হোম > প্রবাস

রাজনীতি, পাসপোর্ট ও শরণার্থী : বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অস্বীকৃত সন্তানদের উপাখ্যান

ড. ফারুক আমিন

ফাইল ছবি

শফিকুল ইসলামের বয়স তেত্রিশ বছর। মার্চের এক বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় সিডনির একটি রেস্টুরেন্টে বসে তিনি নিজের জীবনের কথা বলছিলেন। ষোলো বছর বয়সে বাংলাদেশ ছেড়ে মালয়েশিয়া, তারপর এক সময় মাছ ধরার নৌকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় আসা।

ঘটনাগুলো যেন সিনেমার মেলোড্রামাটিক ও ট্র্যাজিক গল্পকাহিনিকেও হার মানায়। সেদিনের পর শফিক ছাড়া আরো বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি শরণার্থীর সাথে কথা হয়েছে। প্রত্যেকেরই নিজস্ব গল্প আছে। পাশাপাশি তাদের প্রত্যেকে বলেছেন তাদের সবচেয়ে বড় কষ্টের কথা। তাদের কারো বাংলাদেশি পাসপোর্ট নেই। যদিও তারা সবাই জন্মগতভাবে এবং পিতামাতার সূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক, কিন্তু বাংলাদেশ তাদেরকে সেই নাগরিকত্বের স্বীকৃতি দেয় না।

শফিক বলছিলেন কীভাবে তিনি বারো বছর আগে একটি মাছ ধরার ছোট নৌকায় আরো প্রায় একশ মানুষের সাথে কোনোরকমে সামান্য এতটুকু জায়গায় কুঁজো হয়ে বসে ছয় দিন ও ছয় রাত খোলা আকাশের নিচে সমুদ্রে কাটিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় এসে পৌঁছেছিলেন। এ যে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত লক্ষ লক্ষ প্রবাসীরই গল্প। কিছু অর্থনৈতিক উপার্জন ও পরিবারের সদস্যদের সচ্ছল জীবন উপহার দিতে তারা বেপরোয়া হয়ে যান।

শফিকের বাবা ছিলেন একজন মালয়েশিয়া প্রবাসী শ্রমিক। স্কুলের পড়ালেখায় শফিক তেমন একটা ভালো করতে পারেননি। সুতরাং মাত্র ষোলো বছর বয়সে কাগজে কলমে বয়স বাড়িয়ে দেখিয়ে তিনি ২০০৮ সালে প্রবাসী শ্রমিক হিসেবে বাবার কাছে মালয়েশিয়ার পেনাং শহরে পাড়ি জমান। সেখানে তিনি কয়েক বছর একটি কার্ডবোর্ড কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। এ সময় পরিচিতদের কাছ থেকে শুনতে পান কোনোভাবে অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে পৌঁছতে পারলে সেই উন্নত দেশে কাজের অভাব হবে না। স্থায়ীভাবে থাকার সুযোগ পাওয়া যাবে। অনেক বেশি উপার্জন করে নিজের ও পরিবারের জীবন বদলে ফেলা যাবে।

সুতরাং সঞ্চিত সমস্ত অর্থ দিয়ে বিপুল পরিমাণের টাকা এক সময় শফিক দালালের হাতে তুলে দেন। এরপর একদিন তার মতো আরো দশ-বারো জন বাংলাদেশি শ্রমিকের সাথে বাসে করে ইন্দোনেশিয়ার শহর মেদানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে বিমানে করে আরেক দ্বীপ কাজানে। তারপর শুরু হয় অপেক্ষার পালা। দালাল জানাবে কখন সরকারি বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে নৌকায় চড়া নিরাপদ হবে। তাদেরকে বলা হয়, অনেক বড় একটা জাহাজে করে তারা নিরাপদেই অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত পৌঁছে যাবে।

