অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে দেশের পোশাক খাত। একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কারখানা, বেকার হচ্ছেন হাজার হাজার শ্রমিক। ছোট, মাঝারি কিংবা বড়—সব শিল্পেই চলছে সংকট। এ সংকটের শুরু বিগত হাসিনা সরকারের আমলে, ২০২৩ সাল থেকে। সে সময় হাতেগোনা কিছু কারখানা বন্ধ হলেও ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ১০ নভেম্বর পর্যন্ত মাত্র ২২ মাস ১০ দিনে বন্ধ হয়ে গেছে ২২৬টি কারখানা। এ সময়ে বেকার হয়েছেন দুই লাখের বেশি শ্রমিক।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্যাসের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি পরিবর্তনের ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারছে না এ শিল্প খাতটি। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে হাসিনার আমলে এক লাফে শিল্পে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম বাড়ানো হয় প্রায় ১৫০ শতাংশ। এতে তখন থেকেই অনেক কারখানা নিয়মিত গ্যাস বিল দিতে পারছিল না। বর্তমান সরকারের আমলে ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কৌশল হিসেবে এবং দাতা সংস্থাগুলোর পরামর্শে ঋণের সুদহার এক লাফে ৯ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ করা হয়। সে সঙ্গে খেলাপি ঋণ সংজ্ঞায়িত হওয়ার সময়সীমা ছয় মাস থেকে তিন মাসে নামিয়ে আনা হয়। এতে শত শত কারখানা মালিক খেলাপি হয়ে যান।
ব্যাংকঋণের চড়া সুদহার এবং খেলাপি সংজ্ঞার পরিবর্তনই মূলত একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রধান কারণ। বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান আমার দেশকে বলেন, বিপুলসংখ্যক কারখানা বন্ধ হওয়ার পেছনে মূল দায় হঠাৎ ব্যাংকঋণের সুদহার বাড়িয়ে দেওয়া এবং খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা ছয় মাস থেকে তিন মাসে নামিয়ে আনা। সে সঙ্গে বিগত সরকারের শেষ সময়ে এসে বিরাট অঙ্কের গ্যাস বিল চাপিয়ে দেওয়া হয় শিল্প খাতে। গ্যাসের চড়া মূল্য ও ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদ দিয়ে অনেকেই ব্যবসায় টিকে থাকতে পারছেন না। তার সঙ্গে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় অনেক পোশাক উদ্যোক্তা দেশ ছেড়েছেন। এ পরিস্থিতি সামনে আরো ভয়াবহ হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
বস্ত্র ও পোশাক খাতের সংগঠন বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও বিটিএমএ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে পোশাক খাতের ৭৭ কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। এসব কারখানায় মোট শ্রমিক ছিলেন ৫১ হাজার ৯৬০ জন।
২০২৪ সালে বন্ধ হওয়া উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কারখানা হচ্ছে—ক্রিয়েটিভ ডিজাইন, প্রিন্স গার্মেন্টস, রিসাল গার্মেন্টস, সিও ওয়ান বাংলাদেশ, সারোজ গার্মেন্টস, এনএইচ ফ্যাশন, অ্যাপারেল ইন্ডাস্ট্রি, সেভরন লিমিটেড, ডিও ফ্যাশন, ঢাকা নিক অ্যাপারেল, ফ্যাশন ট্রেড, এমআর অ্যাপারেল, জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশন্স, ওডাসি ক্রাফট, নিয়াগারা টেক্সটাইল, টিআরজেড গার্মেন্টস, আবান্তি কালার টেক্স ইত্যাদি।
অন্যদিকে ২০২৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেছে ১৪৯ কারখানা। এসব কারখানা থেকে চাকরি হারিয়েছেন প্রায় এক লাখ ৫০ হাজার শ্রমিক। বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানাগুলোর মধ্যে অন্যতম কয়েকটি হলো—এনএইচ ফ্যাশন লিমিটেড, শামসের রেজিয়া ফ্যাশনস লিমিটেড, অ্যাপারেল ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড, ক্যাভরন লিমিটেড, ডিউ ফ্যাশন লিমিটেড, ঢাকা নিক অ্যাপারেলস লিমিটেড, ফ্যাশন ট্রেড, এমআর অ্যাপারেলস, মাল্টিভার্স অ্যাপারেল প্রাইভেট লিমিটেড, এনআরকে ফ্যাশন লিমিটেড প্রভৃতি।
গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে হাসিনার হঠকারী সিদ্ধান্ত
২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে শিল্পের জন্য গ্যাসের দাম এক লাফে প্রতি ঘনমিটারে বাড়ানো হয় ১৪ টাকা। এর আগে ২০২২ সালের জুনে ১৩ টাকা ৮৫ পয়সা থেকে ১৬ টাকা করা হয়েছিল দাম। ২০২৪ সালেও দুই দফা দাম বাড়ানো হয়। বর্তমানে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের মূল্য ৩১ টাকা ৫০ পয়সা। বর্তমান সরকার নতুন শিল্প সংযোগে গ্যাসের দাম বাড়িয়ে ৪০ টাকা করেছে। উদ্যোক্তারা বলছেন, আগের সরকারের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত এবং বর্তমান সরকারের নতুন শিল্পের জন্য অতিরিক্ত গ্যাসের মূল্য নির্ধারণ দেশি শিল্পকে চরম সংকটে ঠেলে দিয়েছে।
আওয়ামী আমলে বিদ্যুতের মূল্যও এক লাফে তিনগুণ বাড়ানো হয়। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিদ্যুতের ইউনিটপ্রতি মূল্য পাঁচ টাকা দুই পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১৪ টাকা করা হয়। এরপর কয়েক দফা বেড়ে বর্তমানে মূল্য ১৫ টাকা ৫০ পয়সা।
ব্যাংকঋণের সুদ গুনতেই ফুরিয়ে যাচ্ছে সব আয়
বাংলাদেশ ব্যাংকের ধারাবাহিক মুদ্রানীতি পরিবর্তনের ফলে ঋণের সুদহার পূর্বের ৯ শতাংশ সীমা অতিক্রম করে ১৬-১৭ শতাংশের বেশি হয়ে গেছে, যার ফলে উদ্যোক্তা ও শিল্প খাত নজিরবিহীন ঋণব্যয়ের বোঝা বহন করতে বাধ্য হচ্ছে। উদ্যোক্তারা বলছেন, তারা যখন কারখানা স্থাপন করেন, তখন একটি পরিকল্পনা নিয়েই চালু করেন। আবার রপ্তানি আদেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে ক্রেতারা বিশ্ববাজারের প্রতিযোগী দরই অফার করেন। সেখানে দেশে গ্যাস সংকট বা মূল্য বৃদ্ধি অথবা ব্যাংকের চড়া সুদ ক্রেতাদের কাছে বিবেচ্য নয়।
ব্যবসায়ী নেতারা সতর্ক করে বলেছেন, বর্তমান ঋণ সংকট বেসরকারি খাতের আস্থা কমিয়ে দিচ্ছে এবং নতুন বিনিয়োগকে স্তব্ধ করে দিচ্ছে। তাদের মতে, ঋণের ব্যয় স্বাভাবিক পর্যায়ে না ফেরালে সরকারের বৃহত্তর অর্থনৈতিক লক্ষ্যমাত্রা ‘রপ্তানি প্রবৃদ্ধি থেকে শিল্প সম্প্রসারণ’ বিপদে পড়তে পারে। বর্তমানে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণের সুদহার ১৬-১৭ শতাংশে পৌঁছেছে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম উদ্বেগ জানিয়ে বলেন, ঋণের ব্যয় কমানো না হলে এবং জ্বালানির চড়া মূল্যের বিকল্প হিসেবে নীতি সহায়তা না বাড়ালে বিনিয়োগ বাড়বে না; ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে যাবে। এখন ১৫-১৬ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসা চালানো অসম্ভব; দুর্বল ব্যাংকগুলো আরো বেশি সুদ নিচ্ছে। তাই নীতি সুদহার কমাতে হবে, যাতে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণহারও কমে।
ঋণখেলাপি হয়ে পালিয়ে যাচ্ছেন বহু মালিক
পোশাক খাতের কয়েকশ কারখানা মালিক ঋণখেলাপি হয়ে ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন বলে জানিয়েছে বিজিএমইএ। সংগঠনের সভাপতি বলেন, প্রতিদিনই তার কাছে খবর আসে কোনো না কোনো কারখানা মালিক ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।
জানা গেছে, আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী কোনো ঋণগ্রহীতা কিস্তি বা ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে ছয় মাস পর সেই ঋণকে খেলাপি (ঋণ অপরিশোধিত) হিসেবে গণ্য করা হতো। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৫ সালে নতুন ঋণ শ্রেণিবিন্যাস নীতি জারি করেছে, যেখানে খেলাপি ঘোষণার সময়সীমা আরো কঠোর করা হয়েছে। এখন থেকে ঋণের কিস্তি বাকি থাকলে তিন মাস (৯০ দিন) পরই সেই ঋণকে খেলাপি হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে।
এদিকে আওয়ামী আমলে আর্থিকভাবে ব্যাপক সুবিধাভোগী কিছু ব্যবসায়ী নেতার কারখানাও বন্ধ হয়ে গেছে গত ২২ মাসে। এসব নেতার মধ্যে কেউ কারাগারে আছেন বিভিন্ন অপরাধে, আবার কেউ দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন।