স্বাধীন তদন্ত কমিশন
পিলখানায় হত্যাকাণ্ড সংঘঠিত হওয়ার আগে পূর্ব ষড়যন্ত্রে তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ এবং শেখ সেলিমের উপস্থিতিতে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর ২৪ জনের একটি কিলার গ্রুপের সঙ্গে বৈঠক হয়। নায়েক শহীদুর রহমান তার ঘনিষ্ঠ তোরাব আলীর (অন্যতম মূল ষড়যন্ত্রকারী, পরে জেলখানায় মৃত) বরাতে বলেন, ‘ভারতীয়দের সঙ্গে বৈঠকের পরে পুরো পরিকল্পনা সাজানো হয় এবং সমন্বয় করার জন্য শেখ ফজলে নূর তাপসের বাসায় বৈঠক হয়।
সেখানে উপস্থিত ছিল—নানক, মির্জা আজম, ফজলে নূর তাপস, শেখ সেলিম, লেদার লিটন এবং তোরাব আলী। সেখানে যখন জানানো হয় যে অফিসারদের হত্যা করা হবে, তখন তোরাব আলী সেখানে আপত্তি করেন। তিনি বলেন, অফিসারদের হত্যা করা যাবে না। তখন শেখ সেলিম তাকে মুরব্বি সম্বোধন করে বলেন, ‘আপনার তো বয়স হয়েছে। আপনার আর এর মধ্যে থাকার দরকার নেই। আপনার ছেলে (লেদার লিটন) আমাদের সঙ্গে থাকলেই হবে।’
পিলখানায় সংঘটিত বর্বর হত্যাকাণ্ড তদন্তের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনকে দেওয়া ৩০ নম্বর কয়েদি সাক্ষীর জবানবন্দিতে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
প্রায় ১১ মাস তদন্ত শেষে গত রোববার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন হস্তান্তর করে কমিশণ। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ওই ঘটনায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হন।
তদন্ত কমিশনের ৩৬০ পৃষ্ঠার মূল প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যারিস্টার তাপসের বাসায় আওয়ামী লীগ নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিমের উপস্থিতিতে বিডিআর সদস্যদের একাধিক বৈঠক হয়। একটি বৈঠকে অফিসারদের জিম্মি করার পরিকল্পনার কথা জানানো হয়, পরে তা পরিবর্তন করে হত্যার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই শেখ সেলিমের উপস্থিতিতে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার ২৪ জনের একটি দল বৈঠকে অংশ নেয়। সেখানে সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং তাপসকে হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্টদের নিরাপদে পালিয়ে যেতে সহায়তার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
পরিকল্পনা বাস্তবায়নে একাধিক বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আজম, লেদার লিটন ও তোরাব আলী। এসব পরিকল্পনা সম্পর্কে ৪৪ রাইফেলস ব্যাটালিয়নের সিও কর্নেল শামস অবগত ছিলেন এবং তাপস তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে সিদ্ধান্তের অনুমোদন নেওয়ার দায়িত্বে ছিলেন।
এদিকে ২০০৮ সালের জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি মেজর (অব.) নাসির উদ্দিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে তিনি কলকাতা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং ইন্ডিয়ান হাইকমিশনে টুরিস্ট ভিসার জন্য আবেদন করেন। প্রথমবার সেখানে গেলে মেজর নাসিরকে তার ভিসার জন্য ডিফেন্স উইংয়ে যোগাযোগ করতে বলা হয়। পরের দিন মেজর নাসির হাইকমিশনে আবার যান, রিসিপশনে ১৫-২০ মিনিট অপেক্ষা করেন। তারপর তাকে বলা হয়, আগে নিরাজ শ্রীবাস্তবের সঙ্গে দেখা করতে হবে। প্রথম সাক্ষাৎটি ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ। দিল্লি থেকে আসা তরুণ কর্মকর্তা মেজর নাসিরকে বিস্কুট ও কফি অফার করেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অর্ধঘণ্টা আলোচনা করেন এবং মেজর নাসিরকে পরের দিন আসতে বলেন। দ্বিতীয় দিন তিনি কিছুটা গম্ভীর হয়ে বলেন, বাংলাদেশের মানুষ আবেগপ্রবণ এবং পাকিস্তানের দর্শন অনুসরণ করে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের আর্মি, নেভি ও এয়ার ফোর্সের ডকট্রিন পাকিস্তানের সঙ্গে একই। এরপর তিনি মেজর নাসিরকে পদুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন। মেজর নাসির বলেন, তিনি আমেরিকায় অবস্থান করার কারণে কিছু জানেন না।
নিরাজ শ্রীবাস্তব বলেন, Padua-তে বিডিআর ১৬-১৭ জন বিএসএফ সদস্যকে হত্যা করেছে। এটি ছিল একটি গুরুতর উসকানিমূলক ঘটনা। তিনি বলেন, ‘Padua will not go unchallenged and unpunished.’ ২০০৮ সালে আরেকবার এক উচ্চপদস্থ ভারতীয় কূটনীতিকের সঙ্গে মেজর নাসিরের দেখা হয়। তিনি মাসটি স্মরণ করতে পারেননি, তবে ঘটনাগুলো সবই ২০০৮ সালের মধ্যে হয়েছিল। (সূত্র : সাক্ষী নম্বর : ৯৫) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে জানা যায়, Mr. Niraj Srivastava ২০০৬ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় হাইকমিশনে Minister পদবিতে নিয়োজিত ছিলেন। (সূত্র : পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পত্র নম্বর : ১৯.০০.০০০০.৭৩০.২৮.৩৭.২৫-২৩১৯, তারিখ ২২ অক্টোবর ২০২৫, সংযোজনী : ৫৩)