নবীনগর সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়
বৃহত্তর কুমিল্লা অঞ্চলের সবচেয়ে প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়। আজ থেকে প্রায় ১২৯ বছর আগে নবীনগর আদালতের তৎকালীন আইনজীবী আব্দুস সোবান মিয়া বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে শতাব্দীকাল ধরে স্থানীয় জনগণের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
উনিশ শতকের শেষদিকে স্থানীয় জনগণ যখন আধুনিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত ও কুসংস্কারে নিমজ্জিত, তখন মুরাদনগর উপজেলার ভুবনগড় গ্রামের বাসিন্দা আব্দুস সোবান এলাকায় একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। তার এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে স্থানীয় জমিদার কৃষ্ণমোহন রায় চৌধুরী ও নবীনগর আদালতের মুন্সেফ কালীনাথ ধরসহ এলাকার জনসাধারণ এগিয়ে আসেন। ১৮৯৬ সালের ডিসেম্বরে ৫০ শিক্ষার্থী নিয়ে ৫.৪৬ একর জায়গায় তৎকালীন ত্রিপুরা জেলার অধীন নবীনগর হাই ইংলিশ বিদ্যালয় নামে যাত্রা শুরু করে। পরবর্তী বছর শিক্ষার্থী সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৬তে দাঁড়ায়। ১৯১০ সালে বিদ্যালয়টিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা হয় ৩৮৯ জন।
বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমানের শাসনামলে একটি পাইলট প্রকল্পের আওতায় বিদ্যালয়টির নামকরণ করা হয় নবীনগর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়। প্রকল্পটি ১৯৮৪ সালে বাস্তবায়িত হয়। এর প্রায় সাড়ে তিন দশক পর ২০১৮ সালের ৭ মে বিদ্যালয়টি সরকারিকরণ হয়। বর্তমানে এতে ৩৮ জন শিক্ষক এবং ছয়জন অফিস সহকারী রয়েছেন। বিদ্যালয়টিতে বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা, মানবিক ও কারিগরি শাখায় এখন প্রায় দেড় হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে।
আখাউড়া উপজেলার ধরখার ইউনিয়নের রুটি গ্রামের বাসিন্দা প্যারিচরণ দাস বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া একজন সহকারী প্রধান শিক্ষকসহ সাতজন ইংরেজি শিক্ষক, দুজন পণ্ডিত ও একজন মৌলভি নিয়োগ দেওয়া হয়। স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা আব্দুস সোবহান ফার্সি ভাষার শিক্ষক (অবৈতনিক) হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন।
প্রতিষ্ঠার পর শুরুর দিকে শিক্ষার্থীদের প্রদত্ত ফি দিয়ে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য ব্যয় সংকুলান হতো না। তখন বিদ্যালয়ের জন্য জেলা বোর্ড থেকে প্রতি মাসে ৩০ টাকা এবং স্থানীয় বার লাইব্রেরি থেকে ২৫ টাকা অনুদান দেওয়া হতো। এছাড়া স্থানীয় জমিদার, আইনজীবী, ঢাকার নওয়াব ও ত্রিপুরার মহারাজাও বিদ্যালয়ের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করতেন।
প্রতিষ্ঠার পরের বছর ৩০টি ভলিউম বইসহ ১৭০টি বই নিয়ে বিদ্যালয়ে একটি লাইব্রেরি চালু করা হয়। বর্তমানে এই লাইব্রেরিতে কয়েক হাজার বই রয়েছে। বিদ্যালয় থেকে দূরবর্তী শিক্ষার্থীদের জন্য ১৮৯৯ সালে বিদ্যালয়ে ছাত্রাবাস স্থাপন করা হয়। সেখানে হিন্দু ও মুসলমান উভয় ধর্মের শিক্ষার্থীর জন্য আলাদা থাকার ব্যবস্থা করা হয়।
শিক্ষার্থীদের শরীরচর্চা ও খেলাধুলায় পারদর্শী করে তোলার জন্য ১৮৯৮ সালে ৫২ জন ছাত্র নিয়ে গঠন করা হয় নবীনগর স্পোর্টিং ক্লাব। কয়েক দশক পর ১৯২৭ সালে স্কুলের স্কাউট দল গঠন করা হয়, যা পরবর্তী বছর কলকাতা গড়ের মাঠে অনুষ্ঠিত নিখিল বঙ্গ স্কাউট জাম্বুরিতে অংশগ্রহণ করে। এছাড়া করাচি, লাহোর, মৌচাক ও পাকিস্তান স্কাউট জাম্বুরিতে অংশগ্রহণ করে বিশেষ কৃতিত্বের অধিকারী হয়।
বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন পরিচালনা কমিটিতে স্থানীয় আদালতের প্রথম মুন্সেফ কালীনাথ ধর পদাধিকার বলে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া দ্বিতীয় মুন্সেফ, জমিদার পরিবারের তিনজন সদস্য, স্থানীয় বারের দুজন উকিল, দুজন সেরেস্তাদার, সাব-রেজিস্ট্রার, দাতব্য চিকিৎসালয়ের ডাক্তার ও নবীনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা স্কুল পরিচালনা কমিটির সদস্য ছিলেন।
এই বিদ্যালয়ের অনেক ছাত্র ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন এবং বেশ কয়েকজন শহীদ হন। তাদের মধ্যে শহীদ মো. হোসেন (মাঝিকাড়া), শহীদ আব্দুস সালাম (কনিকাড়া), শহীদ মোকাদ্দুস মিয়া (সাহেবনগর), শহীদ আবদুল মান্নান কেনু মিয়ার (শ্রীরামপুর) নাম উল্লেখযোগ্য। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আলিয়াবাদ গ্রামের বাসিন্দা আবদুস সালাম মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে বীরবিক্রম উপাধি লাভ করেন।
ভাষা আন্দোলনের অন্যতম নেতা সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। মন্ত্রিপরিষদের সাবেক কেবিনেট সচিব ও অর্থ উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান, শিক্ষক নেতা অধ্যাপক এম শরিফুল ইসলাম, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক এবং সাবেক সিনেট সদস্য অধ্যাপক ড. সুব্রত গুপ্ত, সাবেক এমপি কাজী আকবর উদ্দিন সিদ্দিক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আমিনুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. সরোয়ার হোসেন এবং কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সুপার নিউমারারি অধ্যাপক মোহাম্মদ শাহজাহান চৌধুরী এই বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছিলেন।
বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক শহিদুল হক মানিক জানান, তিনি ১৯৫৫ থেকে ৬১ সাল পর্যন্ত এই বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। পরে ১৯৮৫ সালে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ২০০৮ সালে অবসর গ্রহণ করেন।
তিনি বলেন, এই বিদ্যালয়ের সঙ্গে আমার আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে। বিদ্যালয়ের জন্মলগ্ন থেকে অনেক উচ্চশিক্ষিত, জ্ঞানী-গুণী ও প্রতিভাবান আদর্শ ব্যক্তিত্ব শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করে অসংখ্য কীর্তিমান মানুষ গড়েছেন। যুগ যুগ ধরে এ বিদ্যাপীঠ জ্ঞানের আলোকবর্তিকা প্রদীপ্ত করে রেখেছে।