অপেক্ষার পালা শেষে একদিন রাতের অন্ধকারে যখন একটি সাগরপাড়ে নিয়ে তাদেরকে নৌকায় তুলে দেয়া হয়, শফিক দেখতে পান ছোট একটা মাছ ধরার নৌকায় প্রায় দেড়শ মানুষ কোনোরকমে গায়ে গা ঘেঁষে বসে আছে। যাত্রীদের মাঝে প্রায় চল্লিশজন ছিলেন বাংলাদেশি। বাকিরা ইরান, সোমালিয়া, সিরিয়া এসব দেশের মানুষ।

তাদেরকে বলা হয়েছিলো, তিন দিন পরে এ নৌকা অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছবে। সুতরাং সবাই যেন তিন দিনের প্রয়োজনীয় শুকনো খাবার ও পানি সাথে নিয়ে নেয়। কিন্তু তিন দিন পরে তাদেরকে বলা হলো মাঝসমুদ্রে ট্রলারের মাঝি নেভিগেশনে ভুল করে পথ হারিয়ে ফেলেছে। পরদিন যার যার সাথে আনা পানি ও খাবারগুলোও শেষ হয়ে যায়।

শফিকের সাথে যেদিন কথা বলছিলাম, তার জীবনের গল্প শুনছিলাম, সাথে এসেছিলেন মোমিন। সে শফিকের সমবয়সী। একই সাথে মালয়েশিয়া থেকে নৌকায় চেপে অস্ট্রেলিয়ায় এসেছিলেন। এতদিন একই সাথে আছেন। একই সাথে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করেন। তবে মোমিন কিছুটা স্বল্পভাষী, কিছুটা লাজুক। এতক্ষণ তিনি কোনো কথা বলেননি। শফিক যখন খাবার ও পানি শেষ হয়ে যাওয়ার কথা বললেন, তখন হঠাৎ মোমিন মুখ খুললেন।

তিনি জানালেন, খাবার এবং পানি শেষ হয়ে যাওয়ার পর এক পর্যায়ে পিপাসা সহ্য করতে না পেরে তিনি সাগরের লবণাক্ত পানি পান করেন। সাথে থাকা এক সোমালীয় মানুষ তাকে দেখিয়ে দেয়, সাগরের পানি একটা পাত্রে কিছুক্ষণ রেখে দিলে না কি লবণের অংশটা নিচে নেমে যায় এবং উপরের অংশের লবণাক্ততা কমে যায়। সেই পানি পান করার পর তিনি প্রচণ্ড পেটব্যাথা ও দুর্বলতায় আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন।

সেই ভয়াবহ নৌযাত্রার কথা বলতে গিয়ে মোমিন জানান, তিল ধারণের জায়গা না থাকা সে নৌকায় তারা শেষ দিকে জীবনের আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন। কেবল জড়বস্তুর মতো বসে থাকা এবং নৌকাডুবির প্রতীক্ষাই ছিলো তাদের শেষ দুই দিনের কাজ। নৌকায় থাকা ইরানি এক শিশু প্রচণ্ড পিপাসায় দুর্বল হয়ে পড়লে তার পিতামাতা সাগরের পানি নিজেদের মুখে নিয়ে কুলকুচি করে লবণাক্ততা কমিয়ে তারপর সে বাচ্চাকে পান করাচ্ছিলেন।

এভাবে সর্বমোট ছয়দিন ছয় রাত পার করার পরও তারা জানতেন না আসলে অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছতে পারবেন কি না। দিকহারা নৌকার মাঝি অনবরত অনুমানের ওপর ভিত্তি করে নানা দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছিলো। এমনই এক সময় হঠাৎ অকূল সাগরের মাঝে তারা অস্ট্রেলিয়ান নৌবাহিনীর একটি টহল জাহাজ দেখতে পান।

