ইউটিউবে সবচেয়ে বেশি দেখা বা শোনা হয়েছে কোন বাংলা গান? উত্তর হলো ‘অপরাধী’। ছয় বছর আগে মুক্তি পাওয়া গানটি তুমুল ভাইরাল হয়েছিল। ইউটিউবে গানটি দেখা হয়েছে ৪০ কোটির বেশিবার। ভিউয়ের বিচারে দ্বিতীয় অবস্থানে কোন গানটা জানেন? তাসনিম সাদিয়ার লেখা ও সুরে শিশুশিল্পী জাইমা নূরের গাওয়া ‘বাবা মানে হাজার বিকেল’ শিরোনামের গানটি দেখা হয়েছে ২০ কোটির বেশিবার। ‘কোরআনের আলো টিভি’ চ্যানেলে ‘বাবা মানে হাজার বিকেল’ গানটি মুক্তি দেওয়া হয়েছে সাড়ে তিন বছর আগে। ওই চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবার ১৪ লাখের একটু বেশি। অন্যদিকে ‘অপরাধী’ গানটি মুক্তি দেওয়া হয়েছে ‘ঈগল মিউজিক স্টেশন’ চ্যানেলে; যাদের সাবস্ক্রাইবার প্রায় এক কোটি।
শুধু আধুনিক বাংলা গানই না, তুমুল জনপ্রিয় সব বাংলা সিনেমার গান ভিউয়ের বিচারে হার মেনে বসে আছে ইসলামি সংগীতের কাছে। বাংলা সিনেমায় সবচেয়ে বেশি দেখা হয়েছে ‘খাইরুন লো’ গানটি। সিডি প্লাস এন্টারটেইনমেন্ট চ্যানেলে আপলোড করা গানটির ভিউ ২০ কোটির একটু বেশি। প্রায় এক কোটি ৪০ লাখ সাবস্ক্রাইবারের চ্যানেল ‘অনুপম মুভি সং’-এ আপলোড করা আরেকটি ভাইরাল সিনেমার গান ‘বধূ বেশে কন্যা যখন এলো রে’। এই গানটির ভিউ ২০ কোটির কাছাকাছি। শহিদুল ইসলামের লেখা ‘নামাজকে বোলো না কাজ আছে’ শিরোনামের একটি গান গেয়েছেন আরেক শিশুশিল্পী জাহিদুল্লাহ জামি। মাত্র ১০ লাখ সাবস্ক্রাইবওয়ালা ‘ইত্তিহাদ’ নামের ইউটিউব চ্যানেলে মুক্তি দেওয়া গানটির ভিউ ৩০ কোটির কাছাকাছি।
প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ফেসবুক ইউটিউবে হামদ, নাত, নাশিদ, কাওয়ালি, গজল, ইসলামি গান তথা ইসলামি সংগীত চর্চা যেমন বেড়েছে তেমন বেড়েছে এর দর্শক, শ্রোতাও। তরুণ ইসলামী সংগীত লেখক আতিফ আবু বকর আমার দেশকে বলেন, ‘বাংলাদেশের ইসলামি সংগীত কেবল বাংলাদেশের দর্শকই শোনেন বিষয়টা এমন জায়গায় নেই। শুধু বাংলা ভাষাভাষির দর্শকই নন, বাংলার কাছাকাছি যে ছয়টা ভাষা আছেÑ যেমন অসমিয়া, রাজবংশী, ত্রিপুরা ইত্যাদি ভাষার মানুষও ইসলামি সংগীতের বড় উৎস বাংলাদেশের ইসলামি সংগীত। তাছাড়া ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ভাষাভাষি দর্শক পুরোটাই বাংলাদেশের ইসলামি সংগীতের গুরুত্বপূর্ণ শ্রোতা।’
আতিফ আবু বকর বলেন, ‘জনপ্রিয় গানগুলোর ইউটিউব ও ফেসবুকের কমেন্ট বক্সে গেলে দেখতে পাবেন বাংলার কাছাকাছি ভাষার দর্শকরা তাদের মুগ্ধতা জানিয়েছে।’
এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মতো বাংলার কাছাকাছি আর কোনো ভাষায় ইসলামি সংগীতকে এত গুরুত্ব দেওয়া হয় না। বাংলাদেশে অনেক গানের দল গড়ে উঠেছে যারা কেবল ইসলামি সংগীত চর্চা করে। ব্যক্তি পর্যায়েও অনেকে ভালো করছে।’ ধর্মীয় আবেদন, শিল্পমান ও কাজের প্রতি যত্নবান হওয়ার কারণে বাংলা ভাষার ইসলামি সংগীত বাকিদের আকৃষ্ট করছে বলে মনে করেন তরুণ এই গীতিকার।
হাবিব মোস্তফা ইসলামি ও সুফি ঘরানার গান লিখছেন এক যুগের বেশি সময় ধরে। ইসলামি সংগীতের জনপ্রিয়তার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মানুষ মূলত সৃষ্টিগতভাবেই আত্মানুসন্ধানী। সে নিজের মূল জানতে চায়, কোথা থেকে সে এলো, কোথায় তার অবস্থান, কী তার কাজ, চূড়ান্তভাবে কোথায় সে যাবে... এই প্রশ্নগুলো তাকে তাড়িত করে। এর উত্তর পাওয়া যায় ইসলামি গানে। এই গানের মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি মানুষের সে প্রেমময় সম্পর্কটা পরিষ্কার করে প্রকাশ করা