আবু বকর (রা.) ছিলেন মুসলিম উম্মাহর প্রথম খলিফা। আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি মুসলিম উম্মাহর অভিভাবক হয়েছিলেন এবং তাদের শাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর একান্ত সহচর। ইসলামের সূচনা থেকে নবীজির ইন্তেকাল পর্যন্ত তার সঙ্গ তিনি ত্যাগ করেননি। মক্কায় তারা কাফেরদের নির্যাতন একসঙ্গে সহ্য করেছেন, হিজরতের সময়ে সাওর গুহায় একসঙ্গে আত্মগোপন করেছেন, নবী জীবনের সবগুলো যুদ্ধে তিনি নবীজির সঙ্গে থেকেছেন, জীবনের অন্তিম সময়ে নবীজি যখন অসুখে ভুগছিলেন, মসজিদে নববিতে মুসলিমদের নামাজের জামাত পরিচালনার দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন এবং নবীজির ইন্তেকালের পর তিনি মুসলিম উম্মাহর শাসনভাব গ্রহণ করেছেন।
কিন্তু হজরত আবু বকরই কেনো প্রথম খলিফা হলেন? প্রথম খলিফা হওয়ার জন্য তার কী কী যোগ্যতা ছিল? তার যোগ্যতার স্বীকৃতি কী কোরআন-সুন্নাহয় পাওয়া যায়?
কোরআনের বিভিন্ন আয়াত এবং নবীজির একাধিক হাদিসে আবু বকর (রা.)-এর প্রথম খলিফা হওয়ার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
কোরআনে আবু বকর (রা.)-এর শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি
আবু বকর (রা.)-এর খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের বিষয়ে কোরআনুল কারিমে আল্লাহতায়ালা সরাসরি ও স্পষ্ট শব্দে কোনো কিছু উল্লেখ করেননি। তবে বেশ কিছু আয়াতে খলিফা নির্বাচনের ক্ষেত্রে আবু বকর (রা.)-এর অগ্রগণ্যতার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
এক. আল্লাহর অনুগ্রহপ্রাপ্ত বান্দার অনুসরণ
প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি—‘আমাদের আপনি সরল পথ দেখান। তাদের পথ, যাদের ওপর আপনি অনুগ্রহ করেছেন, যাদের নিয়ামত দিয়েছেন, যাদের ওপর (আপনার) ক্রোধ আপতিত হয়নি এবং যারা পথভ্রষ্টও নয়।’ (সুরা ফাতিহা, আয়াত : ৬-৭)
এই আয়াতে আল্লাহতায়ালা মানুষকে বলছেন, তোমরা সরল পথপ্রাপ্তির প্রার্থনা করো, তোমরা তাদের পথপ্রাপ্তি কামনা করো, যাদের আমি অনুগ্রহ করেছি। কিন্তু আল্লাহতায়ালা কাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন? আল্লাহর অনুগ্রহপ্রাপ্ত বান্দা কারা? তারা হলেন—‘আর যারা আল্লাহ ও রাসুলের আনুগত্য করে, তারা তাদের সঙ্গে থাকবে, যাদের ওপর আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন—নবী, সিদ্দিক, শহীদ ও সৎকর্মশীলদের মধ্য থেকে। আর সাথি হিসেবে তারা হবে উত্তম।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ৬৯)
এই আয়াত থেকে আমরা জানতে পারছি, অনুগ্রহপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের একটি বিশেষ শ্রেণি হলো সিদ্দিক। তারা হলেন সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তি। আর আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, আবু বকর (রা.) সিদ্দিক শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। শুধু তাই নয়; তিনি ছিলেন সিদ্দিকদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। কাজেই মুসলিম উম্মাহর প্রতিজন সদস্য যখন আবু বকর (রা.) ও তার মতো ব্যক্তিদের পথে পরিচালিত করার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করে, তখন নবীজি (সা.)-এর অবর্তমানে একজন সিদ্দিকই যে মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্বদানের সবচেয়ে বেশি যোগ্য হবেন, তাতে কোনো সন্দেহ থাকার কথা না। আর তিনি হলেন আবু বকর সিদ্দিক (রা.)। (তাফসিরুল কোরআর বিল কোরআন মিন আজওয়াইল বায়ান, শায়খ মুহাম্মদ আমিন শানকিতি, পৃষ্ঠা : ৩৩)