পথ ভুলে হলেও ততদিনে তারা অস্ট্রেলিয়ার জলসীমায় প্রবেশ করেছেন। তাদেরকে উদ্ধার করতে অস্ট্রেলিয়ান নৌবাহিনীর প্রথম জাহাজটির সাথে আরেকটি জাহাজ এসে যোগ দেয়। দুটি জাহাজে প্রায় দেড়শ মানুষকে তুলে নিয়ে আসা হয় ডারউইন ডিটেনশন সেন্টারে। নামে জেলখানা, তবে সুযোগ সুবিধা খারাপ না। সেখানে তিন মাস থাকতে হলো। এই তিন মাসে অনেকবার সরকারি লোকজন ইন্টারভিউ নিলো। বিস্তারিত জানার চেষ্টা করলো তাদের ব্যক্তিগত জীবন ও অতীত ইতিহাস। ওখানেই একজন বুদ্ধি শিখিয়ে দিলো, কাজ করতে এসেছে বললে এদেশে রাখবে না। বলতে হবে রাজনৈতিক কারণে দেশে তাদের জীবন বিপন্ন। শফিকুলের পরিবার বিএনপি সমর্থক, তখন ছিলো আওয়ামী শাসনামল। এসবই মিলিয়ে বললেন, কিন্তু খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য হলো না এটা তিনিও বুঝলেন।

মোমিনসহ মারাত্মক অসুস্থ কয়েকজনকে এ সময় জাহাজ থেকে সরাসরি হেলিকপ্টার অ্যাম্বুলেন্সে করে পার্থ শহরের এক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। লবণাক্ত পানির প্রভাবে তার কিডনি সাময়িকভাবে বিকল হয়ে পড়েছিলো। পাশাপাশি ডিহাইড্রেশনের ফলে তার শরীরে মারাত্মক প্রভাব পড়ে। কয়েক সপ্তাহ তাকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। চিকিৎসা শেষে তাকেও ডারউইন শহরের ডিটেনশন সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়।

নানা জিজ্ঞাসাবাদ ও আনুষ্ঠানিকতার পর একদিন তাদেরকে সাময়িকভাবে থাকার জন্য ভিসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হলো। এর আগে ডিটেনশন সেন্টারে কেটেছে তিন মাস। বেশ কয়েক বছরের বিস্তারিত পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে এক সময় অস্ট্রেলিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, যার নাম ডিপার্টমেন্ট অফ হোম অ্যাফেয়ার্স, তাদের ভিসা আবেদন প্রত্যাখ্যান করে। সেই প্রত্যাখ্যানের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তারা আদালতে মামলা করেন। আদালতের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন, পার হয়ে গেছে বারো বছর। মামলা চালাতেই খরচ হয়েছে চল্লিশ হাজার ডলারের বেশি।

এই দীর্ঘ সময়ে শফিক ও মোমিন দুজনেই বিভিন্ন ধরনের কাজের পাশাপাশি কয়েকটি কোর্স করেছেন। দুজনেই এখন কনস্ট্রাকশন সেক্টরে কাজ করেন। প্রতি মাসে কয়েক লাখ টাকা পাঠান দেশে পরিবারের জন্য। কিন্তু এতো হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পরও তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। অস্ট্রেলিয়া সরকার ধরে এখনই বের করে দিচ্ছে না বটে, কিন্তু থাকার জন্যও কোনো স্থায়ী সমাধান দিচ্ছে না। ঝুলন্ত এক বর্তমান সময়ে তারা জীবনযাপন করে চলেছেন বছরের পর বছর।

দক্ষিণ গোলার্ধের দেশ অস্ট্রেলিয়া একটি মাল্টিকালচারাল দেশ হিসেবে বিভিন্ন পেশা ও দক্ষতার মানুষদের স্থায়ী ভিসা এবং পর্যায়ক্রমে নাগরিক হওয়ার সুবিধা দেয়। পাশাপাশি জাতিসংঘের শরণার্থী কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বিভিন্ন দেশের শরণার্থীদেরকেও অস্ট্রেলিয়া নিরাপদ আশ্রয় দেয়। নিজ দেশে রাজনৈতিক মত, ধর্মীয় পরিচয়, জাতীয়তা, বর্ণপরিচয় বা কোন বিশেষ জনগোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে জীবন বিপন্ন হওয়ার মতো পরিস্থিতি হলে এ আশ্রয় প্রার্থনা করা যায়। পেশার ভিত্তিতে অভিবাসন এবং জীবন রক্ষার্থে আশ্রয় প্রার্থনার মাঝামাঝি আরেকটা শ্রেণি আছে, যাদেরকে বর্তমানে নাগরিকত্ব বিষয়ক বিদ্যায় ইকোনমিক রিফিউজি বা অর্থনৈতিক শরণার্থী বলা যায়। তবে তারা শ্রমিকদের জন্য প্রথাগত নিয়মের অধীনে না এসে বরং বেআইনিভাবে এসেছে। শফিক এবং মোমেনরা এ শ্রেণিতে পড়েন। দুঃখজনকভাবে এদের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য এখনো সুনির্ধারিত কোনো আইনি কাঠামো নেই।

কথায় কথায় তারা জানালেন, তাদের মতো অবস্থায়, অর্থাৎ বেআইনিভাবে অস্ট্রেলিয়ায় এসে পৌঁছা শরণার্থী যাদের ভিসার কোনো সমাধান এখনো হয়নি, এমন মানুষ আছেন প্রায় আট হাজার। এদের অনেকে এসেছে যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ থেকে, অনেকে এসেছে দরিদ্র দেশ থেকে। নানা দেশের নানা জাতের মানুষ। তাদের মাঝে সর্বমোট মাত্র তিনশ জনের মতো বাংলাদেশি। এই তিনশ মানুষের বর্তমান সবচেয়ে বড় চাওয়া হলো বাংলাদেশের একটি পাসপোর্ট পাওয়া।

কথোপকথনের এ পর্যায়ে অবাক হতে হয়। বাংলাদেশের পাসপোর্ট পেতে সমস্যা কী? তারা তো জন্মগতভাবে বাংলাদেশের নাগরিক। তাহলে দূতাবাসের মাধ্যমে কেন পাসপোর্ট পেতে পারেন না? শফিক জানান, শেখ হাসিনার সরকার বিদেশে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থনা করা ভিন্নমতাবলম্বীদেরকে শাস্তি দেওয়ার জন্য তাদের পাসপোর্ট রিনিউ করা বন্ধ করে দেয়। নাগরিকত্ব বিষয়ক আন্তর্জাতিক যে কোনো আইন ও অধিকারের এটি সুস্পষ্ট লংঘন। জাতিসংঘের ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অফ হিউম্যান রাইটসেরও লংঘন। কিন্তু বাংলাদেশে কোন অধিকারের তোয়াক্কা কে করে? ফ্যাসিবাদী দানব হাসিনার পতন হয়েছে, কিন্তু তার অনুসারীরাই বাংলাদেশের সরকারি অফিসগুলো চালাচ্ছে। দূতাবাসগুলো চালাচ্ছে। হাসিনার কালাকানুনের প্রয়োগ এখনো অব্যাহতই রয়ে গেছে।

দূতাবাসগুলো যদি শরণার্থীদেরকে বাংলাদেশি পাসপোর্ট না দেয় তাহলে বর্তমান নতুন পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের লোকজনেরই বিপদে পড়ার কথা। তারা এখন বিশ্বের নানা দেশে গণহারে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করছে। তাহলে এ চর্চা এখনো কেন ধারাবাহিক আছে? অস্ট্রেলিয়ায় দীর্ঘদিন যাবত বসবাস করছেন, বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা কাজকর্মে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন এমন কয়েকজন অভিজ্ঞ প্রবাসীকে এ প্রশ্ন করেছিলাম। তারা মুচকি হাসেন। দূতাবাসে না কি টাকা দিলে সবই পাওয়া যায়। আওয়ামীরা পালিয়ে এসেছে অনেকে ঠিকই, কিন্তু তারা লুটপাট করে প্রচুর টাকাও নিয়ে এসেছে। সুতরাং তাদের না কি সমস্যা হবে না!!

অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাংলাদেশিদের সাথে দূতাবাস নিয়ে কথা বলতে গেলেই অসংখ্য অভিযোগ শুনতে হয়। ক্যানবেরায় অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশন এবং সিডনির কনসুলেটের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেই অভিযোগ আছে টাকার বিনিময়ে পাসপোর্ট ইস্যু করার। এ অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে হাতেনাতে ধরা খেয়ে সরকারি কর্মকর্তাকে বাংলাদেশে চলে যেতে হয়েছিলো, এমন কথাও শোনা গেল। তবে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ হলো দুর্ব্যবহার এবং সেবা দিতে অনীহার বিষয়ে।

শফিক ও মোমেনের মতোই আরেকজন বাংলাদেশি শরণার্থী নাজমুল। তবে তার বয়স চল্লিশের কোঠায়। অস্ট্রেলিয়ায় আছেন আরো বেশি সময় যাবত। এখানে তিনি পেশাগতভাবে ভালো করেছেন। দুটি রেস্টুরেন্টের মালিক। কিন্তু সেই তো অনিশ্চিত শরণার্থীর জীবন। বয়স বেড়ে যাচ্ছে, এখনো নিজে বিয়ে করতে পারেননি। বরং দেশে ভাইবোন সবাইকে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছেন। তিনি জানালেন, পাসপোর্ট রিনিউ এর জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত কাগজপত্র জোগাড় করে তিনি সিডনির কনসুলেটে গিয়েছিলেন। কিন্তু তার ভিসাসংক্রান্ত কাগজপত্র দেখার পরই সংশ্লিষ্ট কমকর্তা ‘কুকুরের মতো খেঁকিয়ে উঠেন’। এই দুর্ব্যবহারের কারণ জানতে চাইলে নাজমুলকে আক্ষরিক অর্থেই ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাংলাদেশ কনসুলেট থেকে বের করে দেওয়া হয়।

নাজমুল, মোমেন, শফিক; এরা সবাই বাংলাদেশে জন্ম নিয়েছেন। বাংলাদেশে বড় হয়েছেন। তারা রক্তেমাংসে, চিন্তায় মননে, সবকিছুতেই বাংলাদেশি। এদেশে বহু বছর যাবত তারা দেখেছেন ধর্ম বর্ণ অর্থনৈতিক অবস্থা নির্বিশেষে কীভাবে সবজায়গায় মানুষকে সম্মান করা হয়। সরকারি অফিসগুলোতে সেবা দেওয়া হয়। বিশেষ পরিস্থিতির কারণে নিজেরা বঞ্চনার শিকার হওয়ার পরও সাধারণ মানুষের জন্য ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করার একটা প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতি ও চর্চা তারা এদেশে সবসময় চোখের সামনে দেখেন। পাশাপাশি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিদের এমন আচরণ ও রাষ্ট্র হিসেবে তাদেরকে ন্যায্য পাওনা পাসপোর্ট থেকে বঞ্চিত করার ঘটনা তাদেরকে ব্যথিত করে।

যে কয়জন শরণার্থীর সাথে কথা বলেছি, তাদের সবার অস্ট্রেলিয়ান ড্রাইভিং লাইসেন্স, আদালতের সর্বশেষ প্রত্যাখ্যানের আগপর্যন্ত ইস্যু করা ভিসার কাগজ ইত্যাদি পরিচয়পত্র আছে। এসব স্থানীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে তারা এদেশে ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন। তারা প্রতি বছর ট্যাক্স দিচ্ছেন। থাকার জন্য বাড়ি ভাড়া নিচ্ছেন। অস্ট্রেলিয়ার ভেতরে যে কোনো দাপ্তরিক কাজকর্ম ও লেনদেন তারা বৈধভাবেই করতে পারছেন। এমনকি বৈধ পথে রেমিট্যান্স চ্যানেল বা মানি এক্সচেঞ্জ কোম্পানির মাধ্যমে প্রতি মাসে দেশে টাকাও পাঠাচ্ছেন।

শফিক জানালেন, তার ছোটভাই বাংলাদেশের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্সে পড়ছেন। তার বাবা মালয়েশিয়া থেকে দেশে ফিরে গেছেন। প্রতি মাসে শফিক তিন থেকে চার লক্ষ বাংলাদেশি টাকা রেমিট্যান্স হিসেবে পাঠান। কিন্তু পাসপোর্ট না থাকাতে বাংলাদেশে তিনি কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন না। কোনো সম্পত্তি কিনতে পারেন না। সবকিছুই পরিবারের অন্যদের নামে করতে হয়।

জুন-জুলাই মাসে শফিক, মোমেনসহ সব শরণার্থী রেমিট্যান্স শাটডাউন আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলো। শফিক তার মোবাইলে দেখালেন, সে সময় ফেসবুকে লাইভ করে তিনি তাদের শরণার্থী কমিউনিটির সবাইকে কীভাবে ছাত্র-জনতার পক্ষে সক্রিয় হতে আহবান জানিয়েছিলেন। হাসিনার পতনের পর তারা আশা করেছিলেন বাংলাদেশ সরকারের পাসপোর্ট না দেওয়ার অমানবিক এ নিয়ম বদলাবে। বাংলাদেশ দূতাবাসের মানুষদের আচরণ ও সেবার মান বদলাবে। কিন্তু কিছুই বদলায়নি।

শফিকের সাথে মার্চ মাসের পর থেকে বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে। সমস্ত তিক্ত অভিজ্ঞতা, বঞ্চনার অভিজ্ঞতার পরও তিনি আশাবাদী এবং উদ্যমী একজন মানুষ। বারো বছর আগে মাছ ধরার নৌকায় ভেসে অস্ট্রেলিয়ায় এসেছিলেন। ছয়দিন ছয়রাত ভেসে ছিলেন দিকহারা সমুদ্রে। তার কথা শুনতে শুনতে, তাকে দেখতে দেখতে আমার মনে হয় আসলে এ মানুষগুলো বারো বছর ধরেই অনিশ্চয়তাপূর্ণ ভাসমান একটি জীবন কাটিয়ে যাচ্ছেন। আবার একদিন দেখা হলো সিডনির বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকা লাকেম্বায়। তার জীবনের ঘটনাগুলোর বাকি অংশ শুনতে গিয়ে মনে হলো তার ধূসর চোখের দৃষ্টিতে বহু বছরের ক্লান্তি। আবার এ দৃষ্টিতে একইসাথে অনেক প্রতিকূল ভবিষ্যতের সম্ভাবনার মাঝেও কিছু আশাও যেন বেঁচে আছে কোথাও।

এই মানুষগুলোকে কোনো সহায়তা করা তো পরের কথা, প্রাপ্য অধিকারও তাদের জন্মভূমি দেয় না। কথায় কথায় শফিক বলছিলেন, তারই মতো অবস্থায় থাকা একজন বাংলাদেশি শরণার্থী দুই বছর আগে স্থানীয় একটি মসজিদে গিয়ে একাকী আত্মহত্যা করেছিলেন। একই সাথে বলেন, আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। তিনি জানেন না এই দেশে শেষপর্যন্ত থাকতে পারবেন কি না। কিন্তু প্রতি মুহূর্তে তিনি বিশ্বাস করেন, পৃথিবীর অন্যপ্রান্তের আরেকটি দেশে তার নাড়ির টান রয়ে গেছে। যেখানে তার আপনজনেরা আছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে একটি পাসপোর্ট পাওয়ার ন্যায়সঙ্গত অধিকার তার আছে। শফিকুল প্রশ্ন করেন, বাংলাদেশ কেন আমাদেরকে পাসপোর্ট দিচ্ছে না? এ প্রশ্নের কোনো উত্তর আমার জানা নেই।

মালয়েশিয়ার ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড জিতলেন বাংলাদেশি নির্মাতা জাফর ফিরোজ

পোস্টাল ব্যালটের ভোট দিতে ১ লাখ ৩০ হাজার প্রবাসীর নিবন্ধন

কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ৬৪ দলের ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্ট

নেপালে বাংলাদেশ দূতাবাসের মাছ উৎসব

ইতালিতে কর্মী নিয়োগ, জরুরি যা কিছু

মুক্তি মিলছে আমিরাতে বন্দি জুলাইযোদ্ধাদের

আরও ৩৯ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠালো যুক্তরাষ্ট্র

৭ দেশের প্রবাসী নিবন্ধন কার্যক্রম স্থগিত করল ইসি

মালয়েশিয়ায় পৌঁছেছে দেশে আটকে পরা কর্মীদের প্রথম ফ্লাইট

ইসলামিক সোসাইটি অব কানাইঘাট ইউকের পূর্ণাঙ্গ কমিটি