হয়। সুন্দর ও সাবলীল ভাষায়, শ্রুতিমধুর কণ্ঠের ইসলামি গানগুলো তাই সবার পছন্দের তালিকায় শীর্ষে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশে ইসলামি সংগীতের চর্চা করা হয় তিনভাবে। অনেক শিল্পী ব্যক্তিগত উদ্যোগে গান করেন। নিজে গান লেখেন অথবা প্রচলিত জনপ্রিয় গানগুলো কভার করেন। তারপর আপলোড করেন নিজের ইউটিউব চ্যানেলে ও ফেসবুক পেজে। নওশাদ মাহফুজ, ওবাইদুল্লাহ তারেক, আমিরুল মোমেনিন মানিক, জাইমা নূর, মশিউর রহমান, হুমায়রা আফরিন ইরা উল্লেখযোগ্য।
দ্বিতীয়ত, ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার লক্ষ্যে গড়ে উঠেছে বেশকিছু সাংস্কৃতিক সংগঠন। হামদ, নাত, ইসলামি কবিতা আবৃত্তির পাশাপাশি ইসলামি নাটক-নাটিকা করে থাকে এসব শিল্পীগোষ্ঠী। সাইমুম, টাইফুন, উচ্চারণ, কলরব, পাঞ্জেরী, দিশারী, ইক্বরা ইত্যাদি শিল্পীগোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে মাঠ পর্যায়ে ইসলামি সংগীত চর্চা করে আসছে। ক্যাসেট যুগে তারা নিয়মিত গানের অ্যালবাম বের করত। এখন বেশিরভাগ গান মুক্তি দেওয়া হয় ইউটিউব, ফেসবুকে। এসব শিল্পীগোষ্ঠী অনলাইনের পাশাপাশি মঞ্চ পরিবেশনায় দেখা যায় ইসলামি ঘরানার অনুষ্ঠানে।
সময়ের চাহিদায় বেশকিছু ধর্মভিত্তিক ইউটিউব চ্যানেল ও আইপি টিভির মতো প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। কোরআনের আলো টিভি, প্যান ভিশন টিভি, হলি টিউন, হ্যাভেন টিভি, ইনফিউশন, স্পন্দন অডিও ভিজ্যুয়াল সেন্টার, মেলোডি কালচারাল একাডেমির মতো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে যারা কেবল ইসলামি সংগীত, হামদ, নাত, আবৃত্তির মতো ইসলামি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে।
ইসলামি গানের শিল্পীদের মধ্যে জনপ্রিয়তার বিচারে এগিয়ে আছে শিশুশিল্পীরা। বেশকিছু জনপ্রিয় গান উপহার দিয়ে জাইমা নূর আছেন উপরের দিকে। সাদমান সাকিব, সহোদর আক্বসা ও শাবাব, জাহিদুল ইসলাম শাওন, নুসরাত জাহান, হুমায়রা আফরিন ইরাসহ একঝাঁক শিশু শিল্পী তাদের সুরে মোহিত করে রাখছে ইসলামি সংগীতের শ্রোতাদের। বড়দের ভেতর নওশাদ মাহফুজ, ওবায়দুল্লাহ তারেক, শাহাবুদ্দিন আহমেদ, মাহমুদ ফয়সাল, ইকবাল হোসেন জীবন, আবিদ আজম, রোকনুজ্জামানসহ জানা-অজানা অনেক শিল্পী তাদের কণ্ঠে প্রচার করে যাচ্ছেন হামদ, নাত ও ইসলামের মহিমা। দেশে ও দেশের বাইরে স্টেজেও গান গাইতে ডাক পড়ছে এসব শিল্পীর। ক্যাসেট যুগে মওলানা তারেক মনোয়ার, সাইফুল্লাহ মনসুরদের আলাদা শ্রোতা তৈরি হয়। যার প্রভাব পড়েছে অনলাইন যুগেও। এছাড়া সংগীত জগতের অনেক শিল্পী ইসলামি নজরুল সংগীত ও হামদ, নাত গেয়েছেন।
কবি গোলাম মোস্তফা, কাজী নজরুল ইসলাম, আব্বাস উদ্দিনদের হাত ধরে শুরু হয় ইসলামি সংগীতচর্চা। স্বাধীনতা-পরবর্তী ইসলামি সংগীতের গীতিকার হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন কবি মতিউর রহমান মল্লিক। বর্তমানে গীতিকার হিসেবে আবুল আলা মাসুম, মতিউর রহমান খালেদ, বেলাল হোসেন নুরী, নুরুজ্জামান শাহ, আবু তাহের বেলাল, মাহফুজুর রহমান আকন্দ, চৌধুরী গোলাম মওলা, আমিনুল ইসলাম, সাইফ সিরাজ, সাঈদ ওসমান, আতিফ আবু বকর, জুবায়ের বীন ইয়াসিন, আজিজ হাকিম, রাকিবুল এহসান মিনার, মল্লিক মাহমুদ, আলাউদ্দিন আদর, আব্দুল্লাহ আল মামুন, শাহজাহান শাহেদ, হোসাইন নূর, গাজী খাইরুল ইসলাম ইত্যাদি গীতিকারের নাম উল্লেখযোগ্য। সুরকার হিসেবে মশিউর রহমান অনেক এগিয়ে। তরুণদের মধ্যে ভালো করছেন জাহিদুল ইসলাম, মাহমুদ ফয়সাল, রাবী জামানসহ অনেকে।