দুই. সাওর গুহায় দুজনের দ্বিতীয়জন
“যদি তোমরা তাকে সাহায্য না করো, তবু আল্লাহ তাকে সাহায্য করেছেন, যখন কাফিররা তাকে বের করে দিল, সে ছিল দুজনের দ্বিতীয়জন। যখন তারা উভয়ে পাহাড়ের একটি গুহায় অবস্থান করছিল, সে তার সঙ্গীকে বলল, ‘তুমি পেরেশান হয়ো না, নিশ্চয় আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন’।” (সুরা তাওবা, আয়াত : ৪০)
“এই আয়াতে মুসলিম উম্মাহর প্রথম খলিফা আবু বকরের শ্রেষ্ঠত্ব ও অগ্রগামিতা অপেক্ষাকৃত স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে তাকে উল্লেখ করা হয়েছে ‘দুজনের দ্বিতীয়জন’ হিসেবে। ইমাম কুরতুবি লিখেছেন, কিছুসংখ্যক আলিম বলেছেন, আবু বকর (রা.) শুধু গুহার অভ্যন্তরেই ‘দুজনের দ্বিতীয়জন’ ছিলেন না, বরং তিনি পদমর্যাদায়ও এই উম্মাহর মানুষদের মধ্যে ছিলেন ‘দুজনের দ্বিতীয়জন’, অর্থাৎ নবীজি (সা.)-এর পরে সম্মান মর্যাদা ও শাসনের সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি তিনি ছিলেন।”
অন্য আরেক অর্থেও আবু বকর (রা.) ছিলেন ‘দুজনের দ্বিতীয়জন’। আল্লাহর রাসুল (সা.) ছিলেন প্রথম ব্যক্তি, যিনি মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন; আল্লাহর রাসুলের মৃত্যুর পর মুসলিম উম্মাহর নতুন সর্বাধিনায়ক হিসেবে আবু বকর (রা.) ছিলেন দ্বিতীয় ব্যক্তি যিনি সেই একই কাজ সম্পাদন করেছেন। (আবু বকর সিদ্দিক, আলি মুহাম্মাদ সাল্লাবি, পৃষ্ঠা : ১৯২)
নবীজির হাদিসে আবু বকর (রা.)-এর যোগ্যতার স্বীকৃতি
আল্লাহর রাসুল (সা.) বারবার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উপলক্ষে নিজের স্থলাভিষিক্ত হিসেবে আবু বকর (রা.)-এর নাম উল্লেখ করেছেন। মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের শঙ্কটময় সময়ে নবীজি (সা.) তাকে সঙ্গে রেখেছেন। তিনি যখন অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী ছিলেন, তখন নামাজের জামাত পরিচালনা করার জন্য তাকে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বারবার বিভিন্ন ইঙ্গিতে প্রকাশ করছিলেন, আমার পরে মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্ব দেবে আবু বকর!
এক. আমি না থাকলে আবু বকর আছেন
একবার নবীজি (সা.)-এর কাছে একজন মহিলা এলো। নবীজি তাকে অন্য সময়ে আসতে বললেন। মহিলাটি বললো, তখন এসে যদি আপনাকে আমি না পাই? অর্থাৎ যদি আপনার ওফাত হয়ে যায়। নবীজি (সা.) জবাবে বললেন, ‘আমাকে না পেলে আপনি আবু বকরের কাছে যাবেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর : ২৩৮৬)
নবীজি (সা.)-এর পরে আবু বকর (রা.)-এর মুসলিম উম্মাহর খলিফা হওয়ার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত এই হাদিসে রয়েছে। ইবনে হাজার আসকালানি (রা.) বলেন, ‘শিয়াদের যেসব ব্যক্তি দাবি করে—মৃত্যুর পরে মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্বদানের জন্য আলি ও ইবনে আব্বাস (রা.)-কে মনোনীত করেছিলেন, এই হাদিস তাদের দাবিকে ভুল ও মিথ্যা প্রমাণ করে।’ (ফাতহুল বারি, খণ্ড : ৭, পৃষ্ঠা : ২৪)
দুই. নবীজির অবর্তমানে আবু বকরের অনুরণ
হুজাইফা (রা.) বলেন, “আমরা আল্লাহর রাসুলের সঙ্গে বসে ছিলাম, তখন তিনি বললেন, ‘জানি না, আর কতদিন তোমাদের মাঝে থাকব; সুতরাং আমার পরে যারা আসবে তাদের অনুসরণ করো।’ এরপর তিনি আবু বকর ও উমরের দিকে নির্দেশ করলেন।” (জামে তিরমিজি, হাদিস নম্বর : ৩৬৬৩)
অন্য একটি হাদিসে নবীজি (সা.) আরো স্পষ্ট শব্দে বলেছেন, ‘আমার পরে তোমরা আবু বকর ও উমরের অনুসরণ করবে।’ (তিরমিজি হাদিস নম্বর : ৩৬৬২)
