ ঘটনার আতঙ্ক কাটতে না কাটতেই ২১ জুলাই এলাকায় আবারও গুলির শব্দে কেঁপে ওঠে চান্দগাঁও। সেদিন ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে পরিচিত ইসমাইল হোসেন ওরফে টেম্পো এবং শহিদুল ইসলাম ওরফে বুইস্যা বাহিনীর মধ্যে প্রকাশ্যে গোলাগুলি হয়। ভয়ে তখন বাসিন্দারা ঘর থেকে বের হতে পারেননি।
এসব এলাকার পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, স্থানীয়দের রাতের জীবন প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। রাত ৯টার পর রাস্তায় মানুষ চলাচল একেবারেই কমে যাচ্ছে। আতঙ্কে দোকানপাটে আগেভাগেই শাটার নামিয়ে দেন ব্যবসায়ীরা। অভিভাবকরা সন্তানদের রাতের টিউশন বা খেলাধুলায় পাঠাতে ভয় পাচ্ছেন। একাধিক বাসিন্দা জানিয়েছেন, আগে যেখানে রাত ১১টা-১২টা পর্যন্ত মানুষ চলাফেরা করত, এখন ৮টার পরই এলাকা ফাঁকা হয়ে যায়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তা মনে করেন, এগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন অপরাধ নয়; বরং অস্ত্র ব্যবসা, মাদক লেনদেন ও রাজনৈতিক আশ্রয়ে গড়ে ওঠা একটি সহিংস নেটওয়ার্কের শক্তি প্রদর্শন এবং এলাকায় আধিপত্য বজায় রাখার কৌশল। সবাই জানেন কারা এসব ঘটাচ্ছে; কিন্তু এলাকায় এমন প্রভাবশালী মহল রয়েছে, যারা তাদের ধরার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
পুলিশ বলছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সন্ত্রাসীদের ‘শো অফ’ নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। কেউ কেউ প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে ছবি ও ভিডিও পোস্ট করছে, খুনের পরিকল্পনার অডিও ভাইরাল হচ্ছে। সাম্প্রতিক এক ঘটনায় হুমকি দেওয়ার পরদিনই প্রকাশ্যে খুন করার উদাহরণ রয়েছে। গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের ভাষায়, এগুলোই অপরাধ নেটওয়ার্কের দুঃসাহসের স্পষ্ট প্রমাণ।
এসব অপরাধের পেছনে রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ারও তথ্য মিলছে। এমনকি পুলিশের খাতায় থাকা সন্ত্রাসীরা রাজনৈতিক নেতাদের কাছে গিয়ে ছবি তুলছেন, তা আবার ফেসবুকে প্রচারও করছেন। কেউ কেউ নির্বাচনি গণসংযোগে চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের নিয়ে যাচ্ছেন।
চট্টগ্রামের পুলিশ কমিশনার হাসিব আজিজ এ বিষয়ে বলেন, সন্ত্রাসীদের ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। গত ৯ মাসে ১১২ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এছাড়াও নগরে ১৯ শীর্ষ সন্ত্রাসী ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি-চীনের ৩০ জনসহ মোট ৩৯ শীর্ষ সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ সময়ে সাত কোটি ১২ লাখ টাকার মাদক জব্দ এবং বিভিন্ন মামলায় আড়াই হাজার আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে।
অন্যদিকে নগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক শওকত আজম অভিযোগ করেন, সহিংসতার পেছনে রাজনৈতিক রঙ ব্যবহার করে মৌলবাদী গোষ্ঠী সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দিচ্ছে। তিনি বলেন, বিএনপির সঙ্গে এসব সন্ত্রাসীর কোনো সম্পর্ক নেই। অনেক ক্ষেত্রে বিএনপির নাম ব্যবহার করে অপরাধীরা সুবিধা নিচ্ছে; কিন্তু রাজনৈতিকভাবে তাদের সঙ্গে দলের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।
শওকত আজম আরো দাবি করেন, খুনের ঘটনাগুলোতে বিএনপিকে জড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করতেই এসব করা হচ্ছে। তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিরপেক্ষ ভূমিকা নিয়ে প্রকৃত অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানান।