বিশেষজ্ঞ মতামত
রাজধানীর আগারগাঁওয়ের একটি অস্থায়ী বাজারে ব্রয়লার মুরগি কিনতে এসে মধ্যবয়সি এক নারী বেশ কয়েকবারই জোর দিয়ে দোকানদারকে বলছিলেন, ‘একটা বড় মুরগি দেন, দুই কেজির বেশি হলে ভালো হয়।’ কেন এমন পছন্দ-জানতে চাইলে তিনি পরিষ্কার কোনো যুক্তি দিতে পারেননি। তবে খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, তিনি কারণ না জানলেও সিদ্ধান্তটি ঠিকই নিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্রয়লার মুরগি কেনার সময় অবশ্যই দুই কেজির বেশি ওজনের কেনা উচিত। কারণ ওজন বেশি মানেই তা পরিণত বয়সে পৌঁছেছে। পরিণত মুরগিতে স্বাদ বেশি পাওয়া যায়, পুষ্টিগুণও বেশি থাকে। পাশাপাশি মাংস বেশি ও বর্জ্য কম হওয়ায় ভোক্তার আর্থিক লাভও বেশি।
তবে বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, পরিণত হওয়ার আগেই বাজারে বিক্রি হচ্ছে বেশিরভাগ ব্রয়লার মুরগি। এক থেকে দেড় কেজি ওজনের ব্রয়লারই বেশি বিক্রি হচ্ছে। সাধারণত ২৫-২৮ দিনের মুরগিই বাজারে তোলা হয়। অধিক মুনাফার আশায় খামারিরা পরিণত হওয়ার আগেই এসব মুরগি বিক্রি করে দেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরিণত বয়সের এসব ব্রয়লারের মাংস অনেক নরম ও পানিভর্তি হয়। এতে ভোক্তারা মুরগির প্রকৃত স্বাদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। স্বাদ না পাওয়ার কারণে অনেকে ব্রয়লার মুরগি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। এছাড়া ব্রয়লার মুরগি লালন-পালনে অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার, মুরগির খাবার হিসেবে নিম্নমানের বা ক্ষতিকর কেমিক্যালযুক্ত খাদ্য ব্যবহারের কারণেও অনেকে ব্রয়লার মুরগি খাওয়ার ব্যাপারে অনীহা প্রকাশ করে থাকেন। তবুও এখন পর্যন্ত দেশের প্রোটিন চাহিদার বড় অংশই ব্রয়লার থেকেই আসে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পোল্ট্রি সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. ইলিয়াস হোসেন আমার দেশকে বলেন, আমিষের চাহিদা মেটাতে ব্রয়লারের মুরগি তুলনামূলক সহজলভ্য। ব্রয়লারের মুরগির প্রোটিনের মানও বেশ ভালো। কিন্তু পরিণত হওয়ার আগেই যেসব মুরগি বিক্রি হয়, সেগুলোর স্বাদ কম থাকে। ফলে এসব মুরগি খেয়ে তৃপ্তি পাওয়া যায় না।
তিনি বলেন, মুরগি বয়সে পরিণত হলে মায়োগ্লোবিন, ইনোসিন মনোফসফেট, অ্যামাইনো অ্যাসিডসহ নানা উপাদানের পরিমাণ বাড়ে—যা স্বাদ, রঙ ও তৃপ্তি বাড়ায়। একটি ব্রয়লার মুরগির বয়স ৩৫ থেকে ৪২ দিন হলে সবচেয়ে ভালো হয়। এ সময় মুরগির ওজন আড়াই থেকে তিন কেজি পর্যন্ত হতে পারে।
তবে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে অনেকের পক্ষে বড় ওজনের মুরগি কেনা সম্ভব নয়Ñ এটি স্বীকার করে তিনি বলেন, এক্ষেত্রে টুকরো করে মুরগি বিক্রি করা যেতে পারে। মানুষের মধ্যে এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরি হলে এটি সম্ভব বলে মন্তব্য করেন তিনি।
একই বিভাগের অধ্যাপক ড. শওকত আলী বলেন, বিভিন্ন দেশে বড় সাইজের আড়াই কেজি বা তারও বেশি ওজনের ব্রয়লারের চাহিদা বেশি। ৩৫-৪২ দিনের মুরগিতে মাংসের ফাইবার ভালো হয় এবং স্বাদও বেশি।
শুধু স্বাদই নয় পরিণত বয়সের ব্রয়লার মুরগির বর্জ্যের পরিমাণও তুলনামূলকভাবে কম হয় বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেন, কম ওজনের ব্রয়লার মুরগির ক্ষেত্রে যে পরিমাণ বর্জ্য হবে, বেশি ওজনের মুরগির ক্ষেত্রে তা কম হবে। ফলে বেশি ওজনের মুরগি ক্রয় করলে ভোক্তারা লাভবান হবেন।
এ প্রসঙ্গে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানিমেল সায়েন্স অ্যান্ড ভেটেরিনারি মেডিসিন ফ্যাকাল্টির ডিন অধ্যাপক ড. আনোয়ারুল হক বেগ বলেন, তিন সপ্তাহ পার হলেই ব্রয়লার মুরগি বিক্রি করে দেন অনেক খামারি। এতে কিন্তু খামারিরাই ক্ষতিগ্রস্ত হন। আবার ভোক্তারাও এসব ব্রয়লার কিনে ঠকেন। কারণ, যদি কোনো ভোক্তা কম ওজনের মুরগি ক্রয় করে তাহলে ৪০ শতাংশ বর্জ্য হবে এবং ৬০ শতাংশ মাংস হবে। অর্থাৎ একটি মুরগির ওজন যদি এক কেজি হয় তার বর্জ্য হবে ৪০০ গ্রাম এবং মাংস হবে ৬০০ গ্রাম। অন্যদিকে ভোক্তা যদি দুই কেজি ওজনের মুরগি কিনে, তাহলে বর্জ্য হবে ৬০০ গ্রাম এবং মাংস হবে এক হাজার ৪০০ গ্রাম। বড় ব্রয়লার মুরগিতে শুধু যে মাংস বেশি হবে, তা-ই নয়, চার সপ্তাহের পরে যত দিন যাবে ব্রয়লার মুরগির গোশত তত স্বাদ বাড়বে।
কিন্তু খামারিরা কম বয়সি মুরগি বিক্রি করছেন বেশি। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, মুরগি খামারে বেশি দিন রাখলে খাবারের খরচও বাড়বে। একই সঙ্গে পরবর্তী ব্যাচের মুরগি তুলতে দেরি হবে। কম দিন রাখলে ব্যয়ও কম হবে এবং ব্যাচের সংখ্যাও বাড়বে।
তবে বিশেষজ্ঞরা খামারিদের এ ধরনের ধারণাকে ভুল বলে মনে করছেন। তারা বলছেন, ২৮ দিনের পরবর্তী এক সপ্তাহ মুরগি কম খাবার গ্রহণ করে এবং ওজন দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ফলে খামারিরা এর আগে মুরগি বিক্রয় করলে ক্ষতির পরিমাণ বেশি থাকে। খামারিরা যদি ৩২ থেকে ৩৫ দিন বয়সি অর্থাৎ দুই থেকে আড়াই কেজি ওজনের মুরগি বিক্রি করে তাহলে ভোক্তা ও খামারি উভয়েই লাভবান হবে।