এই হাদিসে আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, আমার পরে আবু বকর ও উমর খলিফা হবেন। তোমরা বিনীতভাবে তাদের অনুসরণ করবে। জীবনযাপনের স্বচ্ছতা ও সত্যবাদির বদৌলতে আবু বকর ও উমর (রা.) এই মহান সৌভাগ্যের অধিকারী হয়েছিলেন। (তুহফাতুল আহওয়াজি বিশারহিত তিরমিজি, খণ্ড : ১০, পৃষ্ঠা : ১৪৭)
তিন. মুসলিমরা আবু বকর ছাড়া অন্য কাউকে মেনে নেবেন না
আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাকে তার রোগশয্যায় বললেন, ‘তোমার পিতা ও ভাইকে আমার কাছে ডেকে নিয়ে এসো। আমি একটা চিঠি লিখে দেব। কারণ আমার ভয় হয়, কোনো উচ্চাভিলাষী ব্যক্তি আকাঙ্ক্ষা পোষণ করবে এবং কেউ দাবি করে বসবে যে, আমিই হকদার। অথচ আবু বকর ছাড়া অন্য কাউকে আল্লাহতায়ালা মেনে নেবেন না এবং মুসলিমরাও মেনে নেবেন না।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর : ৬০৭৫)
এই হাদিসের কথা খুবই স্পষ্ট। নবীজি (সা.) আশঙ্কা করছিলেন, তিনি যখন দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাবেন, তখন মুসলিমজাহানের খলিফা কে হবেন, তা নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেবে। তবে আবু বকরকে খলিফা নির্বাচন করা হলে সবাই তাকে সর্বসম্মতভাবে মেনে নেবেন।
নবীজি (সা.)-এর ওফাতের পরের ঘটনাপর্ব যদি আমরা বিশ্লেষণ করি, তাহলে হাদিসের বিবরণের হুবহু বাস্তবায়ন দেখতে পাব। নবীজির ইন্তেকালের পরে সায়িদা গোত্রের প্রাঙ্গণে মুহাজির ও আনসার সাহাবিরা খিলাফত প্রশ্নে একদম মুখোমুখি অবস্থানে চলে এসেছিলেন। খিলাফত বিষয়ে বিভিন্ন রকমের মতামত আসতে শুরু করেছিল। কিন্তু আবু বকর (রা.) যখন নিজের জন্য খিলাফতের বায়াত প্রদান শুরু করলেন, তখন সবাই বিনা বাক্যব্যয়ে, সব ধরনের ওজর আপত্তি পাশে সরিয়ে রেখে তাকে খলিফা হিসেবে মেনে নিলেন।
চার. নবীজির জীবদ্দশায় নামাজের ইমাম
জীবনের শেষ দিনগুলোয় আল্লাহর রাসুল (সা.) খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। মসজিদে গিয়ে নামাজের জামাত পরিচালনা করার শক্তিটুকুও তার ছিল না। তখন নবীজি (সা.)-এর নির্দেশে আবু বকর (রা.) নামাজের ইমাম হয়েছিলেন। এরপর একদিন নবীজি (সা.) একটু সুস্থবোধ করলে আলি ও আব্বাস (রা.)-এর কাঁধে ভর করে জোহরের নামাজের জন্য মসজিদে এলেন। আবু বকর (রা.) তখন সাহাবিদের নিয়ে নামাজ আদায় করছিলেন। তিনি যখন নবীজি (সা.)-কে দেখতে পেলেন, পেছনে সরে আসতে চাইলেন। নবীজি (সা.) তাকে পিছিয়ে না আসার জন্য ইঙ্গিত করলেন এবং বললেন, ‘তোমরা আমাকে তার পাশে বসিয়ে দাও।’ তারা নবীজিকে আবু বকরের পাশে বসিয়ে দিলেন। নবীজি (সা.) বসে বসে নামাজ আদায় করলেন। আবু বকর (রা.) তাকে অনুসরণ করে আর পেছনের সাহাবিরা আবু বকর (রা.)-কে দেখে নামাজ আদায় করলেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর : ৬৮৭; সংক্ষেপিত)
নবীজি (সা.)-এর জীবদ্দশায় নবীজি (সা.)-এর নির্দেশে নামাজের ইমাম হওয়া থেকে পরিষ্কার ইঙ্গিত পাওয়া যায়—আবু বকর (রা.) ছিলেন মুসলিম উম্মাহর শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তি। কাজেই তিনিই ছিলেন খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের সবচেয়ে উপযুক্ত ও যোগ্য ব্যক্তি। (শারহুন নববি আলা মুসলিম, খণ্ড : ৪, পৃষ্ঠা : ১৩৭)
এখানে কয়েকটি আয়াত ও হাদিস উল্লেখ করা হলো। এছাড়া আবু বকর (রা.)-এর শ্রেষ্ঠত্ব ও খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণে তার অগ্রগণ্যতার বিষয়ে অনেক হাদিসে পাওয়া